অবশেষে ইউনেস্কোর আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তালিকায় স্থান পেল কলকাতার দুর্গোৎসব (‘বিশ্বমঞ্চে কলকাতার পুজো’, ১৬-১২)। বিশ্বমঞ্চে দুর্গাপুজো, এ যেন বাঙালির মুকুটে আরও একটা পালক। তার সঙ্গে এই জয় ভারতেরও।
ইউনেস্কোর ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’-র কাজ হল বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিকে স্বীকৃতি দিয়ে সমগ্র বিশ্বের কাছে তুলে ধরা। সেই সূত্রেই প্যারিসে আবহমান বিশ্ব-সংস্কৃতি রক্ষা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কমিটির সম্মেলনে স্বীকৃতি পেল কলকাতার দুর্গাপুজো। প্রসঙ্গত বলি, এর আগে ইউনেস্কোর আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তালিকায় এ দেশের কুম্ভমেলা, মণিপুরের বৈষ্ণব সঙ্কীর্তন, পুরুলিয়ার ছৌ লোকনৃত্য বা লাদাখের বৌদ্ধ মন্ত্রোচ্চারণের মতো আরও ১৩টি সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য স্থান পেয়েছে। তবে ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতি প্রদানের ক্ষেত্রে মূলত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিকটিই বেশি প্রাধান্য পেলেও সঙ্গে বিচার্য থাকে— সেই উৎসবকে কেন্দ্র করে মানুষের যুক্ত হওয়া, অর্থনৈতিক বুনিয়াদ গড়ে ওঠা, শৈল্পিক কর্মকাণ্ডের প্রসার, কর্মসংস্থান, পর্যটন, বিভিন্ন প্রান্তিক গোষ্ঠীর সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করা এবং মহিলাদের যুক্ত করা। এই সব বিষয় খতিয়ে দেখলে এটা সুনিশ্চিত ভাবে বলা যায়, কলকাতার দুর্গোৎসব এক বৃহৎ কর্মযজ্ঞ, যেখানে দীর্ঘ দিন ধরে একটা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা সার্থক রূপ পরিগ্রহ করে। দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে বহু মানুষের জীবন ও জীবিকার প্রসার ঘটে, বিকাশ ঘটে নান্দনিক শিল্পের, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান-সহ সামাজিক কর্মকাণ্ড এবং দর্শনার্থীদের ঢল এই উৎসবকে প্রাণবন্ত করে তোলে। বাঙালির দুর্গাপুজোর একটা বিশ্বজনীন আবেদন ছিলই। ফলে এই স্বীকৃতিলাভ ছিল সময়ের অপেক্ষা।
কোনও দেশের কোনও সাংস্কৃতিক পরম্পরার স্বীকৃতি যেন সেই সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের পরম্পরাকে বজায় রাখার জন্য আরও বেশি দায়িত্বশীল করে তোলে। অতএব, এই মর্যাদা ধরে রাখার জন্য পুজো উদ্যোক্তা, সরকার-সহ সকলকেই যত্নশীল হতে হবে।
পরেশনাথ কর্মকার
রানাঘাট, নদিয়া
একেই বলে ধর্ম
দুর্গাপুজোর বিশ্বস্বীকৃতি নিঃসন্দেহে একটি সুখবর। আয়োজনে, সমারোহে, পরিকল্পনায় দেশের যে কোনও পুজোকে ছাড়িয়ে যায় বাঙালির দুর্গাপুজো। সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী প্রদত্ত পরিসংখ্যান অনুসারে বঙ্গে কমবেশি ৩৬ হাজার দুর্গাপুজো হয়ে থাকে। অন্য এক হিসাব বলছে, এই পুজোয় ব্যবসায়িক লেনদেনের পরিমাণ প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। দুর্গাপুজোর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় মানুষকে আনন্দ দেওয়ার অনন্যতা। প্রতিটা দিনই হয়ে ওঠে নিবিড় আনন্দঘন। এই আনন্দ, এত আয়োজন শুধুই কি এক বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের একান্ত নিজস্ব? পুজোয় ব্যবহৃত কাঁসর-ঘণ্টা বা অন্যান্য পূজাসামগ্রীর অধিকাংশই যাঁদের হাতে তৈরি, তাঁরা অনেকেই খাগড়ার ইসলাম ধর্মের মানুষ। যাঁরা মণ্ডপ নির্মাণ করেন, তাঁরা সবাই কি হিন্দু গোষ্ঠীভুক্ত? দেবীর শাড়ির উপর যে জরি, চুমকির কাজ, সেগুলোতে ইসলাম ধর্মের মানুষেরও হাতের স্পর্শ থাকে। মুজফ্ফরপুর থেকে যে পদ্মফুল আমদানি করা হয়, সেগুলো কি শুধুই হিন্দুদের ঝিলে উৎপন্ন? তা ছাড়া পোশাক-পরিচ্ছদ তৈরিতে বহু মানুষ বংশানুক্রমে জড়িত, যাঁরা হিন্দু নন। সেই পোশাক কেনার সময় কেউ কি বিষয়টা মাথায় রাখেন?
কুমোরটুলির প্রতিমা শিল্পীরা গঙ্গার যে জায়গা থেকে দুধেমাটি কেনেন, তার অধিকাংশই তুলে ছোট ছোট নৌকা বোঝাই করেন মূলত ইসলাম ধর্মের মানুষ। সর্বোপরি, মণ্ডপে মণ্ডপে যাঁরা ঠাকুর দেখতে ঘুরে বেড়ান, তাঁরা বিশেষ একটা ধর্মেরই মানুষ, এ কথা কি বলা যায়? এই মিলন থেকে উৎসারিত আনন্দই ধরে রাখে মানুষকে। এরই নাম ধর্ম। সেই ধর্মের মধ্যে কোথাও কি আছে বিভাজন, ঘৃণা, সঙ্কীর্ণতা? নানা ধর্মের মানুষের মধ্যে যদি উদারতা, শান্তি আর সহাবস্থানের বাণীর প্রভাব ক্রিয়াশীল না হত, তা হলে এই সাক্ষাৎ-মিলন সম্ভব হত না। এর
মূল্য অপরিসীম।
রঘুনাথ প্রামাণিক
কালীনগর, হাওড়া
প্রদীপের নীচে
ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কলকাতার দুর্গাপুজো। পশ্চিমবঙ্গ তথা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাঙালিদের কাছে এই স্বীকৃতি বাড়তি আত্মপ্রসাদ এনে দেয়। ২০১৮ সালের পুজোর সময় থেকে কেন্দ্রীয় সরকার এই অন্তর্ভুক্তিকরণের বিষয়ে প্রচেষ্টা চালিয়ে এসেছে। তাদের তথ্য ও অন্যান্য নথি দিয়ে সাহায্য করেছেন গবেষক তপতী গুহঠাকুরতা-সহ অন্য বিশেষজ্ঞেরা। তাই প্রত্যাশিত ভাবে এই গরিমার শরিক হতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী-সহ বিজেপির রাজ্যনেতারা। আবার রাজ্যের শাসক দল এই বিষয়ে দলনেত্রী ছাড়া অন্য কাউকে বিন্দুমাত্র কৃতিত্ব দিতে রাজি নয়। আশার কথা, ইউনেস্কো দুর্গাপুজোর ধর্মীয় পরিচয় নয়, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও আবহমান বৈচিত্রের স্বীকৃতি দিয়েছে।
আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে কর্পোরেট ছোঁয়ায় কলকাতার দুর্গাপুজো সাবেকিয়ানা ছেড়ে নব যুগে প্রবেশ করে। ক্রমে তা মফস্সলের পুজোতেও সংক্রমিত। বিসর্জনের পরের দিন থেকে পরবর্তী পুজোর প্রস্তুতিতে লেগে পড়া, থিমের পুজো, খুঁটিপুজো, সেরা মণ্ডপ, আলোকসজ্জার পাশাপাশি সেরা ইঁদুরের জন্যও পুজো কমিটিগুলি আজ ইঁদুর দৌড়ে শামিল হয়। জাঁকজমকে ঢাকা পড়ে যায় প্রতিমায় সীসাযুক্ত রঙের বহুল ব্যবহার, শব্দদানবের অত্যাচার, গঙ্গাদূষণ, ঢাকির পাশে কাঁসর বাজানো বাচ্চা ছেলেটির করুণ মুখ ও সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় মুদ্রিত বিসর্জনের পর দিন গঙ্গাবক্ষ থেকে মুকুট তুলে আনা হাসিমুখ কিশোরের ছবি।
সন্দেহ নেই আড়ে বহরে দুর্গাপুজোকে প্রসারিত করেছে মা-মাটি-মানুষের সরকার। প্রতিমার চক্ষুদান, দেবীপক্ষের প্রথম দিন থেকে পুজোর উদ্বোধন, রেড রোডে বিসর্জনের কার্নিভাল আয়োজন— কলকাতার দুর্গাপুজো সত্যিই আজ মুখ্যমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ সংযোগধন্য। বিশ্বস্বীকৃতির হাত ধরে পর্যটন বেড়ে আখেরে রাজ্যের কোষাগারে ভরবে কি না, তা ভবিষ্যৎ বলবে। আপাতত ঐতিহ্যের দোহাই দিয়ে সরকারি কর্মচারীরা আরও দু’-চার দিন বাড়তি ছুটি পেলে মন্দ কী!
রাজশেখর দাশ
কলকাতা-১২২
সবার দায়িত্ব
‘বিশ্বমঞ্চে কলকাতার পুজো’ সংবাদটি পড়ে বাঙালি হিসাবে নিঃসন্দেহে গর্বিত। কলকাতার দুর্গাপুজো ‘সর্বজনীন’ থেকে ‘বিশ্বজনীন’ রূপে স্বীকৃত হল। যদিও প্রোটোকল অনুসারে, ভারতের সাংস্কৃতিক দফতরই হিন্দু তথা বাঙালিদের দুর্গাপুজোকে ‘কালচারাল হেরিটেজ’ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে রাষ্ট্রপুঞ্জের কাছে আবেদন জানিয়েছিল চার বছর আগে, তবুও হেরিটেজ তকমা পাওয়ার উদ্যোগটা সর্বপ্রথম নিয়েছিলেন এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। উনিই প্রথম কলকাতার সেরা দুর্গা প্রতিমাগুলোকে নিয়ে একটি ‘কার্নিভাল’ অনুষ্ঠান করেছিলেন, সেখানে বিশ্বের অনেক দেশকে দূতাবাসের মাধ্যমে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেই সময় নাকি ইউনিসেফকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল এই অনুষ্ঠানে। ইউনিসেফের প্রতিনিধিরা এই কার্নিভালের উপস্থাপনা দেখে মুগ্ধ হয়ে ‘হেরিটেজ’-এর আবেদনের জন্য পরামর্শ দেন। সেই মতো দীর্ঘ চার বছরের প্রতীক্ষার পর বাঙালির দুর্গাপুজো আজ ‘অধরা ঐতিহ্য’-র শিরোপায় সম্মানিত হল।
তাই এ দেশের প্রতিটি নাগরিক তথা বাঙালি, দুর্গাপুজোর সঙ্গে যুক্ত মৃৎশিল্পী, উদ্যোক্তা, ক্লাবকর্তা, সংস্থা এবং দর্শনার্থীদের প্রত্যেকেরই কর্তব্য দুর্গাপুজোর মধ্যে সঙ্কীর্ণ রাজনীতির মেরুকরণ না ঘটিয়ে দেশের ও বাংলার এই ঐতিহ্যবাহী সম্মানকে বিশ্বের দরবারে অক্ষুণ্ণ রাখা।
তপনকুমার বিদ
বেগুনকোদর, পুরুলিয়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy