সুকান্ত চৌধুরীর ‘কুমির, শেয়াল ও শিক্ষা’ (২৯-৭) প্রবন্ধটি প্রসঙ্গে জানাই, শিক্ষা ভয়াবহ আক্রমণের সম্মুখীন। শিক্ষা আজ অর্থবানের কাছে সুলভ, বহু মেধাবীর কাছে দুর্লভ। অবৈতনিক সর্বজনীন শিক্ষা ইউরোপে এখনও বর্তমান। আমাদের এখানে অবৈতনিক কথাটিই কেবল রয়েছে। মাত্র ২৯০ টাকা দিয়ে ভর্তি হওয়ার কথা বললেও সরকার পোষিত স্কুলে কোথাও কোথাও তার দশগুণ টাকা দিয়ে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাতে হয়। এ ব্যাপারে স্কুল কর্তৃপক্ষের উত্তর, বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষক, করণিক, ঝাড়ুদার, কম্পিউটার অপারেটর, বিভিন্ন ধরনের কর্মী অল্প টাকায় স্কুল কর্তৃপক্ষকে রাখতে হয়। নয়তো স্কুল চালানো অসম্ভব। অথচ, বছরের পর বছর শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগ বন্ধ। এ আমাদের লজ্জা নয় কি?
বিভিন্ন শিক্ষা কমিশন দেশের শিক্ষার জন্য বাজেটের ১০% ব্যয়ের সুপারিশ করেছিল। স্বাধীনতার পর কোনও বছরই ওই লক্ষ্যমাত্রা ছোঁয়নি। উল্টে বরাদ্দ কমে গিয়েছে। মিড-ডে মিলের খাবারের বরাদ্দও যথেষ্ট কম। এ রাজ্যে প্রায় ৮২০০ বিদ্যালয় অবলুপ্তির পথে। নতুন কোনও সরকারি বিদ্যালয় দীর্ঘ ৩০-৩৫ বছরে হয়নি। তবে বেসরকারি বিদ্যালয় অসংখ্য হয়েছে। কেন্দ্র ও রাজ্য, উভয় সরকারই বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে উৎসাহ দিচ্ছে। ১৯৮৬-র জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছিল, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য হল বিনিয়োগের সবচেয়ে ভাল ক্ষেত্র। ২০২০-র নীতিতেও একই বার্তা দেওয়া হল।
শিক্ষা দফতরের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই, ভাবনা নেই। কেউ পরামর্শ দিলেও তা গ্রহণ করে না। পাঠ্যবই না মিললেও সিমেস্টার পদ্ধতি অনুসারে না শিখিয়েই পরীক্ষা নেওয়া হয়। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় মনে করতেন, শিক্ষার পরিকল্পনা শিক্ষাবিদদের করা উচিত। কিন্তু বর্তমানে তথাকথিত শিক্ষাবিদরা সরকারের নির্দেশেই চালিত হন।
বিখ্যাত ঔপন্যাসিক লেও টলস্টয় একদা বলেছিলেন, জনগণের অজ্ঞতার মধ্যেই শাসকের ক্ষমতা লুকিয়ে থাকে।
শংকর কর্মকার, হালিশহর, উত্তর ২৪ পরগনা
বৃথা দৌড়
‘কুমির, শেয়াল ও শিক্ষা’ প্রসঙ্গে কিছু কথা। বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে যে চরম অরাজকতা চলছে, তা কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের যৌথ পরিকল্পনায় গভীর ষড়যন্ত্র বলে মনে হয়। ছাত্রছাত্রীদের হতে হচ্ছে অশ্বমেধের ঘোড়া, দৌড়ে যাও আর দৌড়ে যাও। স্নায়ুর চাপ বাড়ছে ছাত্রছাত্রীদের, তার সঙ্গে অভিভাবকদেরও। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কোচিং-এর বাজার, ট্যাঁকের জোর থাকলে লেখাপড়া হবে, না হলে নয়। সর্বভারতীয় প্রবেশিকা পরীক্ষাগুলোতে এখন মাল্টিপল চয়েস প্রশ্নের দৌরাত্ম্য বেড়েছে, উৎসাহ পাচ্ছে মুখস্থ-সর্বস্ব কম্পিউটার-নির্ভর শিক্ষাপদ্ধতি, সুযোগ কমছে বৌদ্ধিক বিকাশের। কাঞ্চনমূল্যের বিনিময়ে এখন ছেলেমেয়েদের ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানানো হয়, মেধার প্রয়োজন নেই। অন্য দিকে, মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও অনেক নিম্নবিত্ত পরিবারের পড়ুয়া উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত।
গ্ৰাম-মফস্সল এলাকাতেও ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে বেসরকারি স্কুল, অন্য দিকে অপর্যাপ্ত শিক্ষক, পরিকাঠামোর জীর্ণ খাঁচা আর অপুষ্টিতে ভোগা ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে সরকারি স্কুলগুলি টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। শেষ সম্বলটুকু উজাড় করে অভিভাবকরা বাধ্য হচ্ছেন ছেলেমেয়েদের ওই বেসরকারি স্কুলে পড়াতে। শ্রেণিকক্ষে পাঠদান বৈদ্যুতিন মাধ্যমে করানোর ব্যবস্থা (স্মার্ট ক্লাসরুম) না করে অপরিণত মস্তিষ্কের ছাত্রছাত্রীদের হাতে সরকার তুলে দিচ্ছে ট্যাব, বিপথগামী হচ্ছে তারা। বাধ্য করা হচ্ছে অনলাইন কোচিং নিতে। এই সব ভ্রান্ত শিক্ষানীতি নির্ধারণ করা হচ্ছে কেবলমাত্র বাজার-অর্থনীতির দিকে তাকিয়ে। শিক্ষা এখন শুধু রাজনৈতিক মুনাফার ক্ষেত্র।
শুভ্রা সামন্ত, বালিচক, পশ্চিম মেদিনীপুর
বিভাজনের ফল
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শিক্ষার অধিকার সংবিধান স্বীকৃত। কিন্তু বৈষম্য থেকেই গেছে। অতিমারির সময় প্রায় দু’বছর সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। এই সময়ে গ্ৰামের বহু ছেলেমেয়ে অক্ষর ভুলেছে, ভুলেছে অঙ্ক। এক বিরাট বিভাজন তৈরি হয়েছে গ্ৰাম-শহরের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। দরিদ্র পরিবারগুলির অনেক ছাত্রছাত্রী পড়া ছেড়ে টোটো চালাচ্ছে, ফেরিওয়ালার কাজ করছে, জনমজুরি করছে। অনেক নাবালিকার বিয়ে হয়ে গেছে। স্কুলছুটের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি শিক্ষার মানের ক্ষতি করেছে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে হতাশ করেছে। এখন রাজ্যে সরকারি ও সরকার অনুমোদিত স্কুলে শিক্ষার পরিকাঠামো নিম্নমানের। ল্যাবরেটরি, গ্ৰন্থাগার অনেক স্কুলে নেই। ছাত্র-ছাত্রীদের বসার জায়গা নেই। বিল্ডিংয়ের ভগ্নদশা। পঠনপাঠনের মান নিম্নগামী। ছাত্র অনুপাতে শিক্ষকের সংখ্যা কম। শিক্ষকের অভাবে স্কুল বন্ধ হচ্ছে। অতিরিক্ত ছুটি শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করছে।
শিক্ষায় দুর্নীতি দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। বোর্ডের পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস, ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস, পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন, গ্ৰেস মার্কস, পরীক্ষার খাতা পরিবর্তন ইত্যাদি অসংখ্য দুর্নীতির করালগ্ৰাসে শিক্ষা। টাকা দিয়ে শিক্ষা কেনাবেচা চলছে। শিক্ষায় লাগামহীন বেসরকারিকরণ করে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে শিক্ষাকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার সমস্ত কৌশল নেওয়া হচ্ছে। এক দশক আগেও দরিদ্র পরিবারের মেধাবী ছেলেমেয়েদের বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চশিক্ষা, এমনকি ডাক্তারি পড়ার সুযোগও ছিল। এখন তা স্বপ্ন। ডাক্তারের সন্তান ডাক্তার হবে, উকিলের সন্তান উকিল হবে, আইএএস-এর সন্তান আইএএস হবে, রাজনীতিবিদের সন্তান মন্ত্রী হবে, এই যেন এখন নিয়ম! উচ্চবিত্তদের এলাকায় সাধারণের ‘প্রবেশ নিষেধ’ করার জন্য সরকারি শিক্ষার অধোগতি, শিক্ষার বেসরকারিকরণ! শিক্ষায় দুর্নীতি যে ভাবে বাড়ছে এবং যে গতিতে এগোচ্ছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে এর বিপদ দীর্ঘমেয়াদি। এর থেকে মুক্তির জন্য জনগণকে রাস্তায় নামতে হবে।
গৌতম পতি, তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর
খরচে অনীহা
শিক্ষা শুধু ব্যক্তির লাভ-ক্ষতির বিষয় নয়, এটার উপর দেশ ও জাতির সার্বিক উন্নয়ন নির্ভর করে। বিশেষ করে বনিয়াদি শিক্ষা বাজারের হাতে ছেড়ে না দিয়ে রাষ্ট্রের হাতে থাকা উচিত। উন্নত দেশগুলিতেও বনিয়াদি শিক্ষা প্রধানত সরকারের হাতেই রাখা হয়। ভারতের সংবিধানে ‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দটি থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন সরকারের শিক্ষাখাতে বাজেট বৃদ্ধিতে অনীহা দুঃখজনক।
অনেকেই জাত-ভিত্তিক কোটা থাকার ফলে মেধা বঞ্চিত হচ্ছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। জাতভিত্তিক সংরক্ষণ সামাজিক ন্যায় কিছুটা হলেও প্রতিষ্ঠা করে। অপর দিকে এই বাজারভিত্তিক ‘আর্থিক সংরক্ষণ’ (ধনীর জন্য উচ্চশিক্ষার সংরক্ষণ) মেধাকে বঞ্চিত তো করেই, তার সঙ্গে সামাজিক ন্যায় ধ্বংস করে। অথচ, এটাই সমাজ সাদরে গ্রহণ করছে। এমন ভাবে শিক্ষা শ্রেণিবিভক্ত হয়ে পড়েছে যে কোনও অংশই তার প্রতিবাদ করে না। আর সমাজে প্রতিবাদ না উঠলে রাজনীতিবিদরা সেটা নিয়ে ভাবেন না! তাই সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে থেকে প্রতিবাদ ওঠা দরকার।
অনিন্দ্য কুমার পাল, কলকাতা-৯৬
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy