Advertisement
০২ জুলাই ২০২৪
Radio

সম্পাদক সমীপেষু: মুক্তির সংবাদ

খুলনা শহর থেকে চল্লিশ মাইল দক্ষিণে কপোতাক্ষ নদ ঘেরা প্রত্যন্ত গ্রাম রাড়ুলিতে ছিল আমাদের চকমিলানো কড়ি-বরগার দালানবাড়ি।

শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০২৪ ০৬:৫৬
Share: Save:

স্নেহাশিস সুরের ‘মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট’ (২৫-৫) পড়ে পাঁচ দশক আগের সেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র সম্বন্ধে অনেক তথ্য জানা গেল। সেই টালমাটাল সময় আমাদের জীবনের উপর দিয়ে বয়ে গিয়েছিল, তাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম আয়ুধ এই ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ নিয়ে আমাদের যথেষ্ট কৌতূহল ছিল।

খুলনা শহর থেকে চল্লিশ মাইল দক্ষিণে কপোতাক্ষ নদ ঘেরা প্রত্যন্ত গ্রাম রাড়ুলিতে ছিল আমাদের চকমিলানো কড়ি-বরগার দালানবাড়ি। খুলনা-যশোরের বেনাপোল বর্ডার, বা কাছেই বুধহাটা, সাতক্ষীরা দিয়ে সহজেই এ-পার বাংলায় আসা যেত। বাবা ছিলেন স্থানীয় হাই স্কুলের বেশ জনপ্রিয় মাস্টারমশাই। কলকাতা থেকে কিনে এনেছিলেন চার ব্যাটারির এরিয়ল দেওয়া বড় মার্ফি রেডিয়ো। দোতলার রেলিংঘেরা চওড়া টানা বারান্দার টেবিলের উপর থাকত সেই রেডিয়ো। সারা দিনই কলকাতা ‘ক’-এর অনুষ্ঠান চলত, মাঝে মাঝে ঢাকা বেতারও ধরা হত। সত্তর সালের শেষ থেকে একাত্তরের প্রথমে শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও, সরকার গড়তে দেওয়া হল না। তখন থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের থেকে বন্ধনমুক্তি ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় দেশবাসী, বিশেষত তরুণ সমাজ উত্তাল হয়েছিল। বাবার পাশ-করা ছাত্ররা, যারা পরে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছিল, সামনের একতলার কাছারির ঘরে বসে বাবাকে বলত, “আমরা পাহারা দেব, আপনি ভিটেবাড়ি ছেড়ে যাবেন না।” কিন্তু ২৫ মার্চ, ১৯৭১ খবর পাওয়া গেল যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকায় বাঙালি নিধনযজ্ঞে মেতেছে। এর পর আমরা আর ঢাকা বেতার শুনতে পাইনি। এর আগে অবশ্য ঢাকা বেতারে শেখ মুজিবের সেই বিখ্যাত ভাষণ শুনেছিলাম, “এ লড়াই স্বাধীনতার লড়াই।”

হিন্দুপ্রধান গ্রাম থেকে অধিকাংশ পরিবার খোলা বর্ডার পেরিয়ে ও-পার বাংলায় চলে গেল। আমাদের পরিবার নিয়ে বাবা কিন্তু থেকে গেলেন। তখন পাকিস্তানি সেনার সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের জোর লড়াই চলছে। হঠাৎ আক্রমণ হলে আমাদের বিশাল বাড়ির কোন কন্দরে লুকিয়ে পড়তে হবে, তা ছোটদের বলে দেওয়া ছিল। তখনও যাঁরা গ্রামে ছিলেন, একমাত্র আমাদের বাড়িতে রেডিয়ো থাকাতে, খবর শুনতে চলে আসতেন। তখন শুধুমাত্র আকাশবাণীর কলকাতা ‘ক’-এ প্রণবেশ সেনের ‘সংবাদ পরিক্রমা’, উপেন তরফদারের ‘সংবাদ বিচিত্রা’ আর দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবেগকম্পিত কণ্ঠে যুদ্ধের খবর শুনতাম। শোনা গেল মুক্তিযোদ্ধাদের নিজস্ব বেতার কেন্দ্র, ‘স্বাধীন বাংলা বেতার’ শোনা যাবে। কিন্তু স্টেশন ধরলেও পরিষ্কার শোনা যেত না। মনে হয় লেখক-বর্ণিত ত্রিপুরা সীমান্তে সেই ট্রান্সমিটার ছিল। মাসখানেক পরে আমরা ‘স্বাধীন বাংলা বেতার’ পরিষ্কার শুনতে পেতাম, অর্থাৎ তখন কলকাতার ট্রান্সমিটার থেকে প্রচার চলছিল। তখন বলা হত, যশোর বর্ডারের কাছে এই ‘মুজিবনগর’ রেডিয়ো স্টেশন। কোথায় কেমন যুদ্ধ হচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধারা জিতে যাচ্ছে, সব খুঁটিনাটি তথ্য জানতাম এখান থেকেই। ‘চরম পত্র’ বিভাগটি জনপ্রিয় হয়েছিল, গানগুলি লোকের মুখে মুখে ফিরত। ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি/ মোরা একটি মুখের হাসির তরে অস্ত্র ধরি’, ‘তীরহারা ওই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে’ ইত্যাদি।

অগস্ট মাসে খুনিবাহিনী তিন দিকে নদী দিয়ে ঘেরা আমাদের গ্রামের উল্টো দিকে চলে এল। যে মুক্তিযোদ্ধারা গ্রাম পাহারা দিচ্ছিল, সামনাসামনি যুদ্ধে তারা মারা পড়তে লাগল। কোনও ক্রমে একটি নৌকা জোগাড় করে, নদীর অন্য পাশ দিয়ে সেই রাতেই বাবা আমাদের নিয়ে রওনা দিলেন। সারা রাত কপোতাক্ষ, কাটাখালি, ইছামতী নদীতে নৌকা চালিয়ে মাঝি আমাদের এ-পার বাংলায় পৌঁছে দিলেন।

শিখা সেনগুপ্ত, বিরাটি, উত্তর ২৪ পরগনা

দিশি বরফ

সায়ন্তনী সেনগুপ্তের ‘গরম থেকে বাঁচতেই চাহিদা বাড়ল বরফের’ (রবিবাসরীয়, ২৬-৫) প্রবন্ধের পরিপূরক হিসেবে এ চিঠি। সমাচার দর্পণ পত্রিকায় ৩০ জানুয়ারি, ১৮৩৬-এ ‘চুঁচুড়ায় বরফ’ সংবাদে বলা হয়, “স্কট সাহেবের গেজেটে প্রকাশিত এক পত্রে দৃষ্ট হইতেছে যে জানুআরি মাসের প্রথম ২০ দিবস পর্য্যন্ত চুঁচুড়ায় বরফকুণ্ডে ২১৮৬ মোন বরফ উৎপন্ন হইয়াছে এবং ঐ বরফ মোন করা ১০ টাকা অবধি ১৩ টাকা পর্য্যন্ত বিক্রয় হইয়াছে।” (ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সংবাদপত্রে সেকালের কথা, দ্বিতীয় খণ্ড ১৮৩০-১৮৪০, পৃ ৩৫৭)

স্থানীয় পদ্ধতিতে কী ভাবে তৈরি হত বরফ? প্রায় ১২০ ফুট লম্বা, ২০ ফুট চওড়া এবং ২ ফুট গভীর একটি গর্ত খোঁড়া হত। সূর্যের তাপে যখন মাটি শুকিয়ে যেত, তখন খড় দিয়ে ঠেসে ১ ফুট ভরে দেওয়া হত। এর উপরে আরও ৬ ইঞ্চি আলগা খড় দিয়ে তার উপরে ছোট কড়াইয়ের মতো যে পাত্রগুলিতে বরফ তৈরি করা হবে, সেগুলো পর পর বসানো হত। এর উপরে আবার খড় দেওয়া হত। এ ভাবে কয়েক দিন রেখে দিলে বরফ তৈরি হত। এ কথা তৎকালীন পত্রপত্রিকা থেকে মেলে।

আমেরিকার উদ্যোগপতি ফ্রেডেরিক টিউডরের রফতানি করা বরফ কলকাতায় আসার আগে (১৮৩৭) অবধি চুঁচুড়ায় তৈরি বরফই কলকাতার বরফের একমাত্র সরবরাহ ছিল। প্রথম দিকে এই বরফের প্রধান ব্যবহার ছিল ব্রিটিশ রাজপুরুষ এবং বাঙালি বাবুদের ‘ক্ল্যারেট ওয়াইন’ ঠান্ডা রাখার কাজে। কিন্তু শুধু বিলাসিতায় বরফের ব্যবহার সীমাবদ্ধ ছিল না। এর বিশেষ ভূমিকা ছিল চিকিৎসায়। ক্যালকাটা মান্থলি জার্নাল-এর একটি সংখ্যায় (১৮৩৮) দেখা যাচ্ছে, কলকাতায় ‘আমেরিকান আইস কমিটি’ তৈরি হয়েছিল। তাদের গৃহীত প্রস্তাবে দেখা যাচ্ছে, কলকাতা শহরের বেশ কিছু সংখ্যক প্রথম সারির চিকিৎসক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বরফের বিপুল গুরুত্বের কথা লিখিত ভাবে কমিটিকে জানিয়েছেন। ২২ জন চিকিৎসকের চিঠি কমিটির মিটিংয়ে পেশ করা হয়েছিল। তাঁদের মতে, জ্বর, প্রদাহ, মাথাব্যথা, গর্ভাশয় থেকে রক্তপাত-সহ নানা সমস্যার মোকাবিলায় বরফের কার্যকর ভূমিকা রয়েছে। তাই বরফ আমদানি করা এবং সুলভে বাজারে আনার জন্য সওয়াল করেছিলেন তাঁরা।

১৮৫২ সালে মেডিক্যাল কলেজের কৃতী ছাত্র সূর্য গুডিভ চক্রবর্তী এপিলেপ্সি নিয়ে তাঁর একটি গবেষণাপত্রে বলেন, তিনি নিজে এপিলেপ্সির ক্ষেত্রে বরফ ব্যবহার করে ইতিবাচক ফল পেয়েছিলেন। এ ভাবে সুদূর আমেরিকা থেকে রফতানি করা বরফ কলকাতায় পৌঁছে চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্যের কার্যকর হাতিয়ার হয়ে উঠল ১৮৩৩ থেকে ১৮৫২ সালের মধ্যে। এ এক কম জানা, চিত্তাকর্ষক ইতিহাস।

জয়ন্ত ভট্টাচার্য, রায়গঞ্জ, উত্তর দিনাজপুর

নেতার ধর্ম

‘৫০০০ ধীবরের রুজি আটকে গেল কন্যাকুমারীতে’ (৩১-৫) শীর্ষক প্রতিবেদনটি পড়ে বিস্মিত হলাম। মোদী বসেছেন ধ্যানে, বিবেকানন্দ রকের পাঁচ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে মৎস্যজীবীদের মাছ ধরা বন্ধ থাকবে কেন? ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। সংবিধান কোনও ধর্মকে বিশেষ মর্যাদা দেয় না। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের জনপ্রতিনিধিরা সরকারি ব্যবস্থাপনায় হামেশাই মঠ-মন্দিরে বা দরগা-গির্জায় ঢুকে পড়েন। তাঁরা ব্যক্তিগত ভাবে নিজের খরচে ধর্মাচরণ করুন, কিন্তু প্রকাশ্যে সরকারি খরচে তা করবেন কেন?

পাঁচ হাজার মৎস্যজীবীর জীবিকা দু’দিন ধরে অচল করা নির্মম এবং অনভিপ্রেত। তা ছাড়া কন্যাকুমারীর বিবেকানন্দ রকের যে স্থানে সাধারণ পর্যটকদের ছবি তোলা নিষেধ, সেখানে প্রধানমন্ত্রীর পদচারণা ও ধর্মীয় আচার যে ভাবে টিভিতে এসেছে, তাতে বোঝাই যায় উন্নত মানের একাধিক ক্যামেরা বসিয়ে, পুরো চলচ্চিত্র গ্রহণের পরিকাঠামো সেখানে ঢুকিয়ে নেওয়া হয়েছে। এই যে প্রধানমন্ত্রীর আড়ম্বরপূর্ণ ধ্যানের আয়োজন, তাঁর সদলবলে যাওয়া-আসা এবং কয়েক হাজার পুলিশ মোতায়েন, সমস্ত খরচ নিশ্চয়ই রাষ্ট্রের? এটাই দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখায়।

সাধন বিশ্বাস, কৃষ্ণনগর, নদিয়া

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bangladesh Liberation War Bangladesh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE