সুমিত চক্রবর্তীর ‘রাষ্ট্র হিংস্র, দেশ নয়’ (১৬-৬) প্রবন্ধটি ব্যক্তি ‘আমি’-র মানবিক উত্তরণের দিশা দেখায়। আমাদের চেতন মনে কোথাও একটুখানি জায়গা রাখা প্রয়োজন ওই নিপীড়িত মানুষদের জন্য। হোক তার জাতি-ধর্ম-বর্ণ আলাদা, হোক তার রাষ্ট্র আলাদা, তবুও। এ বিশ্বে প্রতি মুহূর্তে দাঙ্গা, যুদ্ধ, রাষ্ট্রীয় দমনপীড়নের বলি হচ্ছে অগণিত জীবন, আত্মীয়-পরিজন, ঘরবাড়ি, ভিটেমাটি! দিকে-দিকে বাস্তহারা বুভুক্ষু মানুষদের অসহায় আর্তরবে বাতাস আজ ভারী! একটু কান পাতলে, আর চোখ মেললে তা উপলব্ধ হয়। প্রতি দিনের রোজনামচায় সমব্যথার কোমলতায় আমাদের মানবিক পরিসরে একটুও কি ওদের স্থান দিতে পারি না? পারি, অবশ্যই পারি। আর যখন পারি, তখনই এক জন মানুষ একটা দেশ হয়ে যায়।
কয়েক দিন আগে সমাজমাধ্যমে একটি পোস্টার দেখেছিলাম— “আজ যখন তুমি ক্লাসে যাবে, স্মরণে রেখো যে গাজ়ায় আর কোনও বিশ্ববিদ্যালয় নেই।” পোস্টারটি দেখে এক অদ্ভুত বিষণ্ণতার আঁধারে ডুবে গিয়েছিলাম। আপন বিদ্রোহী সত্তা অজানতেই গর্জে উঠেছিল— আর নয়, এ বার বন্ধ হোক এই যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা, বন্ধ হোক রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন। অন্নহীন ঘরহারা গাজ়া অধিবাসীদের কাছে শিক্ষা আজ অলীক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ঘরবাড়ি হাসপাতাল, সমস্তই আজ ধ্বংসস্তূপ! কত যে সম্ভাবনাময় মেধা এমন ভাবে যুদ্ধের গোলাবারুদে ছাই হয়ে গেল, তার খবর কে রাখে!
জানি, একক প্রতিবাদ-প্রতিরোধ অত্যাচারী রাষ্ট্রের চরিত্র বদলাতে পারবে না, তবুও প্রতিবাদী সত্তাকে জাগিয়ে রাখা জরুরি। না হলে মানুষ আর অন্য জীবের যে কোনও প্রভেদ থাকে না। পৃথিবীর অপর প্রান্তে অত্যাচারিত মানুষদের সহনাগরিক ভেবে তাদের দুঃখ-কষ্টে বিচলিত হওয়া আমাদের জন্মগত ক্ষমতা হওয়া উচিত। কেননা এই সহমর্মী বোধই আমাদের সংগঠিত করে, নতুন করে জেগে উঠতে শেখায়। চোখের দৃষ্টির সঙ্গে মনের দৃষ্টি মিলিয়ে বৈশ্বিক ভাবনায় নিজেকে অন্বিত করতে না পারলে আমরা আরও একলার কোটরে সেঁধিয়ে যাব। তখন কিন্তু নৈরাশ্যের আঁধারে তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। তাই সহজে কাউকে প্রতিপক্ষ না ভেবে, সহমর্মীর সখ্যে তার ভিতরের মঙ্গলকে জানার চেষ্টা করি। এই চেষ্টাই আমাদের প্রধান বল-ভরসা।
শুভ্রা সামন্ত, বালিচক, পশ্চিম মেদিনীপুর
কার কণ্ঠ?
আমাদের এলাকায় লোকসভা ভোটের দিন ছিল ২০ মে। তার এক সপ্তাহ আগে থেকে প্রায় প্রতি দিন মোবাইল ফোনে নির্বাচন কমিশনের নানা বার্তা পেয়েছি। একটি বার্তা ছিল, “আপনার ভোট আপনার কণ্ঠস্বর।” আমার ভোটটা আমি দিলাম, অতীতেও বহু বার ভোট দিয়েছি। কিন্তু আমার কণ্ঠস্বর এখনও পর্যন্ত এক বারও শুনতে পাইনি। প্রথমত, ভোটের দিনপঞ্জি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বড়, মেজো, সেজো বিভিন্ন মাপের নেতা-মন্ত্রীর কণ্ঠস্বর কানে আসতে লাগল। যতই ভোট এগিয়ে আসতে লাগল, ততই পথসভা, রোড শো, বিভিন্ন মাপের সভা-সমাবেশ থেকে তাঁদের কণ্ঠস্বর ক্রমেই জোরালো হতে লাগল। কিন্তু কেউই তো আমার কণ্ঠস্বর (মানে সাধারণ মানুষের বক্তব্য) শোনার আগ্রহ দেখালেন না! তা হলে আমার কণ্ঠস্বর বাজল কোথায়?
দ্বিতীয়ত, ভোটের দিন বুথে প্রবেশ করে প্রথম পোলিং অফিসারকে আমার সচিত্র পরিচয়পত্র দেখালাম। তিনি তা যাচাই করে ভোটার তালিকা থেকে আমার নাম ও ক্রমিক সংখ্যা বার করলেন। তার পর সজোরে তা উচ্চারণ করলেন এজেন্টদের উদ্দেশে। ওই পোলিং অফিসারের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। তার পর আঙুল কালিমালিপ্ত করে ভোটকক্ষে প্রবেশ করলাম, এবং পছন্দের প্রার্থীর পাশের বোতামটি টিপলাম। সঙ্গে সঙ্গে ‘বিপ’ ধ্বনি শুনতে পেলাম, অর্থাৎ ভোটযন্ত্রের কণ্ঠস্বর। আমার কণ্ঠস্বর তো শুনতে পেলাম না।
তৃতীয়ত, এত কিছু ভেবে যে প্রার্থী তথা দলকে ভোটটা দিলাম, তিনি যে আগামী পাঁচ বছর জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমার কণ্ঠস্বর তাঁর কণ্ঠের মাধ্যমে উপযুক্ত জায়গায় পেশ করবেন, তার তো কোনও নিশ্চয়তা নেই। তিনি দলবদল করে অন্য দলে চলে গেলে আমার কণ্ঠস্বরটাও তো তাঁর কণ্ঠ থেকে তখনই ‘ডিলিট’ হয়ে যাবে।
প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ, কোনও ভাবেই যে কোনও ভোটারের কণ্ঠস্বর কোথাও পৌঁছবে না, তা সকলেই হাড়ে হাড়ে জানেন। পরাজিত প্রার্থীদের যাঁরা ভোট দিয়েছেন, সেই ভোটারদের কণ্ঠস্বর তো তখনই থেমে যায়। কিন্তু যাঁরা জয়ী, তাঁদের মাধ্যমে কি ভোটারদের কথা আইনসভায় পৌঁছয়? ভোটারদের কণ্ঠস্বর আইনসভায় পৌঁছতে গেলে তো সমস্ত নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির অন্ততপক্ষে ৯০% হাজিরা থাকা দরকার। তার পর বলার ইচ্ছা, দলীয় বাধ্যবাধকতা, বলার সুযোগ পাওয়া, ইত্যাদি অনেক রকম বাধাবিপত্তি আছে। কাজেই ‘আপনার ভোট, আপনার কণ্ঠস্বর’ বাক্যটি নিতান্তই রাষ্ট্রীয় উপহাস নয় কি?
ইন্দ্রনীল ঘোষ, লিলুয়া, হাওড়া
বিবেকহীন
স্বাতী ভট্টাচার্যের ‘মেয়েদের কথার মূল্য’ (২২-৫) শীর্ষক প্রবন্ধ পড়ে মনে হল, রাজনৈতিক প্রতিশোধস্পৃহা চরিতার্থ করতে নারীকে পণ্য করতে এখন আর কোনও রাজনৈতিক দলের বিবেকে বাধে না। প্রতিদ্বন্দ্বী দু’টি দলের বিবাদে ক্ষমতার আধিপত্য দেখাতে, বা প্রতিশোধ নিতে, মেয়েদের যৌন নিগ্রহ এখন দস্তুর। অভিযোগ উঠলে ধর্ষিতা ও ধর্ষকের পক্ষ গ্রহণ করে বিবদমান দুই দল। অভিযোগ অস্বীকার করেও স্বস্তি নেই, চলে ধর্ষিতার চরিত্র বিচার। সন্দেশখালি কাণ্ডেও দেখা গেল, অভিযোগকারিণী অর্থের বিনিময়ে মিথ্যা অভিযোগ করেছেন, যৌন অপরাধের দায় ঝেড়ে ফেলতে এই কাহিনি নির্মাণের উদ্দেশ্যে ভিডিয়ো ভাইরাল করে দেওয়া হল সমাজমাধ্যমে। কিন্তু সেগুলি তদন্তকারী সংস্থাকে দেওয়া হল না। ভারতীয় সাক্ষ্য আইনের ৬৫(খ) ধারা, কিংবা তথ্যপ্রযুক্তি আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় স্পষ্ট বিধান আছে, কী ভাবে এ রকম ভিডিয়োতে সম্প্রচারিত তথ্য সাক্ষ্য হিসেবে আদালতে গ্রাহ্য হতে পারে। দেশের শীর্ষ আদালতও এই ধরনের ইলেকট্রনিক মাধ্যমে রক্ষিত তথ্য সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহারের পূর্বশর্ত হিসেবে ভিডিয়োটি যে জাল নয়, সেই মর্মে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের শংসাপত্র দাখিল বাধ্যতামূলক করেছে। সে সবের পরোয়া না করে রাজনৈতিক সুবিধা তোলার উদ্দেশ্যে একটি ভিডিয়োকে অপ্রয়োজনীয় গুরুত্ব আরোপ করে শোরগোল শুরু হল, ভোটের ঠিক প্রাক্কালে ভোটারদের প্রভাবিত করতে।
যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেওয়া হয় যে ভিডিয়োগুলি জাল নয়, তা হলেও প্রশ্ন থাকে। বহু নির্যাতিতা মহিলা থানায় এসে এবং সিবিআই-এর কাছে যৌন হেনস্থা-সহ বিভিন্ন নির্যাতনের অভিযোগ করেছেন। কোনও কোনও অভিযোগকারিণী আদালতে এসে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় দেওয়া গোপন জবানবন্দি দিয়েছেন। ভিডিয়োতে কোনও এক দলের মণ্ডল সভাপতির বক্তব্যের ভিত্তিতে কি এ সবই মিথ্যে হয়ে যাবে? প্রতিপন্ন হবে যে, ওই মহিলারা সকলেই অর্থের বিনিময়ে মিথ্যে অভিযোগ করেছিলেন? অভিযোগের যথাযথ তদন্তের পর বিচারের জন্য আদালতে আসার আগেই রাজনৈতিক মোড়লরা ঠিক করে দিচ্ছেন, কোনটা ঠিক কোনটা নয়। কে সত্যবাদী কে মিথ্যেবাদী। ইতিমধ্যে নিগৃহীতা মহিলাকে মানসিক নিগ্রহের শিকার হতে হয় সমাজে, অভিযোগের সত্যতার পক্ষে ব্যাখ্যা ও কৈফিয়ত দিতে দিতে।
নিজের সামাজিক সম্মানহানির ঝুঁকি নিয়েও এক জন মহিলা ধর্ষণের মতো একটি গর্হিত অপরাধের অভিযোগ প্রকাশ্যে আনেন বিচারের আশায়। তাই প্রশাসনিক প্রধানের মন্তব্যে বাড়তি সতর্কতা, দায়িত্ববোধ ও সংবেদনশীলতা বাঞ্ছনীয়।
শান্তনু রায়, কলকাতা-৪৭
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy