Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪

সম্পাদক সমীপেষু: কবির রাজনীতি

সুভাষবাবুর কবিতা ছত্রে-ছত্রে সমাজের অন্যায় বৈষম্য আর কদর্য ভণ্ডামির দিকে আঙুল তোলে, শোষিত মানুষের পাশে থাকার উজ্জ্বল অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়।

শেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০১৮ ০০:০২
Share: Save:

কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জন্মশতবর্ষের শ্রদ্ধার্ঘ্যে সৌরীন ভট্টাচার্য (‘এক চুলে মাত’, ১৩-২) লিখেছেন, ‘কবিতার রাজনীতি আর কবির রাজনীতি গুলিয়ে ফেলার দরকার নেই। যদিও তা আমরা হামেশা গুলিয়ে ফেলি।’ অর্থাৎ লেখকের মতে, কবিতার রাজনীতি এবং কবির রাজনীতি দুটি ভিন্ন জিনিস, পাঠক বা সমালোচকের অবস্থান থেকে তাদের এক করে দেখা বা মিলিয়ে বিচারের চেষ্টা না করাই শ্রেয়। সহমত হতে পারলাম না। কবি নিজের জীবনে সচেতন বা অচেতন ভাবে যে-রাজনৈতিক বিশ্বাস বা দর্শন নিয়ে চলেন, তাঁর কবিতাতেও সেই দর্শনই প্রতিফলিত হয় না কি? এই প্রতিফলন সব সময় একমাত্রিক বা সরলরৈখিক নাও হতে পারে। কবি মননের সঙ্গে বিদ্যমান সমাজবাস্তবের দ্বন্দ্ব, সমাজ-পরিবেশের নিজস্ব ঘাত-প্রতিঘাত যে-ভাবে কবিকে নাড়া দেয়, তাঁর চিন্তাজগতের পরিবর্তন বা পরিণতি ঘটায়, সেই গতিশীলতা নানা ভাবে ধরা পড়তে পারে কবিতায়। আজ কবি অনাগত দিনকে কবিতায় যে-ভাবে আঁকছেন, সেই ছবি বদলে যেতে পারে কবির রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তনের সঙ্গে-সঙ্গে। কিন্তু একটি বিশেষ মুহূর্তে কবি যে-কবিতাটির জন্ম দিচ্ছেন, তার সঙ্গে কোনও না কোনও ভাবে কবির তৎকালীন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সাদৃশ্য থাকে এবং পাঠকও কবিতার রাজনীতির মধ্য দিয়ে, কবির রাজনীতিকে, কবির মনকে ছুঁতে চান, খুঁজে পেতে চান। শুধু কবিতা নয়, যে-কোনও শিল্পকর্মের ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য। ঋত্বিক ঘটক বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে রবীন্দ্রনাথের একটি কথা বারবার উদ্ধৃত করেছেন, ‘শিল্পকে সবার আগে সত্যনিষ্ঠ হতে হয়, তার পরে সৌন্দর্যনিষ্ঠ।’ কবির রাজনীতি আর কবিতার রাজনীতি আলাদা হয়ে গেলে এই সত্যনিষ্ঠার প্রশ্নে বিচ্যুতি আসবেই, আর কোথাও না কোথাও সে ফাঁকি ধরাও পড়বে।

সুভাষবাবুর কবিতা ছত্রে-ছত্রে সমাজের অন্যায় বৈষম্য আর কদর্য ভণ্ডামির দিকে আঙুল তোলে, শোষিত মানুষের পাশে থাকার উজ্জ্বল অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়। শিল্পগুণকে এতটুকু ক্ষুণ্ণ না করে তাঁর প্রেরণা-জাগানো কবিতারা যে সুস্পষ্ট রাজনৈতিক অভিমুখ নির্দেশ করে, কবির রাজনৈতিক চেতনা আর কবিতার রাজনীতির একাত্মতা ছাড়া তা কি সম্ভব? কোন পরিস্থিতিতে কী কারণে তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানে কতটা পরিবর্তন এসেছিলা, তা কতটা অভিপ্রেত ছিল, এগুলো নিয়ে আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু তাঁর জীবন ও কবিতা সাধারণ মানুষের দুঃখ-বেদনার সঙ্গে নিবিড় সংযোগ রেখেই চলতে চেয়েছে। জন্মশতবর্ষে মনে রাখা দরকার পদাতিক কবির আকাঙ্ক্ষা— ‘আমাকে কেউ কবি বলুক আমি চাই না। কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যেন আমি হেঁটে যাই।/ আমি যেন আমার কলমটা ট্র্যাক্টরের পাশে নামিয়ে রেখে বলতে পারি— এই আমার ছুটি— ভাই, আমাকে একটু আগুন দাও’।

সঙ্ঘমিত্রা চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা-৭৭

হিন্দুধর্মের রূপ

• আমার ‘হিন্দুধর্ম কী ও কার’ (৭-৩) চিঠিটির প্রেক্ষিতে স্নেহময় দাসের ‘খণ্ড খণ্ড করবেন না’
(১৮-৩) চিঠি প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর লেখার ভিত্তিতে কয়েকটি বিনীত মন্তব্য। তিনি লিখেছেন, ধর্ম বদলের জন্য স্বীকৃত সংস্থার কথা ওঠে কী করে। এই জন্যই ওঠে, মুসলিম বা খ্রিস্টধর্মে কেউ ধর্মান্তরিত হলে তাঁদের নাম/ পদবি বদলে নিতে হয়, কোনও ভাবে মসজিদ বা স্থানীয় চার্চের সঙ্গে যোগ রাখতে হয়, নইলে তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয় না। কোনও ধর্ম গ্রহণ করলে, সেই ধর্মের মূলস্রোতে থাকতে গেলে অন্য ধর্মের ক্ষেত্রে এই ‘পালনীয়’গুলো আছে, কিন্তু হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিতকে আলাদা করে স্বীকৃতি জানানোর কোনও সংস্থা নেই, তাই কোনও বিশেষ ভুঁইফোঁড় সংগঠন এই অভিভাবকত্বের ঠিকা নিতে পারে না, আমার বক্তব্যের মূল স্পিরিটটা এই। স্মরণ করতে হবে, আমি যা লিখেছিলাম তার কেন্দ্রে ছিল একটি ধর্মান্তরকরণের অনুষ্ঠান, যে অনুষ্ঠানের বৈধতাকে আমি প্রশ্ন করেছি, এখনও করছি।

রামকৃষ্ণ মিশনের দাবি সুপ্রিম কোর্টে আইনি স্বীকৃতি না পেলেও তাঁরা নিজেদের পৃথক একটা অস্তিত্ব হিসাবেই ভাবেন, এটা তাঁদের প্রচারিত বিভিন্ন পত্রিকা, বই খুঁজলেই জানা যায়। এ-কথা ঠিক যে আলাদা করে ‘সনাতনী হিন্দুধর্ম’ কী তার কোনও মানচিত্র পাওয়া যাবে না, কিন্তু ‘সনাতনী’ শব্দের মধ্যে যে ব্যঞ্জনা, তা থেকে একটা আভাস পাওয়া সম্ভব। স্কুলপাঠ্য বইয়েও লেখা থাকে ‘সনাতনী হিন্দুধর্মের’ কুপ্রথার বিরুদ্ধে রামমোহন বা বিদ্যাসাগর লড়াই করেছিলেন।
এ-ক্ষেত্রে পড়ুয়াদের যা বোঝানো হয়, সেটাই না হয় ধরা যাক।

বিবেকানন্দ তাঁর শিকাগো বক্তৃতায় হিন্দুধর্মকে প্রকারান্তরে ‘মাদার অব রিলিজিয়নস’ বলেছেন, কিন্তু এর কোনও ঐতিহাসিক ও নৃতত্ত্বগত সমর্থন নেই। আর্য সভ্যতার থেকেও পুরনো সভ্যতার সন্ধান পেয়েছে মানুষ, সেই সময়ে কোনও ধর্মবোধ ছিল না এমন কোনও নিশ্চিত প্রমাণ আদৌ নেই— তা ছাড়া আর্য সভ্যতার উপাদান হিসাবে যদি বেদ উপনিষদকে ধরা হয়, সেখানে পৌত্তলিকতার স্থান নেই, অথচ হিন্দুধর্ম মূলগত ভাবে পৌত্তলিক। মনে রাখা দরকার, শিকাগো মহাসভায় স্বামীজি হিন্দুধর্মের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন, সেখানে নিজের ধর্মকে মহান হিসাবে প্রতিপন্ন করার দায় তাঁর ছিল, সেইটাই স্বাভাবিক।

একই ভাবে, তিনি বৌদ্ধ ধর্মমতকে যে-ভাবে হিন্দুধর্মের শাখা বলে উল্লেখ করেছেন (তাঁর বক্তৃতা ‘বৈদিক ধর্মাদর্শ’: রচনাবলি তৃতীয় খণ্ড) তাও একটি ইতিহাসবিরোধী বক্তব্য। হিন্দুধর্মের সংকীর্ণতা ও আচার-সর্বস্বতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে একটি জীবনচর্যা তৈরির অভিপ্রায়েই বৌদ্ধধর্মের উৎপত্তি, যেখানে কোনও পৌত্তলিক ঈশ্বর নেই।
আর হিন্দুধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম যে পরস্পর প্রতিস্পর্ধী ছিল তার সব থেকে বড় প্রমাণ বৌদ্ধধর্মের বিকাশে আতঙ্কিত হিন্দুদের নানা বৌদ্ধমঠ ও শিবির আক্রমণ ও ধ্বংস করা। অনেক ভাষাবিদের মতে ‘ধ্বংস স্তূপ’ শব্দটি সেই আগ্রাসনের সাক্ষ্য বহন করছে। আগ্রাসী বৌদ্ধধর্মবিরোধী হিন্দুত্ব নিয়ে লেখা রবীন্দ্রনাথের বহুপঠিত কবিতা ‘পূজারিণী’ সেই হিংসার এক মানবিক আলেখ্য (মূল ‘অবদানশতক’-এ এই কাহিনি আছে)।

প্রবুদ্ধ বাগচী

কলকাতা-৫২

জিরাফের ভাষা

• শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় গড়ানে বয়সের মানুষের বিপন্নতার কথা লিখেছেন (‘এই একা হওয়া...না তো!’, ২১-৩)। নিস্তব্ধতা বোঝাতে জীবনানন্দীয় উটের প্রসঙ্গ এসেছে তাঁর লেখায়। প্রসঙ্গটি গভীরজ্ঞানে ছোঁয়া যায় ভাস্কর চক্রবর্তীর ‘জিরাফের ভাষা’তেও। নাগরিক জীবনের একাকিত্বকে, অবসাদগ্রস্ততার যন্ত্রণাকে ছুঁয়েছেনে দেখার এক মরমি কবিপ্রতিভা ছিল ভাস্করের। নিঃসঙ্গতা, অবসন্নতা কিংবা মৃত্যুটান নিয়ে একের পর এক লাইন লিখেছেন তিনি। বিষণ্ণতাকে জীবনের অংশ বলে গ্রহণ করতে হবে, কিন্তু তাকে বাড়তে দেওয়া যাবে না— এ-ধরনের এক প্রত্যয়ভূমিই কি গড়তে চেয়েছিলেন তিনি? নয়তো লিখবেন কেন, ‘যে দিন এসেছে তাকে বুঝে নাও, তার সঙ্গে বসবাস করো।’ একই বইতে লিখেছেন, ‘বিষণ্ণতা ছিল আমি মাথায় চড়তে দিইনি তাকে’। শুধু প্রৌঢ়জীবন কেন, এ-সময়ের স্বার্থপরতার কালিমায় প্রতিটি জীবন ধস্ত হচ্ছে। তাই, ‘‘এখন ঘরের মধ্যে প্রেতের মতন বেঁচে থাকা /একটা জীবন থেকে আরেকটা জীবন কত দূর...’ আমরা কেউ কারো নই’, ভাবতে ভাবতে, দিন ফুরিয়ে গেল।’’ হোক প্রেতের জীবন, তবু তো বাঁচতে হবে— এ-প্রত্যয় ঘোষণা করতেই কবিকে লিখতে হয়: ‘শান্ত হও সুমঙ্গল, শোনো, দুঃখ না যায় যদি বা/ছাত থেকে লাফ দেবে? দু-একশো ঘুমের বড়ি খাবে?/এ কি একটা কথা হলো? এ কেমন তোমার হৃদয়?’ নাগরিক জীবনে একাত্মতা কিংবা পারস্পরিকতার বোধের প্রায় নির্বাসন ঘটে গেছে— এ-সময় ‘জিরাফের ভাষা’য় জীবন খুঁজে নেওয়া যায়।

শিবাশিস দত্ত

কলকাতা-৮৪

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা

সম্পাদক সমীপেষু,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,কলকাতা-৭০০০০১।

ই-মেল: letters@abp.in

যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়

অন্য বিষয়গুলি:

Subhash Mukhopadhyay Poet Politics
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy