ঘুগনি।
সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে, সম্ভবত ১৯৭৩ সালে একটি সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল— নতুন দিনের আলো। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, অনুপকুমার প্রমুখের অভিনয়ে জমজমাট অজিত গঙ্গোপাধ্যায় পরিচালিত ছবিটি বেশ জনপ্রিয় হয়। সৌমিত্র সেখানে এক শিক্ষিত বেকার যুবক, চাকরির চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে শেষে ঠিক করেন নিজের মতো করে ব্যবসা করবেন। অতঃপর মমতাময়ী বড়বৌদির কল্যাণে কিছু টাকা জোগাড় হল, ফেরিঘাটের কাছে চা বিস্কুট ইত্যাদির দোকান দেওয়া হল। তার পর অনেক নাটক এবং অতিনাটকের পথে ব্যবসার চড়াই উতরাই পার হয়ে ইচ্ছাপূরণ। কিন্তু সাফল্যের উপকরণ হিসাবে যে বস্তুটি উজ্জ্বল ভূমিকা নিল, তার নাম ‘মিনু পিস’। মিনু ছবির একটি চরিত্রের নাম, আর পিস (পিজ়) হল ঘুগনি। হ্যাঁ, ঘরে তৈরি ঘুগনি বেচেই বাঙালি যুবক লক্ষ্মী লাভ করল, চার দিকে ধন্য ধন্য পড়ে গেল, ঘরে-বাইরে যারা ব্যঙ্গবিদ্রুপ করেছিল তাদের থোঁতা মুখ ভোঁতা হয়ে গেল। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ঘুগনি শিল্পের কথা বলে সেই ছবির স্মৃতি ফিরিয়ে দিলেন। অর্ধ শতক আগে যা ছিল সিনেমার সত্য, আজ বুঝি নতুন দিনের আলোয় তা জীবনের সত্য হয়ে উঠবে।
শিখর মিত্র, কলকাতা-৫২
অনিশ্চিত কাজ
সারা দেশে যখন বেকারত্ব বাড়ছে, কর্মসংস্থান কমছে, রাজ্যে বিরোধীরা যখন নতুন শিল্পের অভাব ও বেকারত্ব নিয়ে নিরন্তর কটাক্ষ করে চলেছেন, তখন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করলেন যে, কাউকে কাজের জন্য রাজ্যের বাইরে যেতে হবে না, চাকরি হবে বাড়ির কাছেই। বাংলায় ‘দুয়ারে সরকার’, ‘দুয়ারে রেশন’-এর মতো ‘দুয়ারে চাকরি’ চালু হবে, এটা উৎসাহিত করার মতো খবর। মুখ্যমন্ত্রী সকল শিল্পপতিকে বাংলায় আরও বেশি করে বিনিয়োগ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।
তবে একটা বক্তব্য এই যে, মুখ্যমন্ত্রী যে সব কর্মসংস্থান ও শিল্পের কথা বলেছেন, তা সবই বেসরকারি সংস্থানির্ভর। কোনও সরকারি প্রকল্প বা উদ্যোগের কথা বলা হয়নি। এটা কিছুটা হলেও নিরাশাজনক। বেসরকারি সংস্থাগুলিতে বেতন বা অন্যান্য সুবিধা বেশি হলেও সেখানে চাকরির নিশ্চয়তা নেই, নেই পেনশন। ফলে বেশির ভাগ তরুণ-তরুণীই চান সরকারি চাকরির নিরাপত্তা। চপ শিল্প, চা শিল্প বা টিভি সারানোর কাজে ক’জনই বা নিযুক্ত হবেন, কতটাই বা কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে বা বেকারত্ব কমবে? তা ছাড়া ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখে চা ও চপ শিল্পে, বা টিভি সারানোর কাজে নিযুক্ত হয়ে সংসার চালাবে, এমন চিন্তা মোটেও সুখকর নয়। সরকারের পক্ষেও তা মোটেই প্রশংসার যোগ্য নয়। এমন উদ্ভট ধারণার বদল হওয়া উচিত।
মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেছেন, ৯০ লক্ষ এমএসএমই ইউনিটে তথা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে প্রায় ১.৩৬ কোটি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। গত ১১ বছরে কিন্তু ৯০ লক্ষ ইউনিট তৈরি করা হয়নি। এর অর্ধেকেরও বেশি বাম আমলে হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী এ ব্যাপারে পূর্ণ কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন না। তা ছাড়া ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্পের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের আয়ের সম্ভাবনা ভাল নয়, জীবিকাও সুনিশ্চিত নয়।
পঙ্কজ সেনগুপ্ত, কোন্নগর, হুগলি
কচুরিপানা
রাজ্যের বেকার সমস্যার সমাধানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিল্পভাবনা চমৎকার! কচুরিপানার বালিশ, কাশফুলের বালাপোশ, চা, ছোলা-বাদাম, ঝালমুড়ি, চপ শিল্প— এ সব করার জন্যই কি বাংলার ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করছে? এখানে কাজ কোথায় যে, মুখ্যমন্ত্রী বাইরে যেতে বারণ করছেন? ভুয়ো নিয়োগপত্র, শিক্ষাঋণ অমিল, সর্বগ্ৰাসী দুর্নীতি, মিথ্যা প্রলোভন, পঙ্কিল রাজনীতিতে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশা শেষ। তৃণমূল শাসনের ১১-১২ বছরে ক’টা শিল্প হয়েছে? চপ শিল্প দিয়েই কি এগোবে বাংলা?
শিবপদ চক্রবর্তী, কাঁচরাপাড়া, উত্তর ২৪ পরগনা
অলীক স্বপ্ন
‘উৎকর্ষ বাংলা’ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে যা ঘটল, তা এক শ্রেণির বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং এবং পলিটেকনিক কলেজের ‘মোডাস অপারেন্ডি’র কথা মনে করায়, যাদের উপযুক্ত শিক্ষক এবং পরিকাঠামো নেই (“বিলি ‘ভুয়ো’ নিয়োগপত্র, প্রশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ”, ১৬-৯)। গালভরা বিজ্ঞাপন দিয়ে কলেজগুলি ছাত্র টানার চেষ্টা করে। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ বা জয়েন্ট এন্ট্রাস পরীক্ষার শেষের দিকে র্যাঙ্ক করা ছাত্রছাত্রী এদের সহজ শিকার। কলেজগুলির হালহকিকত জেনে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলি ক্যাম্পাস থেকে নিয়োগ এড়িয়ে চলে। কলেজ কর্তৃপক্ষের ‘হাতযশ’-এ দু’-একটা কোম্পানি যে চাকরির অফার লেটার দেয়, তার জন্য ইঞ্জিনিয়ারিং বা পলিটেকনিক পড়ার দরকার হয় না। আবার এমনও দেখা যায়, অফার লেটারই সার, নিয়োগপত্র অধরা। সরকারি মঞ্চে এ ধরনের ঘটনা একেবারেই অনভিপ্রেত। বেকার ছেলেমেয়েরা ওই দিন মুখ্যমন্ত্রীর ‘দুয়ারে চাকরি’র আশ্বাসে কতটা আশ্বস্ত হয়েছেন, জানা নেই। তবে কারিগরি শিক্ষায় প্রশিক্ষিত ছেলেমেয়েরা ঝালমুড়ি, ঘুগনি, চা বা তেলেভাজা বিক্রি করে সফল ব্যবসায়ী হবেন, এমন যে স্বপ্ন দেখানো হল, তাতে তাঁদের প্রশিক্ষণই বৃথা!
ধীরেন্দ্র মোহন সাহা, কলকাতা-১০৭
চা সংস্কৃতি
‘সেই সাধনা আর নিষ্ঠা কই’ (১১-৯) শীর্ষক প্রবন্ধের প্রেক্ষিতে কিছু তথ্যের সংযোজন। উনিশ শতকে ভারতে চা চাষের প্রচলন হয়, চা বাগানের ইংরেজ মালিক কর্তৃক শ্রমিক নির্যাতনও শুরু হয় প্রথম থেকেই। তারা স্থানীয় জনসমাজ থেকে শ্রমিক সংগ্রহ না করে দূরের ছোটনাগপুর, বিহার, উত্তরপ্রদেশ থেকে দরিদ্র আদিবাসীদের ভুল বুঝিয়ে আড়কাঠি মারফত আনত। স্থানীয় শ্রমিকদের কাজে নেওয়ার দাবি তোলায় জনৈক অসমিয়া চা বাগানের মালিক মণিরাম দত্ত বরুয়াকে ফাঁসি দেয় (১৮৫৭)। অপর দিকে, আড়কাঠি মারফত সংগৃহীত চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের বলা হত ‘গিরমিটি কুলি’। শব্দটি সম্ভবত শ্রমিকদের পরিভাষায় ‘এগ্রিমেন্ট’-এর অপভ্রংশ বলে মনে হয়। ১৮৫৭ সালে দক্ষিণাচরণ চট্টোপাধ্যায় রচিত চা-কর দর্পণ নাটকে চা-কুলিদের উপর শ্বেতাঙ্গ কর্তাদের অত্যাচার বিধৃত। ব্রাহ্মধর্মের প্রচারক রামকুমার বিদ্যারত্ন সরেজমিনে অসম ঘুরে এসে, চা বাগানের কুলিদের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা দেখে সঞ্জীবনী পত্রিকায় ‘কুলীকাহিনী’ প্রকাশ করেন, যা হ্যারিয়েট বিচার স্টো-র আঙ্কল টম’স ক্যাবিন-এর সমতুল্য। এই সব খবর পড়ে বাংলার জনসমাজ চা-কে বলতে শুরু করল ‘কুলির রক্ত’। ১৯২১ সালে গান্ধীজি শিলচর আসেন। তাঁর অসহযোগ আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হয়ে, চা শ্রমিকেরা বাগান ছেড়ে বিনা অনুমতিতে ঘরে ফেরার পথ ধরেন। এ সময়ে তাঁদের মাইনে ছিল ৬ টাকা। নানা অজুহাতে কেটে নেওয়ার পর আড়াই টাকার বেশি থাকত না। অথচ, তখন চালের দাম ছিল টাকায় পাঁচ সের। চা বাগান ফেরত কুলিরা গান্ধীজির জয়ধ্বনি দিয়ে যখন চাঁদপুরের (বর্তমানে বাংলাদেশে) স্টিমার ঘাটে আসেন, ভারতীয় চাষ সমিতির প্রতিনিধি ও স্থানীয় মহকুমা শাসকের নির্দেশে সশস্ত্র গোর্খাবাহিনী রাতে গুলি চালায় (১৯২১)। অনেক চা শ্রমিক মারা যান। চা-কর (ছদ্মনাম) চা-বাগানের কাহিনী বইতে (ভূমিকা লিখেছেন সাগরময় ঘোষ) অনুযোগ করেছেন, জালিয়ানওয়ালা বাগ-এর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ইতিহাসে লেখা থাকে, কিন্তু চাঁদপুর-এর হত্যাকাণ্ড থাকে উপেক্ষিত। চা কুলিদের পরিস্থিতি ধরা রয়েছে লোকগানের কথাতেও। আজও চা শ্রমিকরা মজুরি, রেশন, বোনাস, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার দাবিতে আন্দোলন করেন।
আশিস ত্রিপাঠী, অশোকনগর, পশ্চিম মেদিনীপুর
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy