—প্রতীকী ছবি।
সীমন্তিনী মুখোপাধ্যায়ের লেখা, ‘কেন চেয়ে আছ, গো মা’ (২১-১০) শীর্ষক প্রবন্ধে চার পাশের চেনা ছবি দেখলাম। ঠিকই, মেয়েদের দিবারাত্র শ্রমের যেন কোনও মূল্য নেই! নিজেদের বঞ্চিত করে তাঁরা এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মে সেবা নামক অমূল্যায়িত শ্রম দান করে যাচ্ছেন। আমার শহুরে মায়ের গ্রামে বিয়ে হওয়াতে সেখানকার কাজকর্ম শিখে নিতে হয়েছিল। বাড়ির পিছন দিকে একটি পুকুর ছিল। অনেক সময় দেখেছি, লোহার কড়াইতে সোডা, বল সাবান কুচি করে দিয়ে জামাকাপড়, বিছানার চাদর, সুতির মশারি ইত্যাদি কাঠের উনুনে জ্বাল দিয়ে, ঠান্ডা হলে সেই ভারী কড়াই কাঁখে করে পুকুরে গিয়ে কেচে নিয়ে আসতেন। বাড়ির দুর্গাপুজোর কাজেকর্মে অতিরিক্ত পরিশ্রমে, ষষ্ঠী-অষ্টমীর উপবাসে পুজোর পরে মা অসুস্থ হয়ে পড়তেন। শীতকালে বয়সজনিত কারণে ঠাকুরমা যখন মৃত্যুশয্যায়, তাঁর কাঁথা-চাদর ওই পুকুরের ঠান্ডা জলে কেচে, ডুব দিয়ে মা স্নান করে আসতেন। এর ফলে মা মাঝে মাঝে গুরুতর অসুস্থ হতেন। প্রাইমারিতে পড়া ছোট মেয়ে আমাকে তখন ভাতের হাঁড়ি উপুড় দিতে হত।
আমরা অনেকগুলো ভাইবোন। দাদার পরেই আমি। কাজেই ছোট ভাইবোনদের আমারই কোলে-কাঁখে নিয়ে বেড়াতে হত। আমার প্রাইমারি স্কুলের এক দিদিমণি, যিনি আমার মায়ের বন্ধু ছিলেন, এক বিকেলে শুনি মাকে বলছেন, “ভাইবোনদের সব সময় কোলে-কাঁখে করে ও তো আর বাড়তে পারছে না, তা ছাড়া ও পড়াশোনা করবে কখন?” এই ধরনের চিত্র এক প্রজন্ম আগে কমবেশি সব বাড়িতেই ছিল। এখনও অবস্থা তেমন কিছুই পাল্টায়নি। মায়েরা, মেয়েরা সংসারের যাবতীয় বোঝা টানবে, এটাই যেন স্বাভাবিক নিয়ম। নিম্নবিত্তদের অবস্থাটা আরও করুণ। বাজারের ফুলবিক্রেতা দিদির ছোট মেয়েটি মায়ের সঙ্গে ফুল বিক্রি করে। তার দাদা স্কুলে পড়ে, সে পড়ে না। আনাজ বিক্রি করা মহিলাটি সেই ভোর থেকে আনাজের ঝুড়ি নামিয়ে সারা দিন আনাজ বিক্রি করেন, অকর্মণ্য স্বামী ও ছোট ছেলেমেয়ের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করার জন্যে। কিছুটা টাকা বাঁচিয়ে তাদের পুজোয় জামাকাপড় দেন, কিন্তু তাঁকে দেওয়ার কেউ নেই। আমি তাঁকে একটা নতুন সুতির ছাপা শাড়ি দেওয়াতে তাঁর চোখের কোণটা চিকচিক করে ওঠে। আমার বাড়ির কাজের মাসি বহু কাল আগে থেকেই আমাদের মফস্সল এলাকা থেকে কাঠকুটো কুড়িয়ে জড়ো করে, লোকাল ট্রেনে করে বয়ে নিয়ে যান সংসারের জ্বালানির প্রয়োজনে। মেয়েদের এই কঠিন অমূল্যায়িত শ্রমে তাঁদের নিজেদের কোনও সুরাহা হচ্ছে না। এই ভাবে বঞ্চিত হওয়ার বিরুদ্ধে তাঁদের নিজেদেরও ভাবার সময় এসেছে।
শিখা সেনগুপ্ত, বিরাটি, উত্তর ২৪ পরগনা
মূল্যের বিচার
সীমন্তিনী মুখোপাধ্যায়ের প্রবন্ধটি পড়তে পড়তে আমার জন্মদাত্রী মায়ের কথা মনে পড়ল। ‘জন্মদাত্রী মা’ বললাম, কারণ আমরা জেঠিমা, কাকিমা, এই শব্দগুলির পিছনেও ‘মা’ ব্যবহার করি। তাঁরা মায়েরই সমতুল্য। আমার ছোটবেলায় আমাদের একান্নবর্তী পরিবার না থাকলেও, জেঠামশাই, কাকামশাই তাঁদের পরিবার নিয়ে একই বাড়িতে পাশাপাশি ঘরে বসবাস করতেন।
স্কুলজীবনে আমি জন্মদাত্রী মায়ের খুব কাছাকাছি থেকেছি। আমরা পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে আমি ছিলাম সবচেয়ে বড়। বাকিরা সকলে বোন। মায়ের বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করার জন্য আমারই ডাক পড়ত। আমাদের বাড়িতে সেই সময় বারো মাসে তেরো পার্বণ লেগে থাকত। কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর কয়েক দিন আগে থেকেই নারকেলের নাড়ু বানানো হত। নারকেলের ছোবড়া ছাড়ানো থেকে, নারকেল কোরা, নারকেলের নাড়ু পাকানো, সব কাজই মায়ের সঙ্গে আমি করেছি। কলাগাছের খোল থেকে কলাবৌ এবং খোলার নৌকা বানানো, তা-ও মায়ের পরিচালনায় করেছি। বিভিন্ন পার্বণে দেখেছি মা, জেঠিমা, কাকিমা, সকল মা মিলে তাঁদের নাওয়া, খাওয়া ভুলে উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে ও সঠিক ভাবে পার্বণগুলি সম্পন্ন করতে। তাঁরা এই কাজগুলিকে একান্ত ভাবে নিজেদের কাজ বলে মনে করতেন, এবং প্রশান্তি অনুভব করতেন এটা ভেবে যে, এতে পরিবারের মঙ্গল হবে।
আমি তখন মনে মনে ভাবতাম, মায়েরা বুঝি এ রকমই হন। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার পরিণত বুদ্ধিতে আমি বুঝেছি, তাঁদের এই পরিশ্রমের যথাযথ মর্যাদা তাঁরা পাননি।
দিনকাল পাল্টেছে। মেয়েরা যথেষ্ট লেখাপড়া শিখে নিজেদের প্রতি সচেতন হয়েছে, শ্রমের মর্যাদা বুঝতে শিখেছে। ঘরে ও বাইরে নিজেদের পাওনা-গন্ডা নিজেরাই বুঝে নেওয়ার মতো ক্ষমতা তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি অবশ্য বিপরীত চিত্রও আছে। এখনও মেয়েরা এই সমাজে অনেক ক্ষেত্রেই অবহেলিত। যথেষ্ট শিক্ষার অভাব এবং আর্থিক ও সামাজিক দিক থেকে দুর্বলতা এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। এর থেকে বেরিয়ে আসতে গেলে, মেয়েরা, যে সামাজিক অবস্থানেই থাকুন না কেন, তাঁদের স্বাবলম্বী হওয়া ছাড়া আর কোনও পথ নেই বলে আমার বিশ্বাস। তার জন্য মেয়েদেরই এগিয়ে আসতে হবে। নিজেদের যোগ্যতা অনুসারে যোগ্য কাজ নিজেদেরই খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে এবং শ্রমের মর্যাদা বুঝতে হবে। পরনির্ভরশীল হয়ে বেঁচে থাকা যায়, কিন্তু তার মধ্য দিয়ে মর্যাদাবোধ জাগ্রত হয় না।
পরিশেষে এ কথাটা বলতেই হয়, পুরাতন সব কিছুই খারাপ, আর নতুন সব কিছুই ভাল, তা কিন্তু নয়। পুরাতনের ভালটা নিয়ে নতুনের ভালর সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটাতে হবে। আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধি এবং অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে এটুকু বুঝেছি যে, সাবেক দুর্গাপ্রতিমা যেমন এখনও থিম-প্রতিমার পাশাপাশি সমাদৃত, তেমনই আগেকার দিনে মায়েরা আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁদের শ্রম দিয়ে যে পুজো-পার্বণের অনুষ্ঠান সমাধা করতেন, তার কোনও মূল্য বিচার করা যায় না। কারণ সেটি অমূল্য।
সন্তোষ কুমার দে, হাওড়া
পুরুষের দোষ?
সীমন্তিনী মুখোপাধ্যায়ের পুরুষবিদ্বেষী উত্তর-সম্পাদকীয়টি পড়লাম। পুরুষশাসিত সমাজে সাংসারিক যন্ত্রণাময় জীবনে সব দোষ শেষ পর্যন্ত এসে পড়ে পুরুষের ঘাড়ে। এমনকি দুর্গাপুজোর চার দিন তাঁদের পুজোর এবং তার সঙ্গে সংসারের ব্যস্ততাময় জীবনের চাপের জন্য পুরুষকেই দায়ী করা হয়। পুরুষের মানবিক বোধের অভাবের জন্যই নাকি মেয়েদের জীবনে অমূল্যায়িত শ্রমের আধিক্য, উৎসবের আলোও তাতে ম্লান হয়। কিন্তু প্রবন্ধকার কি জানেন না, এ দেশে সবচেয়ে ধর্মভীরু সম্প্রদায় হচ্ছে নারী সম্প্রদায়? বাঙালি নারীরা তার ব্যতিক্রম নন। তেত্রিশ কোটি দেবতার পুজো নিয়ে তাঁরা সারা জীবন মেতে থাকেন। বাড়ির ষষ্ঠীপুজো থেকে দুর্গাপুজো তাঁদের বারো মাসের কাজ। পুজোর ব্যস্ততার মধ্যেও তাঁরা ঠিকমতো সংসার সামলান।
আবার চার দিনের দুর্গাপুজোতে দেখা যায় যে, সকাল থেকে বাড়িতে কিংবা মণ্ডপে পুজোর ফুল জোগাড় থেকে শুরু করে অষ্টমীতে উপোস করে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়া, নবমীতে ধুনুচি নাচ, ও দশমীর দিন দেবীকে বরণ করে সিঁদুর খেলায় মেতে ওঠা, ঢাকের তালে নেচে বিসর্জন, প্রভৃতি ব্যাপারে মেয়েরা ব্যস্ত। পুরুষের উপস্থিতি উপলক্ষমাত্র। তার মধ্যে থেকেও বাড়ির ছেলে-মেয়ে, কর্তা, অতিথিদের বিভিন্ন রকমের রান্না করে খাওয়ানোর আবদার শুধু মেটান না, বাড়ির কর্তা ঠিকমতো চা পেল কি না, শ্বশুরমশাই প্রেশারের ওষুধটা খেলেন কি না প্রভৃতি নিয়ে তাঁরা সর্বদাই সজাগ ও সচেতন। এই পরিষেবার মধ্যে তাঁদের আত্মতৃপ্তি ঘটে। ক্ষোভ নয়!
এই ভাবেই তাঁরা মুখ বুজে সংসারের অন্যায়, অসাম্য ও বঞ্চনাকে হাসিমুখে অস্বীকার করে সংসারকে সুখী করে তুলছেন। তাই তো তাঁরা আজ সংসারের কারও চোখে মাতৃরূপিণী দুর্গা, আবার কারও চোখে সর্বজয়া।
তপন কুমার বিদ, বেগুনকোদর, পুরুলিয়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy