কাজী নজরুল ইসলাম। —ফাইল চিত্র।
‘ভাগ হয়ে গেছে নজরুল?’ (৫-১২) শীর্ষক প্রবন্ধে সেখ সাহেবুল হক যে প্রশ্নটি রেখেছিলেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে এই চিঠির অবতারণা। নজরুলের ইসলামি গান ও শ্যামাসঙ্গীত কেন সমস্ত বাঙালির মধ্যে সমান ভাবে জনপ্রিয় হল না? প্রথমে ইসলামি গানের সম্পর্কে বলি। নজরুল তাঁর গানে যে উর্দু, আরবি, ফারসি শব্দগুলি ব্যবহার করেছেন, সেগুলি সম্পূর্ণরূপে ইসলামি সংস্কৃতির অঙ্গ। খুব স্বাভাবিক ভাবেই পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বাঙালি (বা বহু ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমানও) ইসলামের সংস্কৃতির সঙ্গে সে ভাবে পরিচিত হতে পারেননি বা চাননি। শ্যামাসঙ্গীতের কথা যদি বলি, ধর্মীয় চেতনার আমূল সংস্কারের যে আন্দোলন রামপ্রসাদ তাঁর শাক্ত পদাবলির মাধ্যমে শুরু করেছিলেন, নজরুল সেই ধারাকেই বহন করেছেন। বৈষ্ণব রসশাস্ত্রের ‘বাৎসল্য’ রসকে আশ্রয় করে দেবীর উগ্রতাকে কোমল করে ঘরের মেয়ে করে তুলেছিলেন কবিরঞ্জন রামপ্রসাদ সেন। এর প্রভাব যে নজরুলের ইসলামি সঙ্গীতে পড়েনি, নিশ্চিত করে বলতে পারি না। পরবর্তী কালে মুকুন্দদাস, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বঙ্কিমচন্দ্রের কলমে দেবী হয়ে ওঠেন দেশমাতৃকা। নজরুলের ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি পড়লেই বোঝা যাবে। নজরুল প্রকৃত অর্থেই ‘শক্তি’-র সাধনা করেছেন তাঁর শাক্ত পদাবলিতে। দেশের চরম সঙ্কটের সময়ে গানগুলি প্রেরণা দিয়েছে। কৃষ্ণ বিষয়ক গানগুলির ক্ষেত্রেও কবি বাংলার চিরাচরিত কীর্তনের পরম্পরাকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তাঁর গানে কীর্তনের অনুরূপ ‘তালফেরতা’-ও লক্ষ করা যায়। ফলে বাংলার প্রাচীন সংস্কৃতির চর্চা হলে স্বাভাবিক ভাবেই কাজী নজরুল ইসলামের চর্চা তো হবেই। যেমন দৃঢ় ভাবে বলা যায় যে, নজরুলই বাংলার শেষ সার্থক শাক্ত পদাবলিকার। ইসলামি সঙ্গীতের পরম্পরা বাংলায় সে-অর্থে কখনও ছিল না। মহাত্মা ফকির লালন সাঁই ও তাঁর পরবর্তী বাউল-ফকির মহাজনেরা যা লিখেছেন, সেগুলি সহজিয়া ভাবের গান, ইসলাম তাদের স্বীকার করেনি। নজরুলের ভক্তিমূলক গান যেমন সব জনপ্রিয় হয়নি বা সবাই মেনে নেননি, নজরুলের ইসলামি গানও তেমন সব বা সর্বত্র জনপ্রিয় হয়নি।
শুভদীপ সাহা কলকাতা-৩৬
সবার কবি
মানবতাবাদী নজরুল সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে ছিলেন। তাঁর লেখায় আমরা বার বার সেই পরিচয় পাই। তিনি লিখেছেন, “‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?/ কান্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র।” ‘মানুষ’ কবিতায় লিখলেন, “তব মসজিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবি,/ মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি।” নিজের সম্বন্ধে লিখলেন, “কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেউ বলেন কাফের। আমি বলি ও দুটোর কোনটাই না। আমি শুধু হিন্দু মুসলিম গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি।” নজরুল সমস্ত বাঙালির কবি। কিন্তু বাঙালি তাঁকে নিয়ে কম টানাটানি, কম ভাগাভাগি করেনি। পূর্ব পাকিস্তান আমলে সেখানে নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত নিষিদ্ধ হয়েছিল। সেখানকার স্কুলপাঠ্য বইতে নজরুলের কবিতার লাইন, “নব নবীনের গাহিয়া গান/ সজীব করিব মহাশ্মশান”-কে পাল্টে “সজীব করিব গোরস্থান” লেখা হয়েছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এ-পার বাংলার সরকারের উদাসীনতায় তাঁকে ও-পার বাংলায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। মৃত্যুর পরে তাঁর পিতৃভূমি চুরুলিয়ায় তিনি সমাধিস্থ হতে পারেননি।
দেশাত্মবোধক, প্রেম, বিরহের গানের পাশাপাশি নজরুল অনেক শ্যামাসঙ্গীত ও ইসলামি সঙ্গীত লিখেছিলেন। সব গান পরিচিতি পায়নি বা সমান জনপ্রিয় হয়নি। প্রবন্ধকার ঠিকই বলেছেন, নজরুলের সর্বধর্মসমন্বয়ের চেষ্টা ‘সবার’ হয়ে ওঠেনি। গান জনপ্রিয় হওয়ার জন্য তৎকালীন গ্রামোফোন রেকর্ডের যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী, যিনি জ্ঞান গোসাঁই নামে অধিক পরিচিত ছিলেন, নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত রেকর্ড করেন। লোকের মুখে মুখে ফিরতে লাগল সে গান, ‘বল্ রে জবা বল্—/ কোন্ সাধনায় পেলি শ্যামা মায়ের চরণতল”, বা “কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন”। ১৯২৬ সালে নজরুল ইসলাম কৃষ্ণনগরে বিশিষ্ট বিপ্লবী হেমন্ত সরকারের বাড়িতে বেশ কিছু দিন সপরিবারে থাকেন। সেখানে সে বছর তিনি কালীপুজো করেন। গান লেখেন, “মোর লেখাপড়া হল না মা/ আমি ম দেখিতেই দেখি শ্যামা/ আমি ক লিখিতেই কালী বলে/ (মা) নাচি দিয়ে করতালি।”
আরও যত শ্যামাসঙ্গীত লিখেছিলেন তিনি, সব কিন্তু জনপরিচিতি পায়নি। গায়ক আব্বাসউদ্দিনের বিশেষ অনুরোধে নজরুল লিখলেন ইসলামি সঙ্গীত। সে রেকর্ডের গানও তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল। মানুষ পথেঘাটে গাইতে লাগলেন, “ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ” বা “আমিনা-দুলাল নাচে হালিমার কোলে।” যে সব ইসলামি গান সাধারণ মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছিল, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে তা কিন্তু আজও মানুষ আনন্দের সঙ্গে গান। আজ থেকে অর্ধশতকেরও বেশি সময় আগে আমার মা আমাদের ভাইবোনদের ঘুম পাড়াতেন, “তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে/ মধু পূর্ণিমারই সেথা চাঁদ দোলে”— এই গান গেয়ে। এই তো ক’দিন আগে আমার গৃহসহায়িকা কাজ করতে করতে গাইছিল, “এই সুন্দর ফুল সুন্দর ফল মিঠা নদীর পানি/ খোদা তোমার মেহেরবাণী।” তাঁকে জিজ্ঞাসা করাতে তিনি জানালেন এটা কার লেখা গান তা তিনি জানেন না। এ ভাবেই নজরুল ‘সবার’ কবি হয়ে উঠেছেন। আর তাঁর লেখা ‘কারার ঐ লৌহকপাট’-এর সুর বিকৃতিতে যে ভাবে অধিকাংশ বাঙালি গর্জে উঠেছেন, সেখানে আশার আলো দেখা যায় যে, ভেদাভেদ ভুলে নজরুলের সৃষ্টি নিয়ে যে কোনও অপকর্মের জোর প্রতিবাদ হবেই।
শিখা সেনগুপ্ত বিরাটি, উত্তর ২৪ পরগনা
বিভেদ কেন
‘ভাগ হয়ে গেছে নজরুল?’ প্রসঙ্গে সবিনয়ে জানাতে চাই, নজরুল গীতির প্রসঙ্গ এলে সংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গবাসীর স্মরণে আসে তাঁর কালজয়ী দেশাত্মবোধক, প্রেম-বিরহের গানের পাশাপাশি ‘কালো মেয়ের পায়ের তলায়’ জাতীয় ভক্তিগীতি। তাঁদের মনে পড়ে না, বা অজানিতই থাকে নজরুল রচিত প্রায় তিনশো ‘ইসলামি সঙ্গীত’গুলোর কথা। প্রবন্ধকার এই বিস্মরণের আবহে অপ্রত্যাশিত বিভাজন-রেখা টেনেছেন, যা বিস্মিত করল।
স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, নজরুলের ‘ইসলামি’ সঙ্গীতে ব্যবহৃত ‘হামদ’, ‘নাত’ ইত্যাদি শব্দ আমাদের অপরিচিত। সবিনয়ে বলি, নজরুল স্বয়ং কি ওই তিনশো গানকে ‘ইসলামি সঙ্গীত’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন? উপরন্তু জিজ্ঞাস্য, রমজান বা রোজার মাসে ব্যবহৃত গান, পয়গম্বর হজরত মহম্মদের মর্তে আগমন সম্পর্কিত ‘প্রবল জনপ্রিয়’ গানগুলো অবধারিত ভাবে এই বঙ্গেও মুসলমান সমাজ গেয়ে থাকেন, সাধারণ জলসায় বা পুজো প্যান্ডেলে সেগুলো না বাজলেই কি আমাদের গান বনাম তাহাদের গান সম্পর্কিত বিভেদ ঘটে? আরও প্রশ্ন, মুসলমান রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী যখন দরদ দিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘পূজা’ পর্যায়ের গান পরিবেশন করেন, কোনও যথার্থ উদারচেতা মুসলমান সঙ্গীতপ্রেমী কি বলেন, ও সব হিঁদুদের ঠাকুরের গান, ও সব না গাওয়াই শ্রেয়? কিছু শব্দবন্ধে মুসলমানদের গান বা হিন্দুদের গানের বিভেদ রচনা কি উচিত?
সংস্কৃতিপ্রিয়-বাঙালির কি বিভাজন হয়? নজরুলের গান নিয়ে তারা কি আমরা-ওরার অসুখে ভোগে? অবশ্যই স্বীকার্য, নজরুলের ‘মাগো চিন্ময়ী রূপ ধরে আয়’ বা ‘হে গোবিন্দ রাখো চরণে’ গানের আবেদন ছুঁয়ে যায় সর্ব ধর্ম-বর্ণ-বিভেদ মুছে দিয়ে। কিন্তু, এ কথা কখনও মনে আসে না যে, নজরুল হিন্দু এবং মুসলমান বাঙালির জন্য ভিন্ন ধর্মীয় গান রচনা করেছেন। সখেদে বলতে চাই, এ ভাবে ভাবনার কারণেই ‘আমরা ওরা’র বিভাজন সৃষ্টি হচ্ছে।
সতত রহস্যময় এক পুরুষ, নাগরিক শিক্ষা বঞ্চিত, অভাব অনটনে বেড়ে ওঠা, ব্রিটিশদের ‘বাঙালি ফৌজে’ যোগদান, হিন্দু-পুরাণ কাব্যের প্রতি গভীর অনুরাগ, বিভিন্ন ভাষায় পারদর্শী, রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রিয়, চির-অস্থির মনোভাবাপন্ন নজরুলকে জানা যায় ভিন্ন ভাবে ‘নয়ন জলে ভেসে’ প্রবন্ধে (সায়ম বন্দ্যোপাধ্যায়, দেশ, ১৭-৭-২০২২)। অনুরোধ, এই অস্থির সময়ে নজরুল গীতিকে নিয়ে অকারণ-বিভাজন করবেন না। তাতে বিপদের সম্ভাবনা।
ধ্রুবজ্যোতি বাগচী কলকাতা-১২৫
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy