সুমিত মিত্রের “মাটিটাই ‘অগণতান্ত্রিক’?” (২০-৭) পড়ে মনে দু’টি প্রশ্ন জাগল— ১) আমেরিকান তথ্যবিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান ‘পিউ রিসার্চ সেন্টার’-এর সমীক্ষাতে যে প্রশ্নমালা ব্যবহৃত হয়েছে, তার সব প্রশ্ন কি ত্রুটিমুক্ত? ২) ভারতীয়রা এই ধরনের প্রশ্নগুলোর উত্তর ঠিক ভাবে দেন?
যে কোনও সমীক্ষার প্রশ্নগুলো এমন হওয়া উচিত, যা শুনে মনে হয় না যে, উত্তরগুলো কোনও নির্দিষ্টমুখী হতে বাধ্য। এই ধরনের প্রশ্নকে বলা হয় ‘লোডেড কোয়েশ্চেন’, যার মানে আকাঙ্ক্ষিত উত্তর পাওয়ার উদ্দেশ্যে এই ধরনের প্রশ্ন করা হয়। ওই প্রশ্নগুলোকে যদি অন্য ভাবে জিজ্ঞেস করা হত, তবে অন্য উত্তর পাওয়া যেত। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। পিউ সমীক্ষায় এক ধরনের প্রশ্ন ছিল— “ধর্মীয় কারণে কি কোনও রকম বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়?” এই প্রশ্নটা সব সম্প্রদায়ের মানুষকে করা হয়েছে। এবং এর উত্তরে প্রায় সবাই “না” বলেছেন। কিন্তু এই প্রশ্নটা যদি অন্য আকারে করা যেত, যেমন— “চাকরিবাকরি বা জমি/বাড়ি কেনার ক্ষেত্রে কি কোনও বৈষম্যের সম্মুখীন হতে হয়?”, সে ক্ষেত্রে হয়তো অন্য উত্তর পাওয়া যেত। দ্বিতীয়ত, ভারতীয়রা সাধারণত এই ধরনের সমীক্ষার প্রশ্ন এড়িয়ে যায়, নয়তো মনগড়া উত্তর দেয়, যার মধ্যে সত্যের যথার্থ প্রতিফলন হয় না।
এই দুই বিষয়কে একেবারেই গ্ৰাহ্যের মধ্যে না আনা হলে ওই ধরনের সমীক্ষার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাবে বর্তমানে ভারতের যা অবস্থা, তাতে মুসলিম সম্প্রদায়ের খুব কম অংশই মনের কথা প্রকাশ্যে বলবে। ধরা যাক, বাড়ি ভাড়ার কথা। দিল্লি বা অন্য জায়গার হিন্দু পল্লিতে মুসলিমদের বাড়ি ভাড়া পাওয়া স্বপ্নের মতো। এ কথা এক জন হিন্দু ও এক জন মুসলমান উভয়ই জানেন, কিন্তু মুখে অন্য কথা বলবেন। এক জন বলবেন সম্ভবত ভয়ে, অপর জন বলবেন সেকুলারিজ়মের কথা মাথায় রেখে, কারণ ভারতকে এখনও হিন্দু রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করা হয়নি। একে নকল বা বড়জোর ব্যবহারিক সেকুলারিজ়ম বলা যেতে পারে। তাই পিউ রিসার্চ রিপোর্ট অনুসারে, ৪৫ শতাংশ হিন্দু যখন বলেন যে, আশপাশে কে বাস করছেন, তা নিয়ে তাঁরা চিন্তিত নন, সেটা সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য নয়।
অনেকের মতে, ভারত এখন আধা ফ্যাসিস্ট দেশ হয়ে গিয়েছে। উগ্ৰ জাতীয়তাবাদ ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। বিশেষত মুসলিমদের প্রতি এখনও যে সহিষ্ণুতা দেখানো হচ্ছে, তা প্রধানত ভোট ব্যাঙ্কের কথা ভেবে। তাই পিউ সার্ভেতে হিন্দু ছাড়া অন্য সম্প্রদায়, বিশেষ করে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ ভয়জনিত কারণে ভুল তথ্য দিতে বাধ্য হয়েছেন। আর হিন্দুরা সমালোচিত হওয়ার ভয়ে ভুল তথ্য দিচ্ছেন। তা সত্ত্বেও, এই সমীক্ষা প্রয়োজনীয়, যা আমাদের নানা কাজে লাগতে পারে।
অশোক বসু, বারুইপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
সাম্য-মৈত্রী
সুমিত মিত্রের লেখাটির প্রসঙ্গে বলতে চাই, ভারতের সংবিধানের খসড়া কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন ভীমরাও রামজি আম্বেডকর। তিনি বলেছিলেন, ভারতে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে আসন্ন পথের বাধাগুলিকে চিহ্নিত করতে হবে সর্বপ্রথম। কারণ, সংবিধান সুদৃঢ় ভিত্তির উপর দণ্ডায়মান রয়েছে জনসাধারণের আনুগত্যের দ্বারা।
আম্বেডকর বলেছিলেন, জাতীয়তাবাদ জাতিকে ভালবাসতে শেখায়, অপর জাতির প্রতি শ্রদ্ধা বোধ জাগ্রত করতে সাহায্য করে। কিন্তু সঙ্কীর্ণতা ভ্রাতৃত্ববোধের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা। ভারতে বসবাসকারী প্রত্যেক ভারতীয়কে একমাত্র ভারতীয় বলে অনুধাবনের কথা তিনি বলতেন। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের মূল বাণী— সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতাকে তিনি সংবিধান রচনার সময় অধিকতর গুরুত্ব দান করেছিলেন। আম্বেডকরের মূল লক্ষ্য ছিল, ভারতের সমাজব্যবস্থার সর্বস্তরে সাম্য প্রতিষ্ঠা করা। শ্রেণিহীন ও শোষণহীন সমাজব্যবস্থা কাম্য বলে তিনি মনে করতেন।
বর্তমানে শুধু ভারতবর্ষে নয়, সারা বিশ্বে সাম্প্রদায়িক হানাহানি, জাতিভেদ, বর্ণপ্রথার বাড়বাড়ন্ত। এই পরিস্থিতিতে সংবিধানের অন্যতম রূপকার আম্বেডকরের সাম্য, মৈত্রী ও সৌভ্রাতৃত্বের আদর্শ বিশ্ববাসীর কাছে অতি প্রাসঙ্গিক।
সৌপ্তিক অধিকারী, সোনারপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
বিচ্ছিন্ন
সুমিত মিত্র লিখিত প্রবন্ধের প্রেক্ষিতে কিছু কথা। ‘সুবিচারের অধিকার’ (১৮৯৪) প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “অনেক হিন্দুর বিশ্বাস, বিরোধ মিটাইয়া দেওয়া গবর্মেন্টের আন্তরিক অভিপ্রায় নহে। পাছে কংগ্রেস প্রভৃতির চেষ্টাতে হিন্দু-মুসলমান ক্রমশঃ ঐক্যপথে অগ্রসর হয় এই জন্য তাঁহারা উভয় সম্প্রদায়ের ধর্ম বিদ্বেষ জাগাইয়া রাখিতে চান এবং মুসলমানের দ্বারা হিন্দুর দর্পচূর্ণ করিয়া মুসলমানকে সন্তুষ্ট এবং হিন্দুকে অভিভূত করিতে ইচ্ছা করেন।”
হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় (১৯১১) প্রবন্ধে বলেছেন, “হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সকল দিক দিয়া একটা সত্যকার ঐক্য জন্মে নাই বলিয়াই রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাহাদিগকে এক করিয়া তুলিবার চেষ্টায় সন্দেহ ও অবিশ্বাসের সূত্রপাত হইল। এই সন্দেহকে অমূলক বলিয়া উড়াইয়া দিলে চলিবে না। আমরা মুসলমানকে যখন আহ্বান করিয়াছি তখন তাহাকে কাজে উদ্ধারের সহায় বলিয়া ভাবিয়াছি, আপন বলিয়া ডাকি নাই। যদি কখনো দেখি তাহাকে আর কাজের জন্য দরকার নাই তবে তাহাকে অনাবশ্যক বলিয়া পেছনে ঠেলিতে আমাদের বাধিবে না। তাহাকে যথার্থ আমাদের সঙ্গী বলিয়া অনুভব করি নাই। আনুষঙ্গিক বলিয়া মানিয়া লইয়াছি।”
ধর্মের ছোবল এড়িয়ে হিন্দু-মুসলমান দু’টি সম্প্রদায় কোনও দিন মিলিত হতে পারবে কি না, এ বিষয়ে সংশয়দীর্ণ মনে কবি আমৃত্যু চিন্তা করেছেন। দুই সম্প্রদায়ের এইরূপ ভিত্তিভূমিতে দাঁড়িয়েই দেশ স্বাধীন হয়েছে। বাবাসাহেব আম্বেডকর রচনা করেছেন সংবিধান। অথচ, দ্বিধাদ্বন্দ্বের শিকড়টি দেশের মানুষের মন থেকে কোনও দিনই উপড়ে ফেলা যায়নি। গণতন্ত্রের আস্তরণে অগণতান্ত্রিক জমিটিকে বার বার ঢেকে ফেলার চেষ্টা হয়েছে, অথচ এ দেশে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ ‘সেপারেটলি টুগেদার’ হয়েই বাস করতে চেয়েছেন। দেশের রূপকারদের এক সময় মনে হয়েছিল, রাষ্ট্র যদি সব ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধাশীল হয়, তা হলে সাম্প্রদায়িক বিচ্ছিন্নতা কমবে। কিন্তু আদতে তা হয়নি। প্রবন্ধকারের উল্লিখিত সমীক্ষার পরিসংখ্যানগুলি রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় হিন্দু-মুসলিম পারস্পরিক সম্পর্কের বাতাবরণটিকেই আরও প্রতিষ্ঠিত করে। অর্থাৎ, হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের সুরটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র চিরকালই উদাসীন এবং অন্য দিকে দুই জাতির মানসিকতায় গেঁথে থাকা অন্য ধর্মকে ‘আনুষঙ্গিক’ বলে ধরে নেওয়া দেশের ‘অগণতান্ত্রিক’ মাটিটাকেই জোরদার করেছে। সামাজিক সম্প্রীতির প্রেক্ষিতে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই কোনও দিন পরস্পর পরস্পরকে দোসর হিসেবে মনে করেনি। আর রাজনীতির মানুষরা চিরকালই এই মানসিক বিরোধের জমিটি শক্ত রেখে বিদ্বেষের বিষ ক্রমাগত বপন করে চলেছেন। সম্প্রীতির রাখি বাঁধতে না পারা গণতন্ত্রের শূন্য হাতগুলিতে কেবলই স্ফুলিঙ্গের জন্ম দিয়েছে। স্বাধীনতার ৭৫ বছরের ইতিহাসেও ভারতীয়রা যা বহন করে চলেছেন।
সঞ্জয় রায়, দানেশ শেখ লেন, হাওড়া
হিন্দি (ল্যাটিন)
লেখাটিতে সুমিত মিত্র ‘পিউ’-এর করা একটি সমীক্ষা উল্লেখ করে লিখেছেন— “৫৯ শতাংশ হিন্দুর মতে হিন্দিজ্ঞান হল ভারতীয়ত্বের দ্যোতক।” কয়েক দিন আগে ইউটিউবে ভিডিয়ো আপলোড করতে গিয়ে দেখছিলাম, ভিডিয়োর ভাষা নির্বাচন করার যে বিকল্পগুলি গুগল কর্তৃপক্ষ দিয়েছেন, তার মধ্যে একটি লেখা এ ভাবে— হিন্দি (ল্যাটিন)!
শঙ্খমণি গোস্বামী, কলকাতা-১২২
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy