কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ায় গেলে, অথবা বইমেলায় গেলে বই বিক্রেতাদের হাল দেখে মন খারাপ হয়ে যায়। বইয়ের স্তূপের মধ্যে বসে থেকেও তাঁদের না আছে বইয়ের বিষয়বস্তু সম্বন্ধে ধারণা, না আছে কিছুমাত্র পড়াশোনা। কোনও প্রবন্ধের বইতে কী জাতীয় প্রবন্ধ আছে, জিজ্ঞেস করলে এক বিক্রেতা আর এক বিক্রেতার মুখের দিকে তাকান। বলতে পারেন না, ঐতিহাসিক না কি ধর্মীয় প্রবন্ধ, সাহিত্য বিষয়ে, না বিজ্ঞান বিষয়ে লেখা। শিক্ষা এঁদের ততটুকুই, যতটুকু হলে ব্যবসার কাজটা চলে যায়। বইয়ের সম্পূর্ণ নাম উচ্চারণেও দেখি অরুচি। আপিলা-চাপিলা এঁদের মুখে ‘আপিলা’, চরণ ছুঁয়ে যাই হয়ে দাঁড়ায় ‘চরণ’। এই ধরনের মানসিকতা তখনই দেখা যায়, যখন বইকে স্রেফ বাণিজ্যিক বস্তু হিসেবে দেখা হয়— ডাল, সিমেন্ট, গোলগলা গেঞ্জির মতো। তা হয়তো দোষের নয়, তবু মন মানে না।
একই ব্যাপার দেখা যেত ক্যাসেট-সিডির দোকানেও। ‘যেত’, কারণ ক্যাসেট-সিডির দোকান এখন প্রায় উঠে গিয়েছে। বিশাল মিউজ়িক স্টোরে গিয়ে কোনও ক্রেতা হয়তো বলছেন, “ওই যে ওঁর সিডি, খুব নিখুঁত রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন, এই তিন-চার দিন আগে মারা গেলেন... নামটা ভুলে যাচ্ছি...”। বিক্রেতাদের মধ্যে এক জনও তাঁকে সাহায্য করতে পারলেন না সুবিনয় রায়ের নামটা বলে। আর এক বার বিশ্ববন্দিত শিল্পী সম্পর্কে আদি-উপ-অন্ত বলে শুধু নামটা বিস্মৃত হয়ে যাওয়া বিদেশি এক ক্রেতা হতাশ হয়ে শূন্য হাতে ফিরে যাচ্ছিলেন, তাই দেখে এগিয়ে গিয়ে তাঁকে সাহায্য করেছিলাম।
কলকাতার অতি পরিচিত সেই ‘চেন মিউজ়িক স্টোর’-এর ডজনখানেক সুবেশ বিক্রেতার এক জনও বুঝে উঠতে পারেননি, ভদ্রলোক পণ্ডিত রবিশঙ্করকে বোঝাতে চাইছেন।
স্তুতি দাশগুপ্ত, কলকাতা-৯২
গর্বের ইতিহাস
‘পশ্চিমবঙ্গ ও ভূতের ভবিষ্যৎ’ (৩-২) নিবন্ধে রূপেন্দ্র নারায়ণ রায় বাঙালির সমাজকে সুন্দর ভাবে নিরীক্ষণ করেছেন। রাজনৈতিক মঞ্চের ভাষা ঘুরপথে বাঙালি জাতির ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সমাজকে অপমানিত করছে। আমরা নিজেদের পরিশীলিত অস্তিত্বকে হেয় করছি। “দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে যাবে না ফিরে, এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে”— এই আদর্শ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। বাংলার সাংবাদিকতা, বাংলা গদ্যের বিকাশ, ছাপাখানা, আধুনিক নাটক, অনুবাদ সাহিত্য ইত্যাদি সবই ওই বহিরাগতদের দান। তবে সমস্যাটা বোধ হয় অন্য রকম। সম্ভবত বলতে চাওয়া হচ্ছে, বর্তমান বাংলাকে বাঙালির দ্বারাই চালিত হতে হবে। অন্য প্রদেশের নেতারা যেন বাংলাকে করায়ত্ত করতে না পারেন।
তা হলে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসকে ফিরে দেখতে হয়। ৩৪ বছরের বাম শাসনের মূল চালিকা শক্তি ছিল দলের কেন্দ্রীয় কমিটি ও পলিটবুরো, যেখানে সারা দেশের সদস্য ছিলেন। যে সংবিধান আমাদের গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ, সেটি বাবাসাহেব অম্বেডকরের নেতৃত্বে রূপায়িত। তিনিও বাঙালি ছিলেন না। তবে তাঁকে গণপরিষদে বাংলা প্রদেশের প্রতিনিধি করে পাঠানো হয়। বাঙালির এ বড় গর্বের ইতিহাস।
সব্যসাচী ধর, সিউড়ি, বীরভূম
পরকে আপন
রূপেন্দ্র নারায়ণ রায়ের ‘পশ্চিমবঙ্গ ও ভূতের ভবিষ্যৎ’ সুখপাঠ্য। আমরা জানি, ভোটের সময়ে ‘ভোটপাখি’রা উড়ে আসে, ফিরেও যায়। ইদানীং গল্পটা একটু পাল্টেছে। গত কয়েক বছরে এ বাংলায় ঘাঁটি গেড়েছেন কিছু ভিন্্রাজ্যের মানুষ, যাঁরা ‘সোনার বঙ্গাল’ বানাতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু আর একটা কাজ সুচতুর ভাবে করে চলেছেন— বাঙালির জাত্যাভিমানে আঘাত করা। বাঙালির আইকন অমর্ত্য সেন থেকে অভিজিৎ বিনায়ককে গালমন্দ করছেন, তাঁদের কৃতিত্বকে নস্যাৎ করছেন! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিবেকানন্দের মতো মানুষের সঙ্গে গুজরাতের সম্পর্ক দেখাচ্ছেন। বলে বেড়াচ্ছেন, নরেন্দ্র মোদী ভোর সাঁড়ে পাচটায় রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতেন!
যে সব মহাপুরুষের নাম নিয়েছেন লেখক, তাঁরা যে বাংলা ভাষাকে নিজের মুখের ভাষা করেছিলেন, এই মাটিকে ভালবেসেছিলেন, সেটা নিজের লেখাতেই স্বীকার করেছেন! অর্থাৎ, বাঙালি যদি দেখে বহিরাগত কেউ তার সংস্কৃতিকে আপন করে নিচ্ছে, তবে সে তাকে সাদরে গ্রহণ করে। আর যে দেশে মানুষ ভিন্রাজ্যের শ্রমিকদের ‘পরিযায়ী’ বলে দাগিয়ে দেয়, সে দেশে কেউ যদি কিছু ভিন্-সংস্কৃতির নেতাকে ‘বহিরাগত’ বলে, তা হলে উৎকণ্ঠিত হওয়ার কি কোনও কারণ থাকে?
শক্তিব্রত ভট্টাচার্য, কলকাতা-৮৪
পাঁচিল
রূপেন্দ্র নারায়ণ রায় যুক্তিসঙ্গত ভাবে বলেছেন যে, “বাজার অর্থনীতির যজ্ঞে আমাদের অংশগ্রহণ করতে হলে প্রাচীর ভাঙতে হবে।” বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠাকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এই পাঁচিল ভাঙার কথা বার বার বলেছেন। সে পাঁচিল ছিল শিক্ষার আঙ্গিকে। বিশ্বভারতীকে রবীন্দ্রনাথ করে তোলেন পূর্ব-পশ্চিমের মিলনকেন্দ্র। তিনি কিন্তু এখানে বাঙালি-বহিরাগত বিভেদ রাখেননি। লেখকের কথার সূত্র ধরে বলব, ঊষা উত্থুপ গড় গড় করে বাংলা বলেন, যদিও তিনি জন্মসূত্রে তামিল। মনোজ এবং মনীষা মুরলী নায়ারের রবীন্দ্রসঙ্গীত আমরা শুনেছি। সাউয়ের তেলেভাজার দোকান থেকে ট্যাক্সি ড্রাইভার সিংজি— কে বাঙালি, আর কে বহিরাগত, তফাত করা মুশকিল। চেষ্টাও অযৌক্তিক। তবে যদি শুদ্ধ বাংলা বলতে পারাটা বাঙালি এবং বহিরাগত আলাদা করে দেয়, তবে খাস কলকাতার অনেক বাঙালিই হয়তো বহিরাগত হয়ে পড়বেন।
সুমন চক্রবর্তী, কলকাতা-৬৫
সেই রোগ
‘জয় বাংলা’ স্লোগান আমাদের অনেককেই ফিরিয়ে নিয়ে যায় ৫০ বছর আগে। ১৯৭১ সাল। পূর্ব পাকিস্তানে (পূর্ববঙ্গ) তখন মুক্তিযুদ্ধ চলছে। এই বঙ্গে লক্ষ লক্ষ শরণার্থী আসছেন। ১৯৭১ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের বিজয়ধ্বনি— ‘জয় বাংলা’, অতঃপর, ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’। সেই সঙ্কটের সময় এ-পারের সমস্যাগুলো আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল ‘জয় বাংলা’— ধ্বনি-স্লোগান নয়, চোখের রোগ, যার চলতি নাম ‘চোখ ওঠা’ (কনজাংটিভাইটিস)। ৩ জুন এক সংবাদপত্রের শিরোনাম ছিল ‘চোখের রোগে ট্রেন বন্ধের আশঙ্কা’। বন্ধ রাখা হয়েছিল অনেক স্কুল-কলেজ, বাতিল হয়েছে কত ফুটবল ম্যাচ। চোখ এড়ায়নি আন্তর্জাতিক পত্রিকাগুলোরও। নিউ ইয়র্ক টাইমস বলছে— পশ্চিমবঙ্গে ৫০ লাখেরও বেশি মানুষ আক্রান্ত, রেহাই পায়নি তাদের সাংবাদিকরাও। সংবাদপত্রগুলোতে বেরোত নানা রকম টোটকা। যেমন, ‘ছিলিমের (হুক্কা) বাসি জল চোখে লাগাইলে উপকার পাইবেন।’ লেবুর রস, পেঁয়াজের রস, হাতিশুড়া পাতার রস, দুধ দিয়ে চোখে প্রলেপ দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হত। নানা রকম তরল সাবান আর আই ড্রপের বিজ্ঞাপন থাকত কাগজে। সরকারি হিসেব, ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে অন্তত ৫ লক্ষ মানুষ অ্যাকিউট হেমারেজিং কনজাংটিভাইটিস-এর চিকিৎসা পেয়েছিলেন। এক বিশেষজ্ঞের মতে, আক্রান্ত হয়েছিলেন অন্তত ৫০ লক্ষ।
পাশাপাশি, শরণার্থীদের আর্থিক অসঙ্গতির দিকটা মাথায় রেখে বাজার ছেয়ে গিয়েছিল ‘জয় বাংলা’ (সস্তার) স্যান্ডেল, সাবান, তেল, ছাতা, স্যান্ডো গেঞ্জি, লুঙ্গিতে।
শেষে বলি, ‘বম্বে প্রেসিডেন্সি’ থেকে যে অম্বেডকরকে সরানো হয়েছিল, সেই অম্বেডকরকেই স্বাধীন ভারতের জন্য সংবিধান রচনার শ্রেষ্ঠ কারিগর হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল কিন্তু ও-পার বাংলারই মানুষ। তাই বলতেই পারি, ‘জয় ভারত’ এনে দিয়েছিল (পূর্ব) ‘বাংলা’ থেকে অম্বেডকরের জয়।
কল্লোল সরকার, বারাসত, উত্তর ২৪ পরগনা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy