ভোটকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার প্রশাসন করতে পারে না। —ফাইল চিত্র।
সদ্যসমাপ্ত পঞ্চায়েত নির্বাচনে এখনও পর্যন্ত ৪৩ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে। এর পরেও কি বলা যাবে ‘ভোট উৎসব’? ভোটকর্মীদের উপর মানসিক চাপ তৈরি বা সরাসরি শাসানি, ভোট লুটের ঘটনা জানান দিচ্ছে ভোট কতটা ‘অবাধ’ হয়েছে। প্রত্যেক বুথে ন্যূনতম এক জন করে রাজ্য পুলিশ ও এক জন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান থাকার যে নির্দেশ হাই কোর্ট জারি করেছিল, ভোটকর্মী হিসাবে দেখলাম, তা নেহাতই কথার কথা! এখন চলছে এক পক্ষের অন্য পক্ষকে দোষারোপের পালা। অনস্বীকার্য যে, অনেক বুথেই ভোট হয়েছে নিয়ম মেনে। কিন্তু যেখানেই বিরোধীদের উপস্থিতি রয়েছে, বা ন্যূনতম প্রতিরোধের সম্ভাবনা রয়েছে, সেখানেই চোখরাঙানি, বলপ্রয়োগ ঘটেছে। মানুষ যদি স্বাধীন ভাবে তাঁর ভোটাধিকার প্রয়োগ না-ই করতে পারেন, তা হলে কিসের গণতন্ত্র? এ তো নির্বাচনের নামে প্রহসন। আর যে সমস্ত সিভিক পুলিশ ও পুলিশকর্মী প্রায় নিষ্ক্রিয় থেকে এ সব মেনে নিয়েছেন, তাঁদের জন্য করুণা হয়। এরই মধ্যে কিছু সরকারি আধিকারিক শিরদাঁড়া সোজা রেখে ভোটকর্মীদের পাশে থেকে যে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, তাঁদের কুর্নিশ জানাই। নির্বাচন আসে, নির্বাচন যায়, কিন্তু ভোটকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার প্রশাসন করতে পারে না। একরাশ উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ তাঁদের সঙ্গী। আমরা দেখি, যে সব বুথে পুনর্নির্বাচন হয়, সেখানে আঁটসাঁট নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। প্রশ্ন হল, সমস্ত বুথেই এ রকম ব্যবস্থা হয় না কী কারণে? যথেষ্ট নিরাপত্তারক্ষীর অভাব থাকলে নির্বাচনের দফার সংখ্যা বাড়ানো হোক।
ভোটকর্মী হিসাবে আর একটি কথার উল্লেখ করতেই হয়। ‘রিসিভিং কাউন্টার’-এ মালপত্র জমা দেওয়ার পরে ফেরার জন্য প্রয়োজনীয় যানবাহন পেতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চরম হয়রানির শিকার হতে হয়। দু’দিনের অমানুষিক পরিশ্রমের পর পরিবহণ বিভাগের আরও সদর্থক ভূমিকা কাম্য।
প্রত্যেক নির্বাচনেই ‘গণতন্ত্রের বলি’ হন কিছু মানুষ, রক্তের আঁশটে গন্ধে দাপায় শাসক। এর শেষ কোথায়!
দেবাশিস দাস, বোলপুর, বীরভূম
সন্ত্রাসের উৎস
আরও একটি পঞ্চায়েত ভোট অনুষ্ঠিত হল রাজ্যে। গান্ধীজির দেশ গঠনের ভাবনার মধ্যে বুনিয়াদি শিক্ষা ও সমবায় ব্যবস্থার সঙ্গে গুরুত্ব পেয়েছিল পঞ্চায়েত ব্যবস্থাও, যার মূল ভাবনা ছিল গ্রামীণ ভারতের উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নের ভিত সুদৃঢ় করা। বামফ্রন্টের প্রথম মন্ত্রিসভাতেই এই ভাবনাকে এক বিধিসম্মত কাঠামোর মধ্য দিয়ে বাস্তবায়িত করা হয়েছিল।
কিন্তু পঞ্চায়েতি ব্যবস্থায় অর্থের জোয়ার এসেছিল রাজীব গান্ধীর হাত ধরেই। আর এর পরেই পঞ্চায়েত নির্বাচনে শুরু হয়েছিল শাসকের প্রত্যক্ষ মদতে নির্বাচনী সন্ত্রাস। এর ফলে উন্নয়নের বরাদ্দের এক বড় অংশ ব্যক্তি বা দলকে পুষ্ট করেছে। পরে এসেছে কাটমানি সংস্কৃতি— ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে উপভোক্তার বরাদ্দ অর্থের অংশ আত্মসাৎ করা। বলা বাহুল্য, পঞ্চায়েতের বিভিন্ন প্রকল্পে অনুমোদিত এই বিপুল অর্থই হচ্ছে এই নির্বাচনী সন্ত্রাসের উৎস। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে ৩৪ শতাংশ আসনে বিরোধী দলগুলিকে মনোনয়নই পেশ করতে দেয়নি শাসক দলের মদতে পুষ্ট গুন্ডা-সমাজবিরোধীরা। এ বারে বিরোধী দলগুলির প্রত্যয় দেখে মনে হয়েছিল, গত বারের ঘটনার পুনরাবৃত্তি বোধ হয় ঘটবে না। কিন্তু বশংবদ নির্বাচন কমিশন যে ভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে শাসক দলের দাস্যবৃত্তি করে গেল, তাতে অচিরেই সে আশা দুরাশায় পরিণত হল।
নির্বাচন কমিশন খুব ভাল করেই জানত, রাজ্য পুলিশ দিয়ে কখনও অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভোট সম্ভব নয়, এবং এক দফায় ভোট হলে সমস্ত বুথে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করাও সম্ভব নয়। উচ্চ আদালতের রায়ে কমিশন কেন্দ্রীয় বাহিনীর সাহায্য নিতে বাধ্য হলেও, কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল চূড়ান্ত অপেশাদারিত্ব। কমিশনের কৌশল ছিল এমন ভাবে চলা, যাতে ‘সাপও মরে, লাঠিও না ভাঙে’। আবার যে কেন্দ্রীয় বাহিনী এল ও বিভিন্ন বুথে নিরাপত্তার দায়িত্ব পেল, তাদেরও খুব একটা সক্রিয় ভূমিকায় দেখা গেল না। সবটাই কি তা হলে সাজানো চিত্রনাট্য?
প্রদীপনারায়ণ রায়, শক্তিপুর, মুর্শিদাবাদ
বিকল্পের খোঁজ
সমস্ত পাপের বোঝা, অপরাধের কলঙ্ককে কি ‘জনগণের আশীর্বাদ’ বলে চালিয়ে দেওয়া যায়? রিগিং, বুথ দখল, ছাপ্পা— এই সমস্ত শব্দ কী ভাবে যেন আমাদের অভিধানে পাকাপাকি জায়গা করে নিল, ভাবতেও অবাক লাগে। নির্বাচন কমিশন বলবে, কয়েকটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া নির্বাচন শান্তিতেই হয়েছে। শাসক দাবি করবে, মানুষ উৎসবের আবহাওয়ায় ভোট দিয়েছেন এবং বিরোধীরা বলবেন এই নির্বাচন আসলে প্রহসন— এতে এখন আমরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। মাঝখান থেকে যে প্রাণগুলো অকালে ঝরে গেল, তার দায় কে নেবে?
সময় এসেছে বিকল্প কিছু চিন্তাভাবনার। ১) ব্যালট পেপার বা ইভিএম মেশিনকে ত্যাগ করে অনলাইনে ভোট করা হোক। অনেকে বলতে পারেন, উন্নত বিশ্বে এখনও ব্যালট পেপারে ভোট হয়। হ্যাঁ হয়, কিন্তু সেখানে তো আর এমন হিংসা হয় না, প্রাণ যায় না। ভারতে প্রায় ১২০ কোটি মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন, প্রায় ৬০ কোটি মানুষের স্মার্টফোন আছে। এর পরেও যাঁরা নিজস্ব মোবাইলে ভোট দিতে পারবেন না, তাঁদের জন্য কিছু নির্দিষ্ট বুথ তৈরি করা যেতে পারে। যেখানে তিনি পৌঁছনোর পরে তাঁর আঙুলের ছাপ বা মুখের ছবির সাহায্যে ভোটিং মেশিনটি খুলবে এবং তিনি ভোট দিতে পারবেন।
২) আমাদের দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র স্বীকৃত। আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনও প্রার্থীকে নয়, ভোটটা আসলে একটা নির্দিষ্ট দলকে দিই, সেই দলের প্রতীকে ছাপ দিই। ফলে ব্যক্তি নয়, নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে স্বীকৃত রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে। মনোনয়ন পত্র জমা করার ঝামেলাটাই আর থাকবে না (যেখান থেকে আমাদের সমস্ত হিংসার সূত্রপাত)। হয়তো এড়ানো যাবে ব্যক্তিগত হিংসা রেষারেষি বিদ্বেষ। এখন প্রশ্ন হল, জনপ্রতিনিধি বাছাইয়ের কাজটা কী ভাবে হবে। রাজনৈতিক দল নির্বিশেষে প্রাপ্ত ভোটের শতাংশ হিসাবে সেই দলকে সমানুপাতিক হারে জনপ্রতিনিধি বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। ধরা যাক, একটি পুরসভাতে ৩০টি আসন আছে। যে দল ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েছে তারা ১২ জন প্রতিনিধি দেবে বা যে দল ১০ শতাংশ ভোট পেয়েছে তারা তিন জন প্রতিনিধি দেবে। এ ভাবেই সংখ্যা ঠিক হতে পারে। এই ব্যবস্থার সরাসরি দুটো লাভ হতে পারে। এক, বিরোধী শূন্য পঞ্চায়েত, পুরসভা বলে কিছু থাকবে না। আর দুই, দলবদলের সম্ভাবনাটাও একেবারে শূন্যে নেমে আসবে। দল কেউ বদলাতেই পারেন, সে ক্ষেত্রে তাঁর পুরনো দল নতুন এক প্রতিনিধি পাঠাবে। ফলে, সমীকরণ বদলের সম্ভাবনা থাকবে না। অকাল নির্বাচনের অশনিসঙ্কেতটাও এড়ানো যাবে।
৩) নমিনি-ভোট, সঙ্গী-ভোট ইত্যাদির ধারণাটাই তুলে দিতে হবে। কারণ, অনেকেই বুথে এসে অসুস্থ হয়ে পড়েন, চোখে কম দেখেন। রাজনৈতিক দলগুলি এঁদের নিয়ে টানাহেঁচড়া করে আর বুথে বুথে গন্ডগোলের প্যান্ডোরার বাক্স খুলে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা তৈরি হয়।
৪) যে কোনও রাজ্যেই ভোটের সময় রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করে ভোট করতে হবে এবং রাজনৈতিক দলের যে সদস্যরা বিভিন্ন ধরনের নিরাপত্তা বলয়ের সুরক্ষা পান, সেগুলো তুলে নিতে হবে। কারণ, নিরাপত্তার ঘেরাটোপে থেকে তাঁদের বেফাঁস মন্তব্য ও উস্কানিমূলক বিবৃতি নির্বাচনের পর্বের বিভিন্ন সময়ে হিংসায় ইন্ধন জোগায়।
হিংসার সংস্কৃতি বদলের জন্য সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে মতবিনিময় ও সুস্থ বিতর্ক প্রত্যাশা করি।
শুভঙ্কর সাহা, সিন্দ্রানী, উত্তর ২৪ পরগনা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy