ভূমিকম্প, বন্যা, ঝড়, সব কিছুরই কারণ কি বিশ্ব উষ্ণায়ন? না কি এটা পরিবেশবিদদের আরোপিত একটা চিন্তাপ্রণালী? সুপ্রতিম কর্মকারের ‘তাঁর সতর্কবার্তা কানে তোলেনি কেউ’ এবং নিখিল সুরের ‘বঙ্গোপসাগরে ভ্রুকুটি চিরকাল ভয়ের কারণ’ (রবিবাসরীয়, ৬-৬) প্রবন্ধ দু’টি পড়ে তেমনটা মনে হল। এক দিকে একবিংশ শতাব্দীর ইয়াস পর্যন্ত ঘটে-যাওয়া বিভিন্ন ঝড়ের খতিয়ান দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বক্তব্যে জোর দিয়েছেন লেখক, আবার ১৭৩৭ সালের ‘ক্যালকাটা সাইক্লোন’-এর তথ্যও জুড়ে দিয়েছেন। জলবায়ু পরিবর্তন অথবা বিশ্ব উষ্ণায়ন তো ১৯৭৫ সালের আগে অজানা গল্প ছিল। আজ থেকে ৩০০ বছর আগে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সমুদ্র-উপকূলের ঝড়-ঝঞ্ঝার কারণ অবশ্যই উষ্ণায়ন বা বৃক্ষচ্ছেদন ছিল না। তবুও লেখক শেষ পর্যন্ত বলতে চাইলেন, মানুষ আজ প্রকৃতিকে নষ্ট করছে বলেই এমন দুর্যোগের প্রকোপ!
ঝড় সৃষ্টির ভৌগোলিক কারণ প্রাঞ্জল ভাবে বিশ্লেষণ করে, এবং প্রায় ৩০০ বছরে বিবিধ ঝড়-ইতিহাস জেনেও কেন লেখক দূষণ-উষ্ণতা বৃদ্ধি-মেরু বরফের গলে যাওয়াকে ব্যাখ্যার জন্য ডেকে আনলেন, বুঝলাম না। তবে একটি তথ্য-প্রমাদ রয়েছে তাঁর নিবন্ধে। তিনি লিখছেন, ১৮৩৮ সালে পিডিংটনের হাতে আসে উইলিয়াম রিডের লেখা ল’ অব স্টর্মস বইটি। কিন্তু বইটির ৩৬ পাতায় বারমুডা অঞ্চলের যে ভয়ঙ্কর হারিকেন-ঝড়ের উল্লেখ আছে, তা ঘটেছিল ১৮৩৯ সালে। নেটমাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি, বইটি প্রকাশ পেয়েছিল ১৮৪৯ সালে।
নিখিলবাবুর নিবন্ধটিও অত্যন্ত তথ্যনিষ্ঠ, এবং তিনিও মেনে নিয়েছেন যে, মহাসাগরে ঝড়ের ভ্রুকুটি চিরকালীন। ১৭৩৭ সাল ঝড়ের মাস ও তারিখ নিয়ে তাঁর ভিন্ন মত থাকলেও, তিনিও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রসঙ্গ উপস্থাপন করেই রচনা শেষ করলেন! ‘বিশ্ব উষ্ণায়ন’-এর আরোপিত উপাখ্যান কেবল লেখক নয়, অনেকের মনেই থেকে গিয়েছে। যুক্তির স্বচ্ছতাই কেবল পারে পরিবেশ বিষয়ে আমাদের প্রকৃত বোধের পথ খুলে দিতে।
কৌশিক গুড়িয়া, বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ
চট্টগ্রাম সাইক্লোন
নিখিল সুরের নিবন্ধ প্রসঙ্গে বলি, ১৮৭৬-এর সাইক্লোনও কম ভয়াবহ ছিল না। এই সাইক্লোনের ভয়াবহতার উল্লেখ করেছেন নবীনচন্দ্র সেন, তাঁর আত্মজীবনী আমার জীবন-এ। নবীনচন্দ্র তখন চট্টগ্রামের কমিশনারের পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট। ঝড়ের পর দিন সকালে আর্দালি তাঁকে খবর দিল, কতকগুলি লোক সন্দীপ দ্বীপ থেকে ভেসে এসেছেন। সন্দীপ চট্টগ্রাম থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরের এক দ্বীপ। লোকগুলি বলেছিলেন, সমুদ্রপ্লাবনে যখন তাঁদের ঘর পর্যন্ত ডুবে গেল, তখন তাঁরা চালের উপর উঠেছিলেন। তার পর কী হয়েছে, তাঁরা আর জানেন না। সকালে দেখলেন যে, তাঁরা চট্টগ্রামের চড়ায় পড়ে আছেন। কোনও পরিবারের এক জন, কোনও পরিবারের দু’জন মাত্র বেঁচে ছিলেন। মানুষগুলি ছিলেন বিবস্ত্র, বাজারের দোকানদারদের দেওয়া ন্যাকড়া জড়িয়ে তাঁরা এসেছিলেন।
নবীনচন্দ্র জানাচ্ছেন কর্ণফুলী নদীর সৈকতে গিয়ে তিনি দেখলেন, যত দূর দৃষ্টি যায় শুধু শব আর শব। এই ঝড়ে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালির সমস্ত তটভূমি মানুষের ও পশুপাখির মৃতদেহে এক মহাশ্মশানে পরিণত হয়েছিল। হাতিয়ায় সন্দীপে ও সমুদ্রতটে ৩০-৩২ হাত উঁচু সমুদ্রতরঙ্গ উঠেছিল। সরকারি হিসাবে ঢাকা চট্টগ্রামে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিলেন।
উত্তম কুমার পতি, বাঁকুড়া
ঝড়ের বেগ
‘বঙ্গোপসাগরে ভ্রুকুটি চিরকাল ভয়ের কারণ’ প্রবন্ধে ১৮৬৪ সালের ৫ অক্টোবরের (২০ আশ্বিন, ১২৭১) ঘূর্ণিঝড়ের উল্লেখ করেছেন লেখক। এই ঝড় ‘আশ্বিনে ঝড়’ নামে খ্যাত। জানা যায়, প্রতি বর্গফুটে এই ঝড়ের চাপ ছিল তখনকার দিনে ওজনের পরিমাপে আড়াই সের থেকে ষোলো সের পর্যন্ত; অর্থাৎ বর্তমান ওজনের পরিমাপ অনুযায়ী দুই কিলোগ্রাম আড়াইশো গ্রাম থেকে চোদ্দো কিলোগ্রাম চারশো গ্রাম! ঝড়ের বেগ হুগলি, শ্রীরামপুর, কালনা, কৃষ্ণনগর, রামপুর-বোয়ালিয়া, পাবনা ও বগুড়া অঞ্চলে সর্বাধিক অনুভূত হয়েছিল। সি ই বাকল্যান্ড নামে এক পদস্থ ইংরেজ আধিকারিক জানান, এই ঝড়ে প্রায় ৪৭ হাজার ৮০০ লোক ও প্রায় ১ লক্ষ ৩৬ হাজার গৃহপালিত পশুর প্রাণহানি ঘটে। সম্পত্তি ও অর্থহানির হিসাব করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি।
প্রসন্নকুমার কোলে, শ্রীরামপুর, হুগলি
হেমন্তের সম্ভার
দেখতে দেখতে বয়স ১০১ বছর পূর্ণ হল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের (১৬ জুন, ১৯২০-২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৯)। একশো পার করেও যাঁরা আমাদের স্মৃতিতে জীবিত থাকেন, তাঁরা নিঃসন্দেহে সাধারণের দলে পড়েন না। কিন্তু এমন অসাধারণ মানুষেরও সব কাজ কি বিস্মৃতির থাবা এড়াতে পারে? ১৯৪৬ সালে ২৬ বছরের তরুণ হেমন্ত কলম্বিয়া রেকর্ড কোম্পানি থেকে অলকা উকিলের (১৯১৫-৮০) লেখা দু’টি গান নিজের সুরে রেকর্ড করলেন (‘স্বপন ঘুমে মগন ছিলাম’ এবং ‘মনে হল তুমি এলে’)। অলকা উকিলের আরও কয়েকটি গান হেমন্ত রেকর্ড করেছিলেন। আজকে কি আমরা বলতে পারি অলকার ঠিক কতগুলো গান হেমন্ত রেকর্ড করেছেন? বা আর কোন মহিলা গীতিকারের গান তিনি গেয়েছেন? আমাদের স্মৃতিতে কি এই অলকা উকিলের মতো কবি-ক্রীড়াবিদ বিদুষী গীতিকারের স্মৃতিও ফিকে হয়ে যায়নি? এমনকি হেমন্তের মতো জনপ্রিয় গায়কের সমস্ত কাজও কি চাইলেই আমরা ফিরে দেখতে বা শুনতে পারি? কিছু ছোট গল্প লিখেছেন একদা হেমন্ত। এখন কি সে সমস্ত কাজের খোঁজ পাওয়া সহজ সকলের পক্ষে? অথচ, এমন একটা সংগ্রহশালা গড়ে ওঠার তো প্রয়োজন ছিল, যেখানে হেমন্তের সমস্ত কাজের খতিয়ান রাখা থাকবে। লোকচক্ষুর আড়ালে মহাফেজখানার নিরাপদ অন্ধকারে বা সংগ্রাহকদের অসূর্যম্পশ্যা সংগ্রহে লুকিয়ে থাকলেও তা বিস্মৃতিরই নামান্তর হয়ে ওঠে। হেমন্ত বিষয়ক একটি বৈদ্যুতিন মহাফেজখানা গড়ে তোলায় আমাদের উদ্যোগী হতে হবে এখনই, যাতে তা উৎসাহীরা ব্যবহার করতে পারেন। বিভিন্ন সংগ্রাহক এবং উৎসাহী গবেষকরা এই কাজে হাত মেলালে তা সফল হবে। হেমন্ত বারে বারে নিজেকে অতিক্রম করে গিয়েছেন— তাঁর গায়কি, সুর সৃষ্টি, অন্য নানা যূথবদ্ধ কাজ তার সাক্ষ্য বহন করে। শিল্পী হিসেবে তাঁর এই নিজেকে পেরিয়ে যাওয়ার চালচিত্রকে একটি বৈদ্যুতিন মহাফেজখানা ভাবী কালের কাছে ধরে দেবে— এমন আশা করাই যায়।
রাজীব চক্রবর্তী, কলকাতা-১০
গ্রিয়ারসন
গৌতম চক্রবর্তী ‘ভারতকে খুঁজতে খুঁজতে’ (১৩-৬) প্রবন্ধের জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসনের কথা লিখেছেন। তাঁর কীর্তি আজও বাংলার এক প্রান্তিক অঞ্চলে স্মরণীয়। তাঁর কাজ ভারতের ভাষাচর্চা মাধ্যমে সমাজবিদ্যাচর্চার এক নতুন দিক উন্মুক্ত করেছিল। তার নমুনা পাওয়া যায় ‘নোট অন আ ডায়ালেক্ট অব গুজরাতি ডিসকভারড ইন দ্য ডিস্ট্রিক্ট অব মিদনাপুর’ প্রবন্ধে, যা এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত হয় (১৮৯৮)। অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার (বর্তমানে পশ্চিম মেদিনীপুর) দাঁতনের মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলের ‘শিয়ালগিরি’ ভাষার সন্ধান দেন গ্রিয়ারসন। ‘শিয়ালগিরি’ গুজরাতি ভাষার একটা ভিন্ন রূপ— এটাই ছিল গ্রিয়ারসন সাহেবের প্রবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য। এই ভাষা ব্যবহারকারীর পূর্বপুরুষরা পশ্চিম ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে, তা তিনি মনে করিয়ে দেন। এই উপস্থাপনের মাধ্যমে বাংলার জাতিচর্চা ও অভিপ্রয়াণচর্চাও সমৃদ্ধ হয়েছিল।
প্রণব বর্মন, সুতাহাটা, পূর্ব মেদিনীপুর
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy