Advertisement
০১ জুন ২০২৪
Journalism

সম্পাদক সমীপেষু: সংবাদের কারাগার

নিষ্ঠার সঙ্গে নিজের কাজ করতে গিয়ে ২০২০ সালে ভারতে প্রাণ খুইয়েছেন চার জন সাংবাদিক। এই দেশ তাই সাংবাদিকদের পক্ষে সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশগুলির অন্যতম।

—প্রতীকী ছবি।

শেষ আপডেট: ১১ মে ২০২৪ ০৫:১৫
Share: Save:

‘কলমকে ভয় করে বলেই’ (২৩-৪) শীর্ষক প্রবন্ধে দেশের পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন করেছেন প্রবন্ধকার ঈশানী দত্ত রায়। নানা সূত্র থেকে সংবাদের বিপন্নতার তথ্য মিলছে। ১৮০টি দেশের পরিস্থিতি বিচার করে ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স’ ২০২১ সালে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। তাতে দেখা যায়, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারত ছিল ১৪২ নম্বরে। তার আগের বছরের রিপোর্টেও ভারত ছিল ১৪২ নম্বরে। তবে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে সে বছরের রিপোর্টে সাংবাদিকদের বিপদের জন্য নরেন্দ্র মোদীর সরকারকে দায়ী করা হয়েছিল। রিপোর্টে বলা হয়েছিল, বিজেপি সমর্থকেরা ও হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি সাংবাদিকদের আতঙ্ক হয়ে উঠেছে। সরকারের সমালোচনা করলেই সাংবাদিকদের জাতীয়তা-বিরোধী বা রাষ্ট্রদ্রোহী বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সুনির্দিষ্ট ভাবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নাম করে বলা হয়েছিল, সংবাদমাধ্যমকে তিনি কব্জা করে রেখেছেন।

নিষ্ঠার সঙ্গে নিজের কাজ করতে গিয়ে ২০২০ সালে ভারতে প্রাণ খুইয়েছেন চার জন সাংবাদিক। এই দেশ তাই সাংবাদিকদের পক্ষে সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশগুলির অন্যতম। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কাশ্মীরের বহু সাংবাদিক রাজ্য বা দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছেন, বহু সংবাদমাধ্যম বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কাশ্মীরের সাংবাদিকরা দীর্ঘ দিন ধরে তাঁদের প্রতি, এবং বাক্‌স্বাধীনতার প্রতি পুলিশের অকারণ নির্যাতনের যে অভিযোগ তুলে চলেছেন, হাই কোর্টের বক্তব্যে তারই সমর্থন মেলে। সেই অভিযোগ এই যে, পুলিশ বস্তুত সরকারের ইশারায় কঠোর নানা ধারায় একের পর এক তার সমালোচকদের জেলে ভরছে। আদালত জামিন দেওয়ামাত্র জামিন অযোগ্য জনসুরক্ষা আইন আরোপ করে ফের গ্রেফতার করা হচ্ছে। এমন ঘটেছে অন্তত তিন জন সাংবাদিকের ক্ষেত্রে। জনসুরক্ষা আইনে দু’বছর পর্যন্ত বিচার না করেও বন্দি রাখা যায়। বর্তমানে দেশের যা পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, তাতে সংবাদের কারাগার থেকে কবে মুক্তি মিলবে কে জানে?

শফিকুল ইসলাম, রানাঘাট, নদিয়া

রাষ্ট্রের প্রভুত্ব

‘দলদাস না হলেই রাষ্ট্রদ্রোহী’— এই অসামাজিক রোগের শুরু ‘রাষ্ট্র’-এর উদ্ভব থেকে। সমাজবিজ্ঞানের মতে, পৃথিবীর রাজা, সামন্ত, গোষ্ঠী ইত্যাদি শক্তি ‘রাষ্ট্র’কাঠামোয় ক্রমে নিজেদের অভিযোজিত করে নিয়েছে। ‘রাষ্ট্র’-শক্তি ব্যক্তি নাগরিককে নানাবিধ সুরক্ষা, সুবিধা, শান্তি দিয়েছে। আবার ‘রাষ্ট্র’কাঠামোর সুযোগ নিয়ে শাসক রাজনৈতিক দলের প্রভু হয়ে গিয়েছে। তখন রাষ্ট্রের নিয়ন্তা প্রভুকে হয় ভক্তি বা ভয় করতে হয়।

ইউরোপে ফ্রান্স, ইউরেশিয়ায় রাশিয়া প্রমুখ দেশে অনেক আগে বৈপ্লবিক সূত্রে রাষ্ট্রের চরিত্র পাল্টানো শুরু হয়েছিল। প্রভু-ভৃত্যের পার্থক্য কমে যাওয়ার সূচনা হয়েছিল। কিউবা, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, চিন ইত্যাদি দেশে তাদের ভূ-রাজনীতির প্রভাবে স্বতন্ত্র বিপ্লব হয়েছে। সর্বত্র ‘কলম’ গর্জে উঠেছিল, যদিও অনেকটাই সাহিত্য-কলমে। বস্তুত তা ছিল সাংবাদিক-কলমের জনক-জননী। সেখানে আন্তর্জাতিকতাবাদে ‘রাষ্ট্র’ মুছে যাওয়ার কথা। তা হয়নি, কারণ বাকি বিশ্ব সায় দেয়নি। পরাধীন ভারতের জাতীয়তাবাদী ‘কলম’কে ভয় করেছিল ইউরোপীয় উপনিবেশবাদ। স্বাধীনতার পরেও জাতীয় পুঁজিবাদ ও বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীর আঁতাঁত সাংবাদিকদের কলমের স্বাধীনতাকে প্রশ্রয় দেয়নি।

দেশ স্বাধীন হয়, ভূ-রাজনীতি তার কাঠামো, রূপ পাল্টায়। কিন্তু অত্যাচারী শোষক-শাসকের চরিত্র পাল্টায় না। সেই থেকে রাষ্ট্রে আর্থিক বৈষম্য বেড়েই চলেছে। ঈশানী দত্ত রায়-কথিত ‘গত এক দশক’ নয়, স্বাধীনতার শুরুতেই নতুন দেশের স্বপ্নে সাংবাদিকদের কলম বাঁধা ছিল। ১৯৭০ দশক থেকে সাংবাদিক-জগৎ রীতিমতো আক্রান্ত। গান্ধীজির হত্যাকাণ্ড, নেতাজি অন্তর্ধান রহস্য, পুরুলিয়ায় অস্ত্রবর্ষণ ইত্যাদি কতশত সংবাদ এখনও ‘ডি-ক্লাসিফায়েড’ হয়নি। এ কালে হিন্ডেনবার্গ রহস্য অধরা। আসলে রাষ্ট্রই জন্ম নিয়েছে তথ্যে ভারসাম্যহীনতার (ইনফর্মেশন অ্যাসিমেট্রি)। সেই তথ্য-অসাম্য আজ রাষ্ট্রকেই বিপদে ফেলেছে। এই তথ্যের অধিকারী হয়ে পুঁজি ও পুঁজিবাদ চরিত্র পাল্টাচ্ছে। ধনতন্ত্রে সাঙাতরা ‘রাষ্ট্র’ চরিত্রে অন্তর্ঘাত করে চলেছে। তথ্যের অধিকার সংবিধানে স্বীকৃত, কিন্তু নাগরিক তথ্য চাইলেই সন্দেহ জাগছে রাষ্ট্রের। তথ্যের অধিকার নিয়ে সমালোচনাও রাষ্ট্রদ্রোহিতা হয়ে যাচ্ছে। প্রবন্ধে ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স’-এর তথ্য পড়ে মনে হতে পারে, এ বুঝি বিগত কয়েক দশকে সাম্প্রতিক ঘটনা। তা নয়। আগেও ছিল। রুশদি বলেছেন ভাষা-ছুরির প্রয়োজনীয়তার কথা। এখন বিকৃত ও বিক্রীত তথ্যের মোকাবিলা করতে হলে ভাষা-ছবির ছুরিকে আরও আধুনিক ও কৌশলী হতে হবে। আগে দরকার বিশ্ব জুড়ে সাংবাদিক ও সংবাদজগতের ঐক্য।

শুভ্রাংশু কুমার রায়, চন্দননগর, হুগলি

চিরকালের সঙ্কট

ঈশানী দত্ত রায়ের প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে রক্তকরবী সম্পর্কিত রবীন্দ্রনাথের একটি অভিভাষণ (১৩৩১) মনে পড়ে গেল। তিনি লিখছেন, “আজ আপনাদের বারোয়ারি-সভায় আমার ‘নন্দিনী’র পালা অভিনয়। প্রায় কখনো ডাক পড়ে না, এবারে কৌতূহল হয়েছে। ভয় হচ্ছে, পালা সাঙ্গ হলে ভিখ মিলবে না, কুত্তা লেলিয়ে দেবেন। তারা পালাটাকে ছিঁড়ে কুটিকুটি করবার চেষ্টা করবে। এক ভরসা, কোথাও দন্তস্ফুট করতে পারবে না।”

আর একটি অংশে তিনি বলেছেন, “আধুনিক সমস্যা বলে কোনো পদার্থ নেই, মানুষের সব গুরুতর সমস্যাই চিরকালের। রত্নাকর গোড়ায় দস্যু, তারপরে দস্যুবৃত্তি ছেড়ে ভক্ত হলেন রামের। অর্থাৎ ধর্ষণবিদ্যার প্রভাব এড়িয়ে কর্ষণ বিদ্যার যখন দীক্ষা নিলেন তখনই সুন্দরের আশীর্বাদে তাঁর বীণা বাজল।”

মনে পড়ল আনন্দবাজারে প্রকাশিত প্রতিবেদন ‘হাজতে লেখকের মৃত্যু, উত্তাল ঢাকা’ (২৭-২-২০২১)-র কথা। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর নেমে এসেছিল নির্লজ্জ কুঠারাঘাত। সংবাদ অনুযায়ী, সরকারের সমালোচক মুশতাক ও কার্টুনিস্ট আহমেদ কবীর কিশোরকে বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়। শেষ দশ বছরে ছ’বার মুশতাক এবং কবীরের জামিনের আর্জি খারিজ করা হয়। অবশেষে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে ৫৩ বছরের লেখক মুশতাকের মৃত্যু হয়। সম্প্রতি নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক সোমা সেন দীর্ঘ কারাবাসের পর সুপ্রিম কোর্টের আদেশে জামিন পেলেন। অশীতিপর পাদরি স্ট্যান স্বামী দেশদ্রোহিতার অপরাধে জেলেই মৃত্যুবরণ করেছেন; বিনায়ক সেন হয়ে ভারাভারা রাও, সিদ্দিক কাপ্পান, প্রবীর পুরকায়স্থ, সকলেই ‘দেশদ্রোহী’। এক সময় পশ্চিমবঙ্গেও অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র শুধুমাত্র ‘কার্টুন’ ফরওয়ার্ড করার দায়ে হাজতবাস করেছিলেন।

কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন, “শহরের আনাচে কানাচে/ প্রতিটি রাস্তায়/ অলিতে গলিতে,/ রঙিন সাইনবোর্ডে, প্রত্যেক বাড়িতে/ স্বাধীনতা নামক শব্দটি/ আমি লিখে দিতে চাই/ বিশাল অক্ষরে।/ স্বাধীনতা শব্দ এতো প্রিয় যে আমার/ কখনো জানিনি আগে।” (‘বন্দীশিবির থেকে’)

দুর্নীতির রাজত্বে পারস্পরিক বিশ্বাসের ক্ষেত্রটিতে এক গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে সাংবাদিক, রাজনীতিক, শিক্ষক, প্রযুক্তিবিদ, ডাক্তার, কেরানি, পিতা-পুত্র, কন্যা-মাতা-জামাতা— কেউই আজ আর বিপরীত সম্পর্কের নিরিখে নাগরিক সমাজে সন্দেহের ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন না। তাই শাসকের সমস্ত সন্দেহ শেষ পর্যন্ত কলমের উপরে গিয়েই পড়ে। সেখানে অপরাধী হিসেবে আফজ়ল গুরুর সঙ্গে একাকার হয়ে যান স্ট্যান স্বামী, গৌরী লঙ্কেশ, বিনায়ক সেন থেকে সিদ্দিক কাপ্পান, সোমা সেন।

সঞ্জয় রায়, দানেশ শেখ লেন, হাওড়া

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Journalism India Journalists
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE