Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Pritilata Waddedar

সম্পাদক সমীপেষু: অবিকল্প প্রীতিলতা

দলনেত্রীর নির্দেশে সবাই চলল গন্তব্যের দিকে। কিন্তু দলনেত্রী? পটাশিয়াম সায়ানাইডের ক্যাপসুলটা দাঁতে চেপে পড়ে রইলেন চট্টগ্রামের পাহাড়তলির মাটিতে, কুড়ি বছরের প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।

শেষ আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৫:২৫
Share: Save:

১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর, রাত দশটা। চট্টগ্রামের ইউরোপিয়ান ক্লাবের সাহেব-মেমরা তখন নাচ-গান আর খানাপিনায় মত্ত। হঠাৎ গোটা ক্লাবঘর কেঁপে উঠল প্রচণ্ড বিস্ফোরণে। সেই সঙ্গে কয়েকটি পিস্তল গর্জে উঠল, ‘বন্দে মাতরম্’। দলনেত্রীর নির্দেশে সবাই চলল গন্তব্যের দিকে। কিন্তু দলনেত্রী? পটাশিয়াম সায়ানাইডের ক্যাপসুলটা দাঁতে চেপে পড়ে রইলেন চট্টগ্রামের পাহাড়তলির মাটিতে, কুড়ি বছরের প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।

৫ মে, ১৯১১ চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন প্রীতিলতা। মেধাবী ছাত্রী হওয়ায় শিক্ষক-শিক্ষিকার খুব প্রিয় ছিলেন। তাঁদের মধ্যে এক জন ছিলেন ঊষাদি, যিনি প্রীতিলতাকে পুরুষের বেশে ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাইয়ের ইংরেজ সৈন্যদের সঙ্গে লড়াইয়ের কাহিনি শোনাতেন। ছোটবেলা থেকেই প্রীতিলতার মধ্যে গড়ে ওঠে দেশাত্মবোধ। ১৯৩০ সালে তিনি আইএ পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম ও সবার মধ্যে পঞ্চম হন। দর্শন ছিল তাঁর প্রিয় বিষয়। কিন্তু সেই সময়ের পরিস্থিতিতে তিনি দেশমাতাকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করাকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছিলেন।

১৯২৪ সালে বেঙ্গল অর্ডিন্যান্স নামক এক জরুরি আইনে বিপ্লবীদের বিনা বিচারে আটক করা শুরু হয়। চট্টগ্রামের অনেক বিপ্লবীও সেই সময় কারারুদ্ধ হন। তখন বিপ্লবী সংগঠনের ছাত্রদের অস্ত্রশস্ত্র, সাইকেল, বইপত্র গোপনে রাখার ব্যবস্থা করতে হত। প্রীতিলতার নিকটাত্মীয় পূর্ণেন্দু দস্তিদার বিপ্লবী দলের কর্মী ছিলেন। তিনি সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত কিছু গোপন বই প্রীতিলতাকে রাখতে দেন। তখন তিনি সবে দশম শ্রেণির ছাত্রী। লুকিয়ে পড়ে ফেলেন বাঘা যতীন, ক্ষুদিরাম আর কানাইলালের জীবনের কথা। তখনও পর্যন্ত বিপ্লবী দলে মহিলা সদস্য গ্রহণ করা হয়নি। প্রীতিলতা যখন ঢাকায় পড়তে যান, তখন ‘শ্রীসঙ্ঘ’ নামে একটি বিপ্লবী সংগঠন ছিল, যার একটি মহিলা শাখা ছিল ‘দীপালি সঙ্ঘ’। লীলা নাগের নেতৃত্বে পরিচালিত এই সংগঠনে প্রীতিলতা যোগ দেন। লাঠি খেলা, ছোরা খেলা শেখেন।

১৯৩১ সালের ৪ ‌অগস্ট বিপ্লবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ফাঁসি হয়। এই ঘটনা প্রীতিলতাকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করে। এর পর আরও ন’মাস তাঁকে কলকাতায় থাকতে হয়েছিল বিএ পরীক্ষার জন্য। বাড়ি ফিরে এসে দেখেন বাবার চাকরি নেই, সংসারের অর্থকষ্ট মেটানোর জন্য তিনি শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। মাস্টারদা সূর্য সেন ও প্রীতিলতার প্রথম সাক্ষাৎকার বর্ণনাতে মাস্টারদা লিখেছেন, “তার চোখেমুখে একটা আনন্দের আভাস দেখলাম, এতটা পথ হেঁটে এসেছে তার জন্য কোনও ক্লান্তির চিহ্নই দেখলাম না।” ১৯৩২ সালে ১৩ জুন, ধলঘাট সংঘর্ষে কয়েক জন বিপ্লবী প্রাণ হারান। মাস্টারদা ও প্রীতিলতা পালাতে সক্ষম হন। পুলিশের জরুরি গ্রেফতারি তালিকায় প্রীতিলতার নাম ওঠে। মাস্টারদা তাঁকে স্কুল ছেড়ে দিয়ে পুরুষ বিপ্লবীদের মতো আত্মগোপন করার নির্দেশ দেন। কয়েক মাস পরেই ইউরোপিয়ান ক্লাবে বোমা ছোড়ার ঘটনায় নেতৃত্ব দেন প্রীতিলতা।

মৃত্যুর আগের দিন অজ্ঞাতবাস থেকে মা-কে লেখা তাঁর শেষ চিঠিতে মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে প্রীতিলতা লিখেছিলেন, দেশের স্বাধীনতা যজ্ঞে অনেক পুত্র প্রাণ দিয়েছে, কিন্তু কোনও কন্যা এখনও প্রাণ দেয়নি। তাঁদের অনুপ্রেরণা দিতেই মৃত্যুবরণ করছেন তিনি। তাঁর এই ত্যাগ, সমর্পণ হোক দেশের চলার পথে পাথেয়।

দিগন্ত চক্রবর্তী, জাঙ্গিপাড়া, হুগলি

অপমানের উত্তর

কিছু যন্ত্রণা, অপমান কেবল ভুক্তভোগীরাই জানেন। উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে গ্রামের যে ছেলে বা মেয়েটি এসেছে কলকাতার কলেজে পড়তে, কিংবা গ্র্যাজুয়েশনের পরে যে মেসে থেকে চাকরির প্রস্তুতি নেবে, স্টেশনে সাঁটা বিজ্ঞাপন দেখে মেস খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে যায় সে। মুখের উপর দরজা বন্ধ করে তাচ্ছিল্যের স্বরে মালিক জানান— “মুসলিমদের ভাড়া দিই না।” ছেলেটি ফিরে আসতে আসতে ভাবছে, এই মুসলমান-জন্ম তবে কি অভিশাপের মতো? দীর্ঘ ট্রেনযাত্রায় ক্লান্ত, প্রায় অভুক্ত। ভারী ব্যাগ কাঁধে আবার হাঁটা দিয়েছে অন্য কোনও ঠিকানায়। সে একটা অন্য সমাজকে চিনছে, একটু অন্য চোখে। ধর্মকেন্দ্রিক প্রতিবন্ধকতা বরাবরই ছিল, এখন যেন ক্রমশ তা বেড়েই চলেছে।

ফোনের ও-পারে মা। তাঁর সঙ্গে গ্রাম্য টানে কথা বলছে ছেলেটি। খেটে-খাওয়া মানুষের ভাষায়। তা নিয়ে হস্টেলে কত রসিকতা। তার উচ্চারিত ‘আব্বা’, ‘খালা’, ‘নানা-নানি’ শব্দগুলি যেন অচ্ছুত। ভাষার ব্রাহ্মণ্যবাদ তাকে বিদ্ধ করছে প্রতিনিয়ত। এ ছাড়া ইদানীং তার পরিচয়, সে ‘লুঙ্গিবাহিনী’র প্রতিনিধি। পাকিস্তান ম্যাচে সে খেলা থেকে দূরে থাকে। ক্রিকেটের ছুতোয় উগ্রতা আর ঘৃণার উদ্‌যাপন চলে। ছেলেটি কখনওই ভাবেনি যে, শুধু পেট্রলের দাম নিয়ে প্রশ্ন তুললে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানোর হুমকি দেবে বন্ধুরা। প্রথমে তার কাছে অচেনা ঠেকে বিষয়গুলো। তার পর মানিয়ে নেয়। সে হারছে না, হাল ছাড়ছে না। দাঁতে দাঁত চেপে ইতিহাস এবং সংবিধানটা ঝালিয়ে নিচ্ছে। ডব্লিউবিসিএস-এর সাফল্যই তার লক্ষ্য।

বাঙালিয়ানার প্রশ্নে, “তোরা কবে বাঙালি হলি?”-র আঘাতে জর্জরিত হয়ে যাওয়া ছেলেটি বাংলা ভাষার আঁচলের আশ্রয়ে থাকতে চায়। শক্তি-সুনীল আওড়ায়। বাংলায় লেখে, বাংলায় বাঁচে। উচ্চশিক্ষার বিষয়টিও বাংলা। অথচ, তার বন্ধুরা কত কালের পুরনো ধারণা পুষে রেখেছে উত্তরাধিকারে। ধরে নিয়েছে, বাংলা নয়, উর্দুই এদের প্রাণের ভাষা। এদের বাড়ির খবরের কাগজটাও উর্দু ভাষার। পেটের দায়ে বাংলা পড়তে হয়, তাই পড়ছে। ভাষা আন্দোলনের শহিদ রফিক, জব্বারদের অস্বীকার করে যে বাঙালি অংশ, তাদের চেপে রাখা বিদ্বেষ বেরিয়ে পড়ে অজানতেই। “বাহ তোরাও আজকাল কবিতা লিখছিস?” লিখতে এসে এমন প্রশংসাও জোটে।

বিড়ি শ্রমিকের মেয়েটি ডাক্তারি পড়ছে। রাস্তাঘাটে মাথায় ওড়না দেওয়াটা তার পারিবারিক সংস্কৃতি। তা নিয়ে হাসিঠাট্টা শোনে শহরে এসে। বোঝে, হাসিমুখে হাতে পরে নিতে হবে অধীনতামূলক মিত্রতার হাতকড়া।

এই ছেলেমেয়েরা মুখোমুখি হয় এই মানসিকতার— আমার ধর্মাচরণ বজায় রাখব, সেটাকে ‘সংস্কৃতি’ বলে চালাব, কিন্তু তোমায় ব্যক্তিজীবনে টুপি ছাড়তে হবে, ছাড়তে হবে নমাজ। নয়তো তোমার জন্য বরাদ্দ সমাজের পৃথক কোণ। আজান আর আরতির মিশে যাওয়ার মধ্যে নিহিত সে সম্প্রীতির ফাঁকিবাজি। সেই ফাঁকিবাজি দুই ইদের তফাত জানে না। শবেবরাত কী, এইটুকু জানার সময় বার করে উঠতে পারেনি। মহরমে শুভেচ্ছা পাঠায়, ‘হ্যাপি মহরম’। এই অংশই পড়শি দেশের ঘটনায় এ-পারের সংখ্যালঘুর কাছে কৈফিয়ত চায়। প্রশ্ন করে না, করাচি বা কুমিল্লার ঘটনায় এ দেশের মুসলিমদের কী অপরাধ?

এত কিছুর পরেও অপমান সাফল্য হয়ে ঝরে। এ বারের সর্বভারতীয় ‘নিট’ পরীক্ষাতেও মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের অসামান্য সাফল্য জনসমক্ষে এসেছে। ছ’শোর বেশি নম্বর পেয়েছেন প্রায় ২০০ জন, ৫৫০-এর বেশি নম্বর পেয়ে মেডিক্যাল কলেজগুলোতে এ বছর ডাক্তারি পড়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন ৫০০-র বেশি ছাত্রছাত্রী। আল আমীন মিশন, এবং তার মডেলে আরও নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ও তার বাইরেও সংখ্যালঘুদের সাফল্য অন্য মাত্রা পেয়েছে। সরকারি মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়েও কত অপপ্রচার। মাদ্রাসায় অমুসলিম শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতির দিকটি বেমালুম চেপে যাওয়া হয়। ত্রিমোহনী হাই মাদ্রাসার ছাত্র সাইনুল হক, যিনি হাই মাদ্রাসা পরীক্ষায় রাজ্যে প্রথম হয়েছিলেন, সর্বভারতীয় মেডিক্যাল পরীক্ষায় ভাল র‌্যাঙ্ক করেছেন৷ এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে। তবু প্রতিনিয়ত ‘মাদ্রাসা ছাপ’ বলে ছোট করার চেষ্টা হয়।

ডাক্তার-অধ্যাপক-অভিনেতা-লেখক হওয়ার চেষ্টাগুলো খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সাফল্য অনেক কিছুর উত্তর। বিনয়ের সঙ্গে এটুকু বুঝিয়ে দেওয়া যায়— ঘৃণার সাম্রাজ্য যত বড় হোক, যত সংগঠিত হোক সরিয়ে রাখার প্রচেষ্টা, তার মধ্যেই আমরা পেরেছি।

সেখ সাহেবুল হক, কলকাতা-৯৪

অন্য বিষয়গুলি:

Pritilata Waddedar History India
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy