ম্প্রতি এনসিইআরটি দশম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যক্রম থেকে মোগল ইতিহাসের পর্ব বাদ দিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রতীকী ছবি।
ইতিহাস যে চলমান বর্তমানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, তা অনস্বীকার্য। অথচ, সেই ইতিহাসকেই বদলে দিতে বদ্ধপরিকর বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার। সম্প্রতি ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং (এনসিইআরটি) দশম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যক্রম থেকে মোগল ইতিহাসের পর্ব বাদ দিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, পাঠ্যক্রম থেকে বাদ পড়ছে শিল্পবিপ্লব, গণতন্ত্র ও বহুত্ববাদ, বিভিন্ন সংগ্রাম ও আন্দোলন, গণতন্ত্রের বিপদ-সহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। নতুন ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষ থেকেই পাঠ্যের এই বদল কার্যকর হলেও, বস্তুত এর আগে এনসিইআরটি ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশের ২০২২-২৩’এর পাঠ্যক্রম থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাদ দিয়েছে। এর ফলে সিবিএসই-সহ সব শিক্ষা পর্ষদকেই সেই অনুসারে পাঠ্যক্রমে পরিবর্তন করতে গিয়ে বাদ দিতে হয়েছে মোগলদের সম্পর্কিত অধ্যায়। পাশাপাশি, একাদশ শ্রেণির পাঠ্যবই থিমস ইন দ্য ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে ‘সেন্ট্রাল ইসলামিক ল্যান্ডস’, ‘কনফ্রন্টেশন অব কালচারস’, ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভলিউশন’ ইত্যাদি অধ্যায়। সেই সঙ্গেই মোগল সম্রাটদের নানা কথাও উল্লেখ করা হয়েছিল এই অধ্যায়ে। তাঁদের শাসনকালের নানা নথিপত্র, রাজধানী, তাঁদের উপাধি-সহ নানা দিকের উল্লেখ ছিল সেখানে।
এই সময়ে স্থাপত্য, শিল্পবিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি, বস্ত্রশিল্পের বিস্তর উন্নতি হয়, যার নিদর্শন আজও মুগ্ধ করে যায়। শুধু তা-ই নয়, এই সময়ে সংস্কৃত, আরবি, গ্রিক প্রভৃতি ভাষায় রচিত বহু কাব্যগ্রন্থ ফারসিতে অনূদিত হয়। রামায়ণের ফারসি অনুবাদ করেন বদাউনি। ফৈজিকৃত মহাভারতের অনুবাদ গ্রন্থ রজ়মনামা সে যুগের একটি উৎকৃষ্ট গ্রন্থ। এ ছাড়া মহম্মদ শাহাবাদি, ফৈজি ও হাজি ইব্রাহিম যথাক্রমে কাশ্মীরের ইতিহাস, লীলাবতী ও অথর্ববেদ ফারসিতে অনুবাদ করেন। এ ছাড়া সুরদাস রচিত সুরসাগর, কবিরের দোঁহা সমূহ, মহম্মদ জয়সি রচিত পদ্মাবত, সাধিকা মীরাবাই রচিত ভজনগুলিও হিন্দি সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছিল। মোগল যুগে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার ও সাহিত্যের উন্নতিও ছিল উল্লেখযোগ্য। এ যুগে বাংলাদেশে বৈষ্ণব সাহিত্য ও মঙ্গলকাব্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে। বৈষ্ণব সাহিত্যগুলির মধ্যে কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত চৈতন্যচরিতামৃত, বৃন্দাবন দাস রচিত চৈতন্য ভাগবত এবং জয়ানন্দ বিরচিত চৈতন্যমঙ্গল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। মঙ্গলকাব্যগুলির মধ্যে মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল, ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল ছিল উল্লেখযোগ্য রচনা। মোগল যুগে কাশীরাম দাস মহাভারতের বঙ্গানুবাদ করেন। এ ভাবে আঞ্চলিক ভাষার যথেষ্ট প্রসার ঘটেছিল।
ইতিহাসের একটা ধারাবাহিকতা থাকে। সেই অনুযায়ী প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক, এই তিন পর্যায়ের ইতিহাস ধাপে ধাপে পড়তে ও জানতে হয়। ভারত সরকারের লক্ষ্য যদি হয় মোগল যুগের সমকালীন অন্যান্য সম্রাট ও রাজাদের ইতিহাস তুলে ধরা, তা হলে তা সাধুবাদযোগ্য, কারণ সমসাময়িক অনেক সাম্রাজ্যের কথা মোগল সাম্রাজ্যের আড়ালে থেকে গিয়েছে। সে সব স্বল্পপঠিত অধ্যায় উঠে আসুক, তবে মোগল সাম্রাজ্যের ইতিহাস বাদ দেওয়া হলে ভারতের মধ্যযুগের ইতিহাস সম্পর্কে একটা প্রজন্ম অজ্ঞ হয়ে থাকবে। কোন ঘটনার পর কোন ঘটনা ঘটল, এটা ধারাবাহিক ভাবে যদি শিক্ষার্থীদের না মনে থাকে, তা হলে সত্যিই ইতিহাসের জ্ঞান বলতে কিছু অবশিষ্ট থাকবে না।
শুভজিৎ বসাক, কলকাতা-৫০
দ্বন্দ্ব নেই
মোহিত রায়ের ‘একটা গণভোট হয়ে যাক’ (২৬-৪) শীর্ষক প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে এই চিঠি। প্রবন্ধকার লিখেছেন যে, কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা দেওয়াটাই নাকি সরকারের ‘সঙ্কীর্ণ’ মানসিকতার পরিচয়, বরং সেই অর্থরাশি দেশের দরিদ্র মানুষের কল্যাণে ব্যয় করা উচিত।
ভারতের সংবিধানের ৩০৯ নম্বর ধারার ভিত্তিতে সংসদে এবং বিধানসভায় পাশ হওয়া আইন এবং বিধিনিয়ম অনুযায়ী, সরকারি কর্মচারীদের নিয়োগ, বেতন ইত্যাদি নির্ধারিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে ভয়ানক মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি কর্মচারীদের বেতনের আসল মূল্যের অবক্ষয় রোধে মহার্ঘ ভাতা চালু হয়। তার পর গত সাত দশকে ভারতে সাতটি কেন্দ্রীয় বেতন কমিশন নিয়োগ হয়েছে, কোনওটাই মহার্ঘ ভাতা তুলে দেওয়ার পক্ষে সুপারিশ করেনি। কারণ, এই সাত দশকে মূল্যবৃদ্ধির হার বাড়তেই থেকেছে।
প্রবন্ধকারের মতে, অসংগঠিত শ্রমজীবীদের আয়ের ক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধির জন্য যে-হেতু কোনও ক্ষতিপূরণ নেই, তাই সংগঠিত ক্ষেত্রেও মহার্ঘ ভাতা তুলে দেওয়া উচিত। এটা যদি করতেই হয়, তা হলে দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, বিচারপতি, আইএএস-আইপিএস অফিসার, সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের সরকারি কর্মকর্তা বা আধিকারিকদের জন্যেই করা উচিত। এঁরা বর্তমানে ন্যূনতম ১.৫ লক্ষ থেকে ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত মাসিক বেতন পান।
দেশের আইন অনুযায়ী, সাংসদ-বিধায়করা নিজেরাই নিজেদের বেতন ঠিক করেন, মাঝেমধ্যে তাঁরা নিজেদের বেতন বাড়িয়েও নেন। বর্তমানে সাংসদ-বিধায়কদের মাসিক বেতন ১ লক্ষ টাকার বেশি। প্রবন্ধকার কিন্তু এই ক্ষমতার শীর্ষে উপবিষ্টদের উচ্চ বেতন বা মহার্ঘ ভাতা প্রাপ্তি নিয়ে নীরব। তাঁর আপত্তি শুধু আন্দোলনরত পশ্চিমবঙ্গের সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা প্রদানের ক্ষেত্রে।
সারা দেশে যদি কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারীরা ৪২ শতাংশ হারে মহার্ঘ ভাতা পান, পশ্চিমবঙ্গের সরকারি আমলাতন্ত্রের শীর্ষে বসে থাকা মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, অর্থসচিব-সহ আইএএস-আইপিএস আধিকারিকরা যদি ৪২ শতাংশ হারে মহার্ঘ ভাতা পান, বাকি রাজ্যগুলির সরকারি কর্মীরাও যদি ৪২ শতাংশের কাছাকাছি হারে মহার্ঘ ভাতা পান, তা হলে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি কর্মীরা মাত্র ৬ শতাংশ হারে মহার্ঘ ভাতা পাবেন কেন? গণভোট করতেই হলে এই প্রশ্নের ভিত্তিতে সেটা হওয়া উচিত। প্রবন্ধকারের মিথ্যা সমতার ভিত্তিতে তৈরি অযৌক্তিক প্রশ্নের ভিত্তিতে গণভোট করা অর্থহীন।
প্রবন্ধকারের লেখায় আর একটি বিভ্রান্তিকর উপাদান সরকারি কোষাগার সংক্রান্ত ওঁর ভ্রান্ত ধারণা। গরিব জনসাধারণের জন্য উজ্জ্বলা যোজনা বা লক্ষ্মীর ভান্ডারের মতো প্রকল্পে খরচ বাড়াতে হলে সেটা কেবলমাত্র সরকারি কর্মীদের বেতন কেটেই করতে হবে, এটা অপযুক্তি। সরকারি খরচের অপচয়ের অনেক নিদর্শন আছে, যেমন সরকারি টাকায় বিভিন্ন জেলায় ‘কর্মতীর্থ’ বানিয়ে এখন পাড়ার ক্লাবগুলিকে সেই সম্পদ হস্তান্তর করার কথা চলছে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র আজকাল নির্লজ্জ ভাবে পুজোআচ্চার পিছনেও টাকা ঢালছে। এগুলোই আসল অপচয়, যেগুলো কমিয়ে জনকল্যাণে খরচ বাড়ানো যেতে পারে।
এ ছাড়া কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের কর-রাজস্ব এবং অ-কর রাজস্ব বৃদ্ধির অনেক উপায় আছে। কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৯ সালে কর্পোরেট ট্যাক্সের হার এক ধাক্কায় অনেকটাই কমিয়ে দেয়, যাতে ফয়দা হয়েছে বড় কোম্পানির, শেয়ার বাজারের। ক্ষতি হয়েছে কোষাগারের, গরিব ও মধ্যবিত্তের। পশ্চিমবঙ্গ সরকার হালে স্ট্যাম্প ডিউটি এবং সার্কল রেট-এর হার কমিয়েছে, এতে রিয়েল এস্টেট ব্যবসার লাভ হয়েছে, ক্ষতি হয়েছে কোষাগারের। পশ্চিমবঙ্গে পাথর, বালি, মাটি, কয়লা ইত্যাদি প্রাকৃতিক সম্পদের খননে চুরি-তোলাবাজির ফলেও বিপুল পরিমাণ রাজস্বের ক্ষতি হয়। এই বিষয়গুলি প্রবন্ধকারের নজর এড়িয়ে গিয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের সরকারি কর্মীদের মহার্ঘ ভাতা বৃদ্ধির দাবিও ন্যায্য, গরিবকল্যাণে খরচ বাড়ানোর দাবিও ন্যায্য। এই দুই ন্যায্য দাবির মধ্যে আসলে কোনও দ্বন্দ্ব নেই, পশ্চিমবঙ্গ সরকার তার নিজস্ব রাজস্ব বৃদ্ধি করে দুটো ন্যায্য দাবিকেই মেটাতে পারে। প্রবন্ধকার এই সরল সত্যটিকে উপলব্ধি করতে না পেরে আন্দোলনরত সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে গরিব মানুষদের দ্বন্দ্ব বাধিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত।
সমীরণ সেনগুপ্ত, কলকাতা-৬৪
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy