প্রতীকী ছবি।
‘অনাদর’ (২-১) সম্পাদকীয়টির পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি কথা বলার আছে। পুত্রসন্তানের প্রতি আকাঙ্ক্ষা এবং কন্যাভ্রূণ হত্যা ভারতীয় সমাজের এক দীর্ঘকালীন লজ্জা। শিশুপুত্র ও শিশুকন্যার অনুপাতের অসামঞ্জস্য যে উদ্বেগজনক, সেটাও বলা বাহুল্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সম্পাদকীয়তে দোষারোপের তিরটা চিকিৎসক এবং চিকিৎসক সংগঠনের দিকে নিশানা করেছে।
১৯৯৪ সালের পিএনডিটি আইন এবং তার পরিবর্তিত এবং পরিবর্ধিত রূপে ২০১৪ সালের পিসিপিএনডিটি আইনে আল্ট্রাসাউন্ড ক্লিনিক, জেনেটিক ক্লিনিক প্রমুখ জায়গা, যেখানে মেডিক্যাল আল্ট্রাসাউন্ড বা অন্যান্য প্রযুক্তির ব্যবহার হয়, তার লাইসেন্সিং, ডাক্তার এবং মেশিন-সংক্রান্ত তথ্য, ও অন্যান্য নথিপত্র সংরক্ষণ সংক্রান্ত নিয়মাবলি রয়েছে। এই সংক্রান্ত যে সরকারি দফতর বা আধিকারিকরা আছেন, তাঁরা আইনবলে প্রভূত ক্ষমতাশালী। এত কড়া আইন সত্ত্বেও যদি কোনও ক্লিনিকে বেআইনি ভাবে ভ্রূণের লিঙ্গনির্ধারণ হয়, তা হলে তার দায়ভার অবশ্যই সেই দফতরের উপর বর্তায়। ২০১৪-য় পিসিপিএনডিটি আইন বলবৎ করা সত্ত্বেও যদি লিঙ্গ অনুপাত সন্তোষজনক না হয়, তা হলে এই আইনের কার্যকারিতা সম্পর্কে মনে হয় সরকারের ভেবে দেখা উচিত।
সম্পাদকীয় অনুযায়ী, চিকিৎসক সমাজ অসাধু ক্লিনিক নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করেছে। চিকিৎসক সংগঠনগুলি বার বার অভিযুক্ত চিকিৎসকের পাশে দাঁড়িয়েছে। এই তথ্যের সূত্র কী? অবশ্যই কোনও চিকিৎসকের উপর অন্যায় আক্রমণ নেমে এলে চিকিৎসক সংগঠনের উচিত সেই ব্যক্তি চিকিৎসকের পাশে দাঁড়ানো। কিন্তু কন্যাভ্রূণ হত্যার সঙ্গে জড়িত চিকিৎসকের জন্য, বা অন্যায়কারী ক্লিনিকের প্রতি চিকিৎসক সমাজ বা চিকিৎসক সংগঠন সহানুভূতিশীল, এই বক্তব্য কতটা যৌক্তিক? আসলে চিকিৎসকদের সহজে নিশানা করা যায়। তাই যে কোনও সামাজিক ব্যাধি বা প্রশাসনিক অদক্ষতার দায়ভার নিশ্চিন্তে তাঁদের উপর চাপিয়ে দেওয়া যায়। প্রশ্ন যদি করতে হয়, প্রশ্ন তোলা উচিত, বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো সরকারি আইন নিয়ে, প্রশ্ন তোলা হোক নিয়ামক সংস্থার অদক্ষতা নিয়ে, এবং ২০২৩ সালে এসেও আমাদের সমাজের পচাগলা মানসিকতা নিয়ে। মুষ্টিমেয় চিকিৎসকের অসাধুতার জন্য সামগ্রিক ভাবে চিকিৎসক সমাজ বা চিকিৎসক সংগঠনের দিকে আঙুল তোলা হলে তা এক জ্বলন্ত সামাজিক সমস্যার প্রতি সংবেদনশীলতার অভাবকে প্রকট করে।
সৌরভ তালুকদার, ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টর্স ফোরাম
সকলেই দোষী?
পুত্রসন্তানের আকাঙ্ক্ষা এবং কন্যাভ্রূণ হত্যা ভারতীয় সমাজের এক দীর্ঘকালীন লজ্জা। এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর বীজ নিহিত আছে ধর্মীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন মাপকাঠিতে, যার ভিত্তিতে আজও পুত্রসন্তান এবং কন্যাসন্তানকে একই চোখে দেখা হয় না। শিশুপুত্র ও শিশুকন্যার অনুপাতের অসামঞ্জস্য যে উদ্বেগজনক, সেই বিষয়ে আমরা সম্পাদকীয়র সঙ্গে একমত; কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সম্পাদকীয়টি চিকিৎসক সমাজ এবং চিকিৎসক সংগঠনকে দোষারোপ করেছে। কিছু চিকিৎসক অসাধু নন, সেই কথা আমরা কখনওই বলছি না। কিন্তু তাই বলে সমগ্র চিকিৎসক সমাজকে কলঙ্কিত করার অপচেষ্টাকে আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানাচ্ছি। সামগ্রিক ভাবে চিকিৎসকরা এবং আমাদের অ্যাসোসিয়েশন-এর সদস্য রেডিয়োলজিস্টরা পেশাগত ভাবে ‘ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কার’। তাঁদের দিকে আঙুল তোলা হলে সেটা তাঁদের সামাজিক সম্মান এবং পেশাগত নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর।
প্রতাপ চন্দ্র সাহা, প্রেসিডেন্ট, ইন্ডিয়ান রেডিয়োলজিক্যাল অ্যান্ড ইমেজিং অ্যাসোসিয়েশন
মেয়ের আদর
‘অনাদর’ শীর্ষক সম্পাদকীয় উদ্বেগজনক বার্তা বহন করছে। যদিও আমাদের দেশ লিঙ্গসাম্য নামক এক আপাত কঠিন পথে চলার চেষ্টা করছে, কিন্তু তার চেতনায় বিভিন্ন সমস্যা জমাট বেঁধে আছে। ভারতের এই লিঙ্গ-অসাম্য এক দিনে আসেনি। বিগত দু’দশকে প্রায় এক কোটি কন্যাভ্রূণ ভারতে হত্যা করা হয়েছে। ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ সংক্রান্ত বেআইনি চক্রও এ দেশে যথেষ্ট সক্রিয়। ১৯৯০ সালে আল্ট্রাসাউন্ড মেশিন আসার পর নারীবিদ্বেষে ও কন্যাভ্রূণ হত্যায় এক নতুন শৈল্পিক মাত্রা যোগ হয়েছে। প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লিঙ্গ নির্বাচনের আরও নানা পদ্ধতি বেরিয়েছে। ফলও মিলেছে। সবচেয়ে বড় প্রমাণ হরিয়ানার জিন্দ জেলাতে ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, হাজার জন ছেলে পিছু মাত্র ৮৭০ জন মেয়ের উপস্থিতি। হরিয়ানায় ছেলেদের বিয়ের জন্য বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে মেয়ের আকাল দেখা দিয়েছে, তাই মেয়ে আনা হয় পশ্চিমবঙ্গ, বিহার কিংবা সুদূর কেরল থেকে। অথচ, পুরুষতান্ত্রিক ভাবনাচিন্তার প্রবাহ মেনে নিয়ে আজ জন্ম হল যে কন্যাসন্তানটির, তার কিন্তু সারা জীবনে কোথাও মুক্তি নেই। আজও যে সব মহিলা কর্মসূত্রে উপার্জন করেন, তাঁদের বাড়ি ও কাজের জায়গা— দুই দিকের সমন্বয় সাধন করতে গিয়ে দ্বিগুণ, তিনগুণ পরিশ্রম করতে হয় এক জন পুরুষের তুলনায়। উপার্জনকারী পুরুষ তাঁর বাড়িতে যে সম্মান পান, তা এক জন উপার্জনকারী মহিলা কখনও পান না। মহিলাদের বাড়ির কাজের দায়িত্ব অধিকাংশটাই বহন করতে হয়, যার মধ্যে থাকে রান্না, ঘর পরিষ্কার, শিশু ও বয়স্কদের দেখাশোনা। তার পাশাপাশি থাকে কর্মক্ষেত্রে কাজের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করার চাপ। এটা সারা বিশ্বে সত্য হলেও ভারতের পরিস্থিতি আরও খারাপ। কারণ, লিঙ্গনির্ধারিত ভূমিকাগুলি ভারতীয় সমাজে আরও কঠোর ভাবে মেনে চলা হয়। এ বার আসি কেন কন্যাভ্রূণ হত্যার এত রমরমা। প্রাথমিক কারণগুলোর মধ্যে আছে বৈবাহিক যৌতুকপ্রথা। যে কারণে কন্যাসন্তানকে আজও পরিবারে বোঝা বলে মনে করা হয়। আজও পুত্রসন্তানকে ‘বংশপ্রদীপ’ বলে চিন্তা করার পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা বহমান। এই মানসিকতা অক্ষুণ্ণ রেখে কন্যাভ্রূণ হত্যা আটকানো এক প্রকার অসম্ভব। কন্যাভ্রূণ হত্যাই পিতৃতন্ত্রকে স্থায়ী আসনে প্রতিষ্ঠিত করছে। এ চিন্তার মূলে কুঠারাঘাত করতে হবে। কন্যাসন্তানকে আদর করে মাথায় তুলে না নিতে শিখলে অচিরেই জন্ম নেবে লিঙ্গ-ভারসাম্যহীন এক বিকলাঙ্গ সমাজ।
বিশ্বদীপ ভট্টাচার্য, অশোকনগর, উত্তর ২৪ পরগনা
রাজনীতি
গত এক বছরের বেশি দেখছি, বিভিন্ন কারণে সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক নেতাদের বাড়ি যাওয়ার প্রবণতা অনেক বেড়ে গিয়েছে। হয়তো সেটা সরকারি প্রকল্পগুলির সুবিধে নেওয়ার জন্য। আসলে কিন্তু সরকারের নাম করে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের দলগত আধিপত্যই ফলিয়ে যাচ্ছে, যা এর আগে বামপন্থীদের মধ্যে দেখেছি। এখনও তার অন্যথা হচ্ছে না। নির্বাচনের মাঝের সময়ে প্রতিটা সামাজিক কর্মসূচিতে রাজনৈতিক নেতা বা দলের অংশ নেওয়া একটা প্রথা হয়ে গেছে, যার ফলে কোনও কিছুই রাজনীতির গণ্ডি ছাড়িয়ে ‘নিরপেক্ষ’ তকমা পাচ্ছে না। একটা বড় ত্রিভুজ তৈরি হয়েছে, যেখানে রাজনৈতিক নেতা তাঁর দলকে কাজে লাগিয়ে ও সংবাদমাধ্যমকে প্রভাবিত করে মানুষকে সর্বদাই রাজনৈতিক চক্রব্যূহে ধরে রাখতে চায়।
এই রকম পরিবেশ অন্য কোনও রাজ্যে নেই। শাসক বা বিরোধী, সকলেই বুঝে গিয়েছেন যে, মানুষকে সমস্ত ব্যাপারেই তাঁদের কাজের মধ্যে যুক্ত করে নিজের আখের গুছিয়ে নিতে হবে, তা সেই মানুষের জন্য আর্থিক ভাবে কিছু ভাবা হোক বা না হোক। যদি কেউ এই অবস্থাকে মানুষের ‘রাজনৈতিক জাগরণ’ হিসাবে দেখেন, তিনি মূর্খ ছাড়া আর কিছুই নন।
অভিজিৎ চক্রবর্তী, বালি, হাওড়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy