স্বামী বিবেকানন্দ। —ফাইল চিত্র।
ইন্দ্রজিৎ রায় ‘নিজের উপর বিশ্বাস’ (১২-১) প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই ঈশ্বরে বিশ্বাসের প্রশ্নটি তুলেছেন। আমাদের এই দরিদ্র দেশে কোনও ব্যক্তির সফল হওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট অনিশ্চয়তা থাকে। তাই ঈশ্বরে বিশ্বাস আর কিছু চেষ্টার ফলে যখন সাফল্য আসে, তখন কৃতিত্বের সিংহভাগটা ঈশ্বরকেই দিয়ে দেওয়া হয়। হয়তো খানিকটা ভয়েই, সাফল্য হারিয়ে যাওয়ার ভয়। নিজের উপর বিশ্বাস কিছুটা নিজেরাই টলিয়ে দিই। আবার অনেক সময় অনায়াসে, কিছুটা ঘুরপথে সাফল্য আসে। সেখানে সাফল্য হারিয়ে যাওয়ার আরও বেশি ভয়। ঈশ্বরের হাতে পুরোটাই ছেড়ে দিই। এ ভাবেই ঈশ্বরের উপর বিশ্বাসের ভিত দৃঢ় হয় এবং প্রচার পায়, নিজের উপর বিশ্বাস হারায়। স্বামীজি তাই দৃঢ়কণ্ঠে বলেছেন নিজের উপর বিশ্বাস রাখার কথা।
ঈশ্বরবিশ্বাসীদের মধ্যে একটা স্ববিরোধ দেখা যায়। তাঁদের কাছে ঈশ্বর এক জন পরম পুরুষ। ভাবনায়, চিন্তায়, ক্ষমতায়, বিচার-বিশ্লেষণের সূক্ষ্মতায় তাঁর জুড়ি নেই। নেতা, মন্ত্রী, বিজ্ঞানী, পণ্ডিত, দার্শনিক, ডাক্তারদের চেয়ে বহুগুণে এগিয়ে। তা-ই যদি হয়, তবে তাঁর উপর এ ভাবেই বিশ্বাস রাখা উচিত যে, তিনি যা করবেন তা-ই করবেন। তাঁকে তোয়াজ করে কিছু বাগিয়ে নেওয়া যাবে না। তাঁকে বিশ্বাস করা হোক আর না হোক, তিনি আমাদের কর্তব্য বিষয়ে সঠিক পথ দেখাবেন। তাতেই জগতের কল্যাণ হবে। শিশু না কাঁদলে মা দুধ নাও দিতে পারেন, কিন্তু ঈশ্বর মায়ের চেয়েও অনেক বেশি বিবেচক, দুধের জন্য তাঁর কাছে কাঁদাকাটা করার দরকার নেই। কিন্তু সেই বিশ্বাসটাও ঈশ্বরবিশ্বাসীদের নেই। তাঁরা মনে করেন, তাঁকে ভজনা না করলে তিনি সহায়তা তো করবেনই না, বিপদও ঘটিয়ে দিতে পারেন। এতে সুবিধাও আছে। আমাদের আর কোনও দায় থাকে না, বিফলতার দায় তাঁর, যদিও ভোগ আমরাই করব।
স্বামীজির ঈশ্বরভাবনায় ঠিক এ রকম ঈশ্বর বিশ্বাস দেখা যায় না। এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন— আমি সমাজতন্ত্রী। তার কারণ এই নয় যে, সমাজতন্ত্রকে আমি একটা পরিপূর্ণ বিশুদ্ধ সমাজব্যবস্থা বলে মনে করি। কারণটা এই যে, উপবাস করার চেয়ে আধখানা রুটি মেলাও ভাল। একই মানুষের দল সব সময় সুখ বা দুঃখ ভোগ করে যাবে; তার চেয়ে বরং সুখ-দুঃখের একটা পুনর্বণ্টন হওয়াই ভাল। ভাল-মন্দের মোট পরিমাণ পৃথিবীতে সব সময় একই থাকে। নতুন নতুন ব্যবস্থার দ্বারা জোয়ালটা কাঁধ বদল করে মাত্র, আর কিছু নয়। সমাজের নীচের লোকটিও এই দুঃখময় পৃথিবীতে একটু সুদিনের মুখ দেখুক। এর ফলে এই তথাকথিত সুখের অভিজ্ঞতা পার হয়ে এরা সবাই এসে শেষ পর্যন্ত পরমেশ্বরের শরণ নেবে। এই পৃথিবী, তার গভর্নমেন্ট, তার আর যত সমস্যা সম্পর্কে এদের সকল মিথ্যা মায়ামোহ তখন কেটে যাবে।
হয়তো শেষের কথাগুলিতে তাঁর অভিমত— সমাজব্যবস্থাটাকে উন্নত করার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে এক দিন সকল দুঃখের অবসান ঘটে যাবে তা নয়, চিত্ত ও চেতনাকে ঈশ্বরভাবে ভাবিত করে তবেই তার নিষ্কৃতি। তবু আশ্চর্যের বিষয়, এই চিঠির মাঝেই তিনি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এই চার বর্ণের ক্রমান্বয়ে আধিপত্যের ভিত্তিতে সমাজ বিবর্তনের প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন।
তাঁর বিশ্বাসের কিছু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এ কথা স্বীকার করতেই হয় যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর এই সাধক সন্ন্যাসী ভারতীয় মনীষীদের ভিতরে সর্বপ্রথম শ্রেণিস্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজ বিবর্তনের ধারা অনুধাবন করার মতো বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন এবং সামাজিক পরিবর্তনের মূলসূত্রের ভিতর তিনি যে শ্রেণিস্বার্থের সন্ধান পেয়েছেন এবং সে কথা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রকাশ করেছেন, ভারতীয় সমাজদর্শনের ক্ষেত্রে তাঁর সেই মৌলিকত্ব অনস্বীকার্য।
দুর্গেশ কুমার পান্ডা, নরেন্দ্রপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
জিতেন্দ্রিয়
ইন্দ্রজিৎ রায়ের ‘নিজের উপর বিশ্বাস’ প্রবন্ধটির পরিপ্রেক্ষিতে এই পত্রের অবতারণা। স্বামী বিবেকানন্দের বহু উপদেশের কথা আমরা সাধারণ মানুষ তলিয়ে দেখি না বলে প্রায়শই ভুল ব্যাখ্যা করে বসি এবং জনমানসে তার প্রতিক্রিয়া হয় বিরূপ। বিবেকানন্দ যে আত্মবিশ্বাসের কথা বলেছেন, সেটি কেবল কর্মক্ষেত্রে দক্ষতা লাভের জন্য নয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার জন্য। এক জন প্রকৃত স্বাবলম্বী মানুষ বিফলতার জন্য কাউকে দায়ী করেন না, কিংবা সাফল্যের জন্যও আত্মপ্রসাদ লাভ করেন না। প্রবন্ধকার আত্মবিশ্বাস লাভের উপায় সম্বন্ধে দু’-চার কথা উল্লেখ করে দিলে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ যারপরনাই উপকৃত হতেন।
যা-ই হোক, কোনও কাজ ক্রমাগত অভ্যাস করতে করতে স্বাভাবিক নিয়মে নিজের উপর একটা বিশ্বাস জন্মে যায়। কিন্তু সেই আত্মবিশ্বাস সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য নাও হতে পারে। সাধারণ সর্বজনীন আত্মবিশ্বাস হল ভিন্ন প্রকৃতির, যা এক জন মানুষকে সর্বক্ষেত্রে শুধু আত্মপ্রত্যয়ই জোগায় না, স্থিতধী করে তোলে। জীবন তখনই সার্থক বলে বিবেচিত হয়। বিবেকানন্দের জীবনে আমরা সেই আত্মবিশ্বাস দেখেছি, আর তার মূলে ছিল শুদ্ধ জ্ঞান। মানুষ ছোট-বড় যে কোনও কাজ শ্রদ্ধা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে করতে করতে যে সত্যকে উপলব্ধি করেন, তারই নাম জ্ঞান। যিনি শ্রদ্ধাবান, একনিষ্ঠ সাধন-তৎপর এবং জিতেন্দ্রিয়, তিনিই সত্যিকারের জ্ঞান লাভ করেন। গীতার এই উপদেশের কথা কারও অস্বীকার করার জো নেই। এটি ছাড়া যে জ্ঞান লাভ হয়, তার সীমা এবং স্থায়িত্ব কত দিনের?
দক্ষতাজনিত সাফল্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমাদের আত্মবিশ্বাসের বদলে দাম্ভিক এবং ভোগবাদী করে তোলে। বিবেকানন্দের আত্মবিশ্বাস ছিল অপরিসীম। সেই সঙ্গে ছিল ঈশ্বরের প্রতি অবিচল ভক্তি। এ বিষয়ে ১৮৯৩ সালের ১৫ নভেম্বর শিকাগো থেকে দেওয়ানজিকে (হরিদাস বিহারীদাস দেশাই) লেখা চিঠিটি উল্লেখ করা যেতে পারে— “আই অ্যাম ডুয়িং দ্য লর্ড’স ওয়ার্ক, হোয়্যারএভার হি লিডস আই ফলো, ... হি হু মেকস দ্য ডাম্ব এলোকুয়েন্ট অ্যান্ড দ্য লেম ক্রস আ মাউন্টেন। হি উইল হেল্প মি। আই ডু নট কেয়ার ফর হিউম্যান হেল্প; হি ইজ় রেডি টু হেল্প মি ইন ইন্ডিয়া, ইন আমেরিকা, অন দ্য নর্থ পোল, ইফ হি থিঙ্কস ফিট। ইফ হি ডাজ় নট, নান এলস ক্যান হেল্প মি।” অর্থাৎ, বিবেকানন্দ এই সত্যটি আমাদের জানিয়ে দিলেন যে, ঈশ্বর চাইলে অসম্ভবকে সম্ভব করে দেন। তবে নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হয় প্রথমে। এখানে ফাঁকিবাজির কোনও জায়গা নেই। তা হলেই কোথাও আত্মবিশ্বাসের দেওয়ালে আর চিড় ধরার অবকাশ থাকে না।
স্বামীজি নিজেকে ঈশ্বরের যোগ্য পাত্ররূপে গড়ে তুলেছিলেন গভীর শ্রদ্ধা, একনিষ্ঠ সাধন-তৎপরতা এবং জিতেন্দ্রিয় গুণে। তাই প্রত্যেক বিষয়ে ছিল তাঁর সুগভীর জ্ঞান এবং নিজের উপর অটুট বিশ্বাস। আমরা সীমিত জ্ঞান দিয়ে বিবেকানন্দের ভাবধারাকে ধরতে পারি না বলে হামেশাই গোল বাধিয়ে বসি। যেমন, গীতাপাঠ এবং ফুটবল খেলা প্রসঙ্গে তিনি কি গীতাপাঠকে দূরে সরিয়ে দিতে বলেছেন? অবশ্যই নয়। বিকেলবেলা শিশুরা খেলাধুলা না করে ধর্মগ্রন্থে মাথা গুঁজে থাকবে, এটা কি কেউ চাইবে? শরীর ও মনকে সুস্থ এবং সুন্দর রূপে গড়ে তুলতে পারলে তবেই নিজেকে সুন্দর করে বিকশিত করা যায়। পরিতাপের বিষয় হল, আত্মপ্রচারমুখী মন আমাদের ভুল পথে নিয়ে গিয়ে তোলে।
বাবুলাল দাস, ইছাপুর, উত্তর ২৪ পরগনা
কন্যাদের বিপদ
‘বিপন্ন কন্যারা’ (১৯-১) সম্পাদকীয় প্রসঙ্গে কিছু কথা। ল্যানসেট-এ প্রকাশিত সমীক্ষাটি গভীর উদ্বেগের। অস্বীকার করার উপায় নেই, এখন কমবয়সি মেয়েদের মধ্যে পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সপ্তম-অষ্টম শ্রেণি থেকে ভাল-মন্দ বোঝার আগেই না বলে বাড়ি ছেড়ে অনেক মেয়ে চলে যায়। এই আশঙ্কায় অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন বাবা-মা মেয়েকে পাত্রস্থ করার তোড়জোড় শুরু করে দিচ্ছেন।
দীর্ঘ শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা সূত্রে আমার মনে হয়, এই সমস্যা নিরসনে পাঠ্যসূচিতে যৌনশিক্ষার একটি খোলামেলা পরিসর থাকা প্রয়োজন। স্কুল পাঠ্যক্রমে শারীরশিক্ষা বিষয়ে ‘ভাল স্পর্শ ও খারাপ স্পর্শ’ এবং ‘শিশুসুরক্ষা আইন’ সম্পর্কে সামান্য কিছু তথ্য ও আলোচনা আছে। এতে যৌনতার পূর্ণাঙ্গ ধারণা দেওয়া সম্ভব নয়। তাই পাঠ্যক্রমে বদল আনা প্রয়োজন। তা ছাড়া বিদ্যালয় শিক্ষার বাইরেও বেশ কিছু শতাংশ নাবালিকা রয়েছে, তাদের আরও তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। সমস্যা তাদের নিয়েও। সব মিলিয়ে, সত্যিই বিপন্ন এই রাজ্যের কন্যারা।
শুভ্রা সামন্ত, বালিচক, পশ্চিম মেদিনীপুর
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy