ইন্দ্রনীল দাশগুপ্তের ‘এগোতে পারল না পশ্চিমবঙ্গ’ (১৭-৪) শীর্ষক নিবন্ধ বিষয়ে এই চিঠি। লেখাটির শুরুতেই লেখক তৃণমূল সরকারের গত দশ বছরের সাফল্যের সঙ্গে পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকারের তুলনা টানতে গিয়ে ‘ভারতের মোট জিডিপিতে পশ্চিমবঙ্গের মোট জিডিপির অনুপাত কত’, সেই সূচকটির দিকে লক্ষ্য রাখলেন। এই সূচক সংখ্যাটি শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গের স্টেট জিডিপির উপর নির্ভর করে না। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের স্টেট জিডিপি বাড়লেও, এই অনুপাত সূচকটি কমতে পারে, যদি ভারতের মোট জিডিপির বৃদ্ধির হার পশ্চিমবঙ্গের স্টেট জিডিপির বৃদ্ধির হারের তুলনায় বেশি হয়। সুতরাং, এই অনুপাত সূচকটির মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের জিডিপির গতি মাপা ত্রুটিপূর্ণ পদ্ধতি, বিশেষত পূর্ববর্তী বাম জমানার সঙ্গে তুলনার পরিপ্রেক্ষিতে। পরিবর্তে আমরা যদি জিডিপির ইদানীং কালের (২০১৪-১৫ পরবর্তী) পরিমাপগুলি, যা ২০১১-১২ সালকে বেস ইয়ার ধরে করা হয়েছে, তাকে চেন ইনডেক্সের মাধ্যমে ২০০৪-০৫ বেস ইয়ারের প্রেক্ষিতে পরিবর্তিত করে নিই, তা হলে সহজেই বিগত ১৬-১৭ বছরের স্টেট জিডিপির বার্ষিক বৃদ্ধিকে তুলনামূলক ভাবে মাপা যাবে। আমি সেই হিসেব কষে দেখেছি যে, বাম জমানার শেষ দশ বছরে পশ্চিমবঙ্গের স্টেট জিডিপির বার্ষিক বৃদ্ধির হার ৬.৪৭ শতাংশ এবং তৃণমূল জমানায় তা ৬.৬৩ শতাংশ।
এনএফএইচএস-৩ সমীক্ষাকে (২০০৬) বেসলাইন এবং এনএফএইচএস-৪ সমীক্ষাকে (২০১৬) এন্ডলাইন ধরে আমার আর তনিশা ঘোষালের গবেষণালব্ধ কাজ পরিষ্কার দেখাচ্ছে— কন্যাশ্রীর উপভোক্তাদের মধ্যে বাল্যবিবাহের হার ৬.৭% কমেছে এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা সম্পূর্ণ করার হার ৬% বৃদ্ধি পেয়েছে (বিস্তারিত তথ্য দেখা যাবে এখানে: https://ideas.repec.org/p/wrk/warwec/1333.html)। উপাসক দাসের গবেষণা থেকেও দেখা যাচ্ছে যে, কন্যাশ্রীর জন্য মেয়েদের অনেক বেশি স্কুলমুখী করা গিয়েছে (https://papers.ssrn.com/sol3/papers.cfm?abstract_id=345515)।
মৈত্রীশ ঘটক তাঁর নিবন্ধে (‘উন্নয়নের কোন পথে বাংলা’, ১৪-৪) লিখেছেন যে, জাতীয় নমুনা সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে তৃণমূল জমানায় পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা দেশের গড়ের চেয়ে অধিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্য দিকে, একশো দিনের কাজের অগ্রগতিতে পশ্চিমবঙ্গ বাম জমানায় দেশের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা পাঁচটি রাজ্যের একটি ছিল, তৃণমূল জমানায় দেশের শীর্ষে থাকা পাঁচটি রাজ্যের অন্যতম হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। ইন্দ্রনীলবাবু রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া-র যে তথ্যসূত্রের ভিত্তিতে তাঁর সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন সেই তথ্যসূত্রই দেখাচ্ছে, বাম জমানার শেষ দশ বছরের গড়ের তুলনায় তৃণমূল জমানায় সামাজিক ক্ষেত্রে রাজ্য তহবিল থেকে ব্যয় প্রায় ২৩০% বৃদ্ধি পেয়েছে। ওই একই তথ্যসূত্র দেখাচ্ছে, তৃণমূল জমানায় রাজ্য সরকারের নিজস্ব তহবিল সংগ্রহ বেড়েছে ১৭৪ শতাংশ।
শুভাশিস দে
অর্থনীতি বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব ওয়ারিক, ইংল্যান্ড
মুছেছে ঘাটতি
২০০৫-০৬ সালে দেশের জিডিপি ২০০৪-০৫ মূল্য স্তরে ছিল ২৬.০৫ লাখ কোটি টাকা, পশ্চিমবঙ্গের জিডিপি ছিল ২.২২ লাখ কোটি টাকা— দেশের জিডিপির ৮.৫%। ২০১০-১১ সালে দেশের জিডিপি ছিল ৪৮.৯ লাখ কোটি টাকা, পশ্চিমবঙ্গের ৩.০৮ লাখ কোটি টাকা— অনুপাত কমে হয় ৬.৩%। বাম জমানার শেষ পাঁচ বছরের মধ্যেই দেশের জিডিপিতে পশ্চিমবঙ্গের অনুপাত ২.২ শতাংশ-বিন্দু কমে যায়। অথচ, ইন্দ্রনীলবাবু শুধু ২০১১-১২’র তুলনায় ২০১৮-১৯ সালে এই অনুপাত ০.৭% কমেছে, সেই তথ্যটি দিলেন। এক জন অর্থনীতিবিদ হিসেবে ওঁর এই কমে যাওয়ার ব্যাখ্যা দেওয়া উচিত ছিল। এই কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ পশ্চিমবঙ্গের জিডিপির ‘সরকারি ব্যয়’ উপাংশের একটা বড় অংশ ছিল ঋণ, এখনও আছে, তবে কমছে। আগের দশকে গড়ে ঋণের অঙ্ক ছিল জিডিপির ৪৬%। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তখন এফআরবিএম আইন চালু না করায় লাগামছাড়া ঋণ নেওয়া যেত। ঋণ বেশি নিলে জিডিপিও ফুলবে। ঋণ/জিডিপির অনুপাত যত কমছে, ততই পশ্চিমবঙ্গের জিডিপির ফাঁপা অংশটা পূর্ণ হচ্ছে। ২০০৫-০৬ সালে ঋণ ও জিডিপির অনুপাত ছিল ৪৯.৭%; সেটা ২০১০-১১’তে কমে হয় ৪২%; এবং ২০১৯-২০’তে ৩৫%। সেই কারণে দেশের জিডিপিতে রাজ্যের অবদানও কমছে। কিন্তু যদি দুই দশকের তুলনা করা হয়, ২০০৫-০৬ থেকে ২০১০-১১, এই ৫ বছরে রাজ্যের ঋণ ও জিডিপির অনুপাত ৭% কমলেও দেশের জিডিপিতে রাজ্যের ভাগ কমেছিল ২.২ শতাংশ-বিন্দু। কিন্তু ২০১১-১২ থেকে ২০১৯-২০, আট বছরে রাজ্যে ঋণ ও জিডিপির অনুপাত ৭% কমলেও দেশের জিডিপিতে রাজ্যের অবদান মাত্র ০.৫ শতাংশ-বিন্দু কমেছে।
লেখক বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের নিজস্ব রাজস্ব আয় (নিজস্ব কর+নিজস্ব কর বহির্ভূত আয়) বাম জমানার থেকে তৃণমূল জমানায় কমেছে— এটিও সত্য নয়। ২০০৩-০৪ সালে রাজ্যের নিজস্ব রাজস্ব আয় ছিল ৯৩৭৪ কোটি টাকা, ২০১০-১১ সালে সেটি বেড়ে হয় ২৩৫১০ কোটি টাকা। অর্থাৎ, ৭ বছরে বৃদ্ধি হয় ২.৫ গুণ। ২০১৮-১৯’এ সেটি বেড়ে হয় ৬৫৪৮৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ, পরের ৭ বছরে বৃদ্ধি ২.৮ গুণ। ২০১০-১১’তে রাজ্যের নিজস্ব রাজস্ব আয় প্রকৃত জিডিপির ৭.৬% ছিল; সেটি ২০১৮-১৯’এ বেড়ে হয় ৮.৮%।
এ ছাড়া, আগের আমলে ঋণের বেশির ভাগ অংশটাই ছিল রাজস্ব খাতে খরচ— বেতন-পেনশন ইত্যাদি। ২০১০-১১ সালে মোট ব্যয়ের মাত্র ৩.৬% মূলধনী ব্যয় ছিল। মোট ঘাটতির (রাজস্ব ও মূলধনী) মাত্র ১৩.৪৮% ছিল মূলধনী ব্যয়। এর ফলে রাজস্ব আদায়ের পথ সঙ্কুচিত হয়। পরের ১০ বছরে মূলধনী খরচ বেড়ে ২০১৯-২০’তে মোট খরচের গড়ে প্রায় ১০%-এ পৌঁছেছে। মোট ঘাটতির গড়ে ৬০% মূলধনী খরচ। অর্থাৎ, গত ১০ বছরে ঋণের একটা বড় পরিমাণ স্থায়ী সম্পদ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছে, যা আয়ের পথ প্রশস্ত করেছে। এ ছাড়া রাজ্যে সামাজিক ক্ষেত্রে খরচ ২০১০-১১’তে ছিল ৯.৩৮%, সেটা ২০১৯-২০’তে বেড়ে হয়েছে ১৮.৮৩%। একই সময়ে দেশে সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যয় কমেছে।
(তথ্যসূত্র: রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া)
বিশ্বজিৎ পান
কলকাতা-৫১
পতনের মাপ
ইন্দ্রনীল দাশগুপ্তের ব্যবহৃত তথ্যসূত্র আরবিআই হ্যান্ডবুক অব স্ট্যাটিসটিক্স অন ইন্ডিয়ান স্টেটস ব্যবহার করেই আমরা কয়েকটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি। প্রথমত, লেখক বলেছেন, ২০১১-১২ থেকে ২০১৮-১৯ অবধি সাত বছর ভারতের জিডিপিতে পশ্চিমবঙ্গের অবদানের অনুপাত কমেছে। ঘটনা হল, এই অনুপাত ছিল ৫.৯৬%, হয়েছে ৫.২৯%। এই তথ্যটি না জানালে পশ্চিমবঙ্গের ‘পতন’-এর মাপ সম্বন্ধে পাঠকের ভুল ধারণা হতে পারে। দ্বিতীয়ত, রাজ্যের কর ও কর-বহির্ভূত রাজস্ব আদায়ের বৃদ্ধির হারের যে হিসেব লেখক দিয়েছেন, তাতেও গোলমাল। আমাদের হিসেবে, কর রাজস্ব বৃদ্ধির হার ২০০৪-১১ পর্বে ছিল ১৩.৬%, ২০১২-২০’তে ১৩.৫%। এই পর্বে কর-বহির্ভূত রাজস্ব আদায়ের বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ৩৩.৩% ও ১৭.১%। এই পর্বে রাজ্যে সার্বিক রাজস্ব বৃদ্ধির গড় হার যথাক্রমে ১৩.৫৯% ও ১৩.৬%। তৃতীয়ত, মানবোন্নয়নের যে সূচকগুলি লেখক ব্যবহার করেছেন, সেগুলি আদৌ তুলনীয় নয়। যেমন, ২০০২-১০’র মধ্যে মৃত্যুহার ২০১০-১৬’র মধ্যে মৃত্যুহারের চেয়ে বেশি কমবেই, কারণ প্রথমটা আট বছরের হিসেব, দ্বিতীয়টা ছ’বছরের!
বিদেশ ঘোষ
নাগপুর, মহারাষ্ট্র
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy