Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
Students

সম্পাদক সমীপেষু: দায় নেই মা-বাবার

স্কুলের দায় নিয়ে আর একটা ভাল দিক আছে। জীবনের শুরু থেকেই লেখাপড়ার কাজ স্কুলের দায় হওয়ায় স্কুলের পাঠ্যক্রম, শিক্ষাক্রমকে ছাত্রছাত্রীরা অসম্ভব শ্রদ্ধা করে।

students.

প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

শেষ আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৪:৪৫
Share: Save:

সোনালী দত্ত তাঁর ‘অভিভাবকেরও দায় নেই কি’ (১-১২) প্রবন্ধে যে প্রশ্ন তুলেছেন, তার উত্তরে বলি, অভিভাবকের দায় নেই। বই-খাতা’সহ লেখাপড়ার সম্পূর্ণ দায় বিদ্যালয়ের শিক্ষকের। অভিভাবক যথাসাধ্য নীতিশিক্ষা দেবেন— বিদ্যালয়, শিক্ষক, শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থার কর্ণধার সরকারি, অসরকারি বা আধাসরকারি কর্তৃপক্ষকে সম্মান দিতে হবে, রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সম্মান দিতে হবে, মিথ্যাচার করবে না, চুরি করবে না, হিংসা করবে না, হিংস্র হবে না ইত্যাদি। যদিও এগুলোও বিদ্যালয়ের কাজ। অভিভাবকরা তো বড় জোর সংখ্যা পরিচয়, বর্ণপরিচয়, প্রকৃতিবিজ্ঞানের কিছু সহজ পাঠ দিতে পারেন খেলাচ্ছলে। নিরক্ষর অভিভাবকের পক্ষে তা-ও সম্ভব নয়। ভারতে এখনও এমন অভিভাবকের সংখ্যা কম নয়। এমন শিশুসন্তানও আছে, যাদের বাবা-মা দু’জনকেই কায়িক বা মানসিক শ্রমে প্রায় সারা দিন ব্যস্ত থাকতে হয়। উন্নত দেশগুলিতেও অধিকাংশ বাবা-মা’কেই কাজ করতে হয়। বাড়িতে অন্য কোনও অতিরিক্ত লোক থাকে না। সেখানে স্কুলই ভরসা। সকালবেলায় স্কুলে দেওয়ার পরে কাজের জায়গা থেকে বাড়ি ফেরার পথে সন্তান নিয়ে ফিরতে হয়। লেখক কেন স্কুলের এই দায় স্বীকার করতে চাইছেন না?

স্কুলের দায় নিয়ে আর একটা ভাল দিক আছে। জীবনের শুরু থেকেই লেখাপড়ার কাজ স্কুলের দায় হওয়ায় স্কুলের পাঠ্যক্রম, শিক্ষাক্রমকে ছাত্রছাত্রীরা অসম্ভব শ্রদ্ধা করে। আশির দশকে দেখেছি, ইংরেজি মিডিয়াম বা কনভেন্ট স্কুলে ছাত্রছাত্রীরা যা শিখত, তা-ই অভ্রান্ত বলে মানত। আমরা বাংলা মিডিয়াম দেশি স্কুলে অঙ্ক, ভাষা শিখে তাদের শেখাতে চেষ্টা করলে তারা কিছুতেই মানত না। আমাদের স্কুলের পোশাক, ড্রেস কোড, নিয়মনীতি, হাজিরাজনিত ঢিলেঢালা ভাব বা বদভ্যাস ওদের সঙ্গে মিলত না। ফলে আমাদের স্কুল নিয়ে ওদের ধারণা ভাল ছিল না বলাই যায়। তার পর প্রাথমিকে ইংরেজি ভাষা তুলে দিয়ে সে ধারণা আরও পোক্ত হল। সন্তানেরা বাংলা বা ইংরেজি, কোনও ভাষাই ভাল করে শিখতে পারল না। আর পাশ-ফেল উঠিয়ে দিয়ে শিক্ষকের দায় একেবারেই চলে গেল। সমাজ বাক্‌স্তব্ধ।

‘শিক্ষক-ছাত্র-সমাজ’ এই ত্রিভুজে অভিভাবকদের দায় জড়ানোর আগে সমাজের নির্বাচিত অভিভাবক জনপ্রতিনিধিদের দায় বিচার করতে ভুলে গেলেন প্রবন্ধকার? ভুলে গেলেন শিক্ষা-আধিকারিক, শিক্ষা বিষয়ক আমলাদের দায়? এ রাজ্যে শিক্ষা জগতে দুর্নীতির পাহাড়প্রমাণ অভিযোগ, খোদ শিক্ষামন্ত্রী, আধিকারিক জেলে রয়েছেন আর জনপ্রতিনিধিরা বিধানসভার সামনে থালা, কাঁসি বাজাচ্ছেন! কোনও সভ্য দেশ শিক্ষাব্যবস্থা বিষয়ে এমন দুর্দশার কথা ভাবতে না পারলেও আমরা এই রাজ্যে সেই ছবিই দেখছি। এর পরেও স্কুল বা সরকারের আংশিক দায় অভিভাবকদের উপরে চাপিয়ে দেওয়ার আগে বরং স্কুলগুলিতে ফাঁকা অস্বাস্থ্যকর ক্লাসরুম, দুর্বল পরিকাঠামো, অকারণে ছুটির বন্যা— ইত্যাদি বিষয়গুলির সংস্কার করার কথা ভাবা হোক।

শুভ্রাংশু কুমার রায়, চন্দননগর, হুগলি

স্কুলের গুরুত্ব

সোনালী দত্তের প্রবন্ধ প্রসঙ্গে এই চিঠি। বিদ্যালয়ে নিয়মিত উপস্থিত থাকার গুরুত্ব শিক্ষার্থীরা যেমন বুঝতে পারছে না, তাদের অভিভাবকদেরও যে এ বিষয়ে বিশেষ উদ্বেগ আছে, তেমনটাও মনে হচ্ছে না। অনেকেই গৃহশিক্ষকের ভরসায় স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। অন্য দিকে, এ নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একাংশের সামান্যতম দুশ্চিন্তা আছে বলেও দেখা যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের কাছে প্রশ্ন, শিক্ষার্থীরা কি শুধু পঠনপাঠনের কাজটুকু করতেই বিদ্যালয়ে যায়? সময়ানুবর্তিতা, সহযোগিতা, সহমর্মিতা, নিয়মানুবর্তিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, একাত্মতাবোধ, দলগত কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন, মূল্যবোধ ইত্যাদি অসংখ্য গুণাবলি আয়ত্ত করার সুযোগ শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়েই পেয়ে থাকে, যা ভবিষ্যতে তাদের কেরিয়ার গড়ার ভিত্তি অনেকটাই মজবুত করে দেয়।

তাই এত দিন পর্যন্ত ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক— সকলের কাছেই বিদ্যালয়ে নিয়মিত উপস্থিতির বিষয়টি পঠনপাঠনের সঙ্গে সমান গুরুত্ব পেত। কোনও ছাত্র বা ছাত্রী বিদ্যালয়ে কিছু দিন অনুপস্থিত থাকলে স্কুল কর্তৃপক্ষ তার বাড়িতে খোঁজখবর করতেন। অথচ, এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়কে উপেক্ষা করতে এখন আমরা অনেকেই কুণ্ঠিত বোধ করি না। আকাশচুম্বী উদাসীনতার পথ ধরে যে ঘুণপোকা এ রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থার শরীরে ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে, তা গোটা সমাজ ও পারিবারিক ব্যবস্থার সুস্থিতি আচমকাই নষ্ট করে দিতে পারে। আমরা সেই অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার অপেক্ষায় কেন বসে থাকব?

আমরা সকলেই জানি, সন্তানকে স্কুলে পাঠানোর পর বাবা-মায়েরা এমন বহু জটিল প্রশ্নের সম্মুখীন হন, যার সমাধান খুঁজে বার করা তাঁদের একার পক্ষে সম্ভব হয় না। সাংসারিক কাজের চাপ ও নানা পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির জন্য সেই জটিলতাগুলি উপেক্ষিতই থেকে যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সময়মতো সাবধানতা অবলম্বন করা সম্ভব না হওয়ায়, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিপত্তি ও বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পায়। পড়াশোনায় অমনোযোগ, বিদ্যালয়ে অনুপস্থিতি, অনৈতিক আচরণ করা, অপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য বা পোশাকের চাহিদা বৃদ্ধি, মোবাইল ফোনে আসক্তি, অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণের প্রবণতা বৃদ্ধি, কুসংস্কার, নেশা করা ইত্যাদি বিষয়ের ক্ষতিকর প্রভাব ছাত্রছাত্রীদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে বাধা দেয়। এই বিষয়গুলি অভিভাবকদের বুঝিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ করতে পারেন বিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষক-শিক্ষিকারা। এবং এ ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও মনোবিদদেরও সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে।

রতন রায়চৌধুরী, পানিহাটি, উত্তর ২৪ পরগনা

শিক্ষার অবনতি

সোনালী দত্তের প্রবন্ধ প্রসঙ্গে বলতে চাই, অভিভাবকের দায় নিয়ে আলোচনা প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয়। বিদ্যালয়-শিক্ষা গুরুত্ব হারাচ্ছে গৃহশিক্ষক ও কোচিং সেন্টারের কাছে। যাঁরা সত্যি পড়াতে চান, সেই বিষণ্ণ শিক্ষকদের মনোজগতের খবর কেউ রাখে না। শিক্ষকের দক্ষতা, আন্তরিকতা যেখানে পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান, সেখানেও ক্লাস নিয়ন্ত্রণ করাই কঠিন। আজ তো শিক্ষকের ফোঁস করারও উপায় নেই। এক সময় কলকাতার যে সব স্কুলে শিক্ষকেরা কড়া হাতে শিক্ষার্থীদের সামলাতেন, সেই স্কুলগুলির চাহিদা অভিভাবকদের মধ্যে খুব বেশি ছিল। এখন মনে হয়, ছাত্রদের কাছে বিদ্যালয় মূলত কিছুটা সমবায়ী উদ্‌যাপন এবং পরের শ্রেণিতে ওঠার সিঁড়িমাত্র। অভিভাবকদের সচেতন করে তোলার প্রস্তাব ভাল। কিন্তু সিমেস্টার পরীক্ষার খাতা অভিভাবক-সহ শিক্ষার্থীদের হাতে দেওয়া হবে, সেই প্রসঙ্গে অভিভাবকদের নিয়ে কিছু আলোচনা হবে— এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগে উপস্থিতির হার যথেষ্ট হয় না। প্রকৃত বিচারে বিদ্যালয় শিক্ষায় অভিভাবকদের কাঙ্ক্ষিত গঠনমূলক ভূমিকা তাঁদের বিবেচনায় অতখানি স্থান পায় না। শিক্ষা দফতর অভিভাবকদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে তা নিঃসন্দেহে ভাল। কিন্তু সাড়ে তিন দশকে যেখানে বার দুয়েক শিক্ষা দফতরের স্কুল পরিদর্শনের দৃষ্টান্ত মেলে, সেখানে শিক্ষা দফতরের কাছে এত সক্রিয়তা আশা করা যায় কি? সঙ্কীর্ণ পাঠ্যক্রম, পাশ-ফেলের অনুপস্থিতি ইত্যাদির মতো বিষয় বিদ্যালয়ের সুপরিবেশ রচনার মূল প্রতিবন্ধক। বিদ্যালয়ে শিক্ষা সহায়ক পরিবেশ রচনার এক স্তম্ভ পরিচালন সমিতি। পুরাতন ব্যবস্থায় এটি অনেকখানি কার্যকর ছিল। বর্তমানে সেই সমিতির ভরকেন্দ্র একটি সূত্রে বাঁধা— সবাই সেখানে হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মেলাতে ব্যস্ত। মুক্ত বিবেক, দায়বদ্ধতা, সমানুভূতির দেখা নেই। বৃহত্তর সমাজও উদাসীন।

তাপস সিংহ রায়, কলকাতা-৫৭

অন্য বিষয়গুলি:

Students Schools Parents
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy