খাদ্যসঙ্কট।
সম্পাদকীয় প্রবন্ধ ‘মৃত্যুক্ষুধা’ (২৭-৯) বাস্তবিকই এক জ্বলন্ত সমস্যার খতিয়ান হয়ে উঠেছে। কেবল খাদ্য ঘাটতি থেকে খাদ্যসঙ্কট তৈরি হয় না, এর জন্য খাদ্য বণ্টনের অসাম্য-সহ নানাবিধ সমস্যা দায়ী। অতিমারি, সংঘর্ষ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ২০১৯ সালে বিশ্ব জুড়ে তীব্র খাদ্য-নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন মানুষের সংখ্যা সাড়ে ৩৪ কোটি ছাড়িয়েছে, অতিমারির আগে যা ছিল সাড়ে ১৩ কোটি।
পরিবেশগত সমস্যার প্রভাবে সৃষ্ট অস্থিরতা খাদ্য ঘাটতিকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকা খাদ্য আমদানির উপর নির্ভরশীল। ইয়েমেন প্রয়োজনীয় খাদ্যের ৯০ শতাংশ আমদানি করে। এর ৩০ শতাংশ আমদানি হয় কৃষ্ণসাগর দিয়ে। অথচ, রাশিয়া ইউক্রেনে হামলার শুরুতেই কৃষ্ণসাগরের কয়েকটি বন্দর দখল করে নেয়। ফলে, ইয়েমেন এখন তীব্র খাদ্যসঙ্কটের মুখোমুখি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে ইরাকের মতো তেল রফতানিকারক দেশ জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে লাভবান হলেও, খাদ্যনিরাপত্তার অভাবের ঝুঁকি তারও রয়েছে। ইরাকে বছরে ৫২ লক্ষ টন গমের প্রয়োজন, মাত্র ২৩ লক্ষ টন গম উৎপন্ন করতে পারে। অনাহারের থাবা এখন বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই। আরও উদ্বেগ ভারতকে নিয়ে। ২০২০-তে বিশ্ব খাদ্য সূচকে ভারতের স্থান ছিল ৯৪তম, আর এখন ১১৬ দেশের বিশ্ব খাদ্য সূচকে ভারত নেমে এসেছে ১০১তম স্থানে। অনাহারের থাবা এখন ভারতের প্রায় সমস্ত রাজ্যে।
অনাহার, অপুষ্টিতে যখন মৃত্যুহার বাড়ছে, তখন দেশের নানা প্রান্তে ধনকুবেরের সংখ্যা বাড়ছে। তবে আশার আলো একটাই যে, নাগরিকদের জন্য খাদ্যের মান ও নিরাপত্তার নিরিখে রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিকে শক্তিশালী করে তোলার প্রয়াসের অঙ্গ হিসেবে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী মনসুখ মান্ডবীয় ‘ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ড অথরিটি অব ইন্ডিয়া’-র চতুর্থ খাদ্য নিরাপত্তা সূচক প্রকাশ করেছেন। এই সূচক দেশের নাগরিকদের নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহে সাহায্য করবে।
কুহু দাস , দশগ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর
জঞ্জালে খাবার
সম্প্রতি রাষ্ট্রপুঞ্জে জমা-পড়া সমীক্ষায় বিশ্ব জুড়ে খাদ্যসঙ্কটের এক ভয়াবহ ছবি প্রকাশ্যে এসেছে। ওই সমীক্ষায় প্রকাশ, বিশ্বে প্রতি চার সেকেন্ডে এক জনের মৃত্যু হচ্ছে শুধুমাত্র না খেতে পেয়ে। এই মুহূর্তে বিশ্বের ৩৪.৫ কোটি মানুষ তীব্র খাদ্যসঙ্কটে ভুগছেন। আমাদের দেশ-সহ আরও ৪৫টি দেশের কোটি কোটি মানুষের দিন কাটে অনাহারে, অর্ধাহারে।
বিশ্ব জুড়ে এর বিপরীত আর একটা ছবি দেখা যায়। বিলাসিতা ও আধুনিকতা দেখাতে গিয়ে (সামর্থ্য না থাকলেও প্রচুর ধার-দেনা করে), জাঁকজমকপূর্ণ বিয়ে ও নানা অনুষ্ঠানে বেহিসাবি অর্থ ব্যয় করে অতিথিদের জন্য দামি প্লেট সাজানো হয়, যার অধিকাংশই নষ্ট হয়। রেস্তরাঁতেও প্লেটের পুরো খাবার শেষ না করা অনেকের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। দূরপাল্লার ট্রেনগুলোতেও (যেখানে টিকিটের মূল্যের সঙ্গে খাবারের দাম ধরা থাকে) রোজ প্রচুর খাবারের অপচয় হয়। এমনকি বাড়িতে ফ্রিজবন্দি প্রচুর খাবার নষ্ট হয়। তা ছাড়া, সঠিক সংরক্ষণের অভাবে টন টন খাদ্যশস্য গুদামে পচে নষ্ট হয়। এত সব নষ্ট হওয়া খাবারের একটাই ঠিকানা, ডাস্টবিন!
একই সঙ্গে সমাজের আর একটা মর্মান্তিক ছবির সঙ্গে অনেকেই কম-বেশি পরিচিত। বেঁচে থাকার তাগিদে, এক শ্রেণির মানুষ আবর্জনার স্তূপের মধ্যে খুঁজে ফেরে বাসি-পচা খাবারের টুকরো! এক দিকে খাবার অপচয়ের উৎসব, অন্য দিকে অনাহার, অর্ধাহার, অপুষ্টিতে মৃত্যু। এ যেন ঠিক টাকার এ পিঠ আর ও পিঠ! সমাজে বেড়ে চলা অসাম্য ও মানসিকতার বদল না ঘটলে, সামনের দিন আরও ভয়ঙ্কর! কারণ, ক্রয়ক্ষমতা থাকলেই যে খাবার পাওয়া যাবে, সে নিশ্চয়তা নেই। শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক ঘটনাবলিই তার জ্বলন্ত উদাহরণ।
অরুণকুমার ঘোষ, কলকাতা-১২০
চাই আইন
ভাবতে অবাক লাগে, একবিংশ শতাব্দীতেও এই পৃথিবীর প্রায় আশি কোটি মানুষ প্রতি রাতে খিদে নিয়ে শুতে যান (‘খাদ্য সঙ্কটের মুখে দাঁড়িয়ে বিশ্ব, আশঙ্কা রাষ্ট্রপুঞ্জের’, ২৫-৯)। অনাহার, অর্ধাহার আর অপুষ্টি তাঁদের নিত্যসঙ্গী। পৃথিবীতে প্রতি ন’জনে এক জন ভুগছেন খাদ্য আর পুষ্টির অভাবে। ভারতও এই ক্ষুধার বলয়ের বাইরে নয়। অথচ বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ১৪০ কোটি টন খাবার নষ্ট হয়, বলছে রাষ্ট্রপুঞ্জের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বা এফএও। এই নষ্ট হওয়া খাবার বিশ্বে মোট খাদ্য জোগানের এক-তৃতীয়াংশ, যা দিয়ে প্রতি বছর ২০০ কোটি মানুষকে পেট ভরে খাওয়ানো সম্ভব। আর আমাদের দেশে মাঠ থেকে থালা পর্যন্ত খাবার পৌঁছনোর প্রতিটি স্তরেই খাদ্য নষ্ট হয়। আমাদের দেশে খাবার নষ্ট হয় মূলত দুই ভাবে— চাষ, ফসল সংগ্রহ, সংরক্ষণ আর সরবরাহের সময়ে, এবং খাবার বিক্রি, রান্না ও খাওয়ার সময়ে।
রাষ্ট্রপুঞ্জের পরিবেশসংক্রান্ত ওয়েবসাইট থেকে জানা যাচ্ছে, শিল্পোন্নত দেশগুলোতে বছরে খাদ্য নষ্টের মোট আর্থিক মূল্য ৬৮০০ কোটি ডলার। আর উন্নয়নশীল দেশে এর পরিমাণ ৩১০০ কোটি ডলার। ধনী দেশগুলিতে ভোক্তারা বছরে ২২ কোটি ২০ লক্ষ টন খাবার নষ্ট করেন, যা আফ্রিকায় সাহারার নীচে স্থিত দেশগুলোর মোট খাদ্য উৎপাদনের (২৩ কোটি টন) সমান। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় বছরে মাথাপিছু খাবার নষ্ট করার পরিমাণ প্রায় ১১৫ কেজি। এই ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, যে পরিমাণ খাবার দুনিয়া জুড়ে বর্তমানে নষ্ট করা হয়, তার এক-চতুর্থাংশও যদি বাঁচানো যায়, তা হলে তা দিয়ে ৮৭ কোটি ক্ষুধার্ত মানুষকে খাওয়ানো যাবে।
ভারতে খাদ্য অপচয়ের চেহারাটি অত্যন্ত বেদনার। এ দেশে উৎপাদিত খাদ্যের শতকরা ৪০ ভাগই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই অপচয় হয়ে যাওয়া খাদ্যের পরিমাণ প্রায় ৬.৭ কোটি টন। ভারতে বছরে দু’কোটি দশ লক্ষ টন গম নষ্ট হয়, যা অস্ট্রেলিয়ার বার্ষিক উৎপাদনের সমান। খাদ্য অপচয় অনৈতিক, অমানবিকই শুধু নয়, যে কোনও দেশের মানুষের পুষ্টি, উৎপাদনশীলতা, অর্থনীতির উপরেও বড় আঘাত। পর্যাপ্ত খাদ্য থাকলেও তা ক্ষুধার্তের কাছে পৌঁছয় না। কঠোর আইন প্রয়োগ করে খাদ্য নষ্টের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রয়োজন। আগামী দিনে এটাই শপথ হোক— সমাজের সর্বস্তরে খাদ্যদ্রব্য নষ্ট বন্ধ করে ক্ষুধা ও অপুষ্টির বিরুদ্ধে গণআন্দোলন গড়ে তুলব আমরা।
সুশীলা মালাকার সরদার, বসিরহাট, উত্তর ২৪ পরগনা
ইরানে ক্ষোভ
‘বিদ্রোহ আজ’ (২৮-৯) সম্পাদকীয়তে খুব সঠিক ভাবেই ইরানের নাগরিকদের, বিশেষত সে দেশের মহিলাদের ক্ষোভের কারণ ও চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এতে সে দেশের ধর্মগুরু আয়াতোল্লা খোমেইনির অঙ্গুলি সঞ্চালনে চলা ইব্রাহিম রাইসি সরকারের নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন, কর্মসংস্থান ও উন্নয়নের অভাব, অথনীতির শ্লথগতি, মহিলাদের অধিকার হরণ— এ সব নিয়ে পুঞ্জীভূত ক্ষোভেরও বিস্ফোরণ ঘটেছে হিজাব আইনের বিরুদ্ধে নাগরিক বিক্ষোভে।
দমনপীড়নের মাধ্যমে যুব সম্প্রদায়ের এই আন্দোলনকে বাগে আনার চেষ্টা করেছে সে দেশের মৌলবাদী সরকার। এর আগেও বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রনায়করা প্রতিবাদী নাগরিকদের উপরে দমনপীড়ন চালিয়ে তাঁদের প্রতিহত করেছে, তা সত্ত্বেও মাহশা আমিনির মৃত্যুতে জ্বলে ওঠা ইরান ইতিহাসে জায়গা করে নেবে। বলা হয়েছে, যে কোনও মৌলবাদই গণতন্ত্রের ও সাধারণ মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর। আসলে মৌলবাদকে পুষ্ট করে ফ্যাসিবাদ ডালপালা বিস্তার করে, যা মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে, যুক্তি-বুদ্ধি ধ্বংস করে দেয়। তা মানুষকে অমানুষেও পরিণত করে। ইরানের নাগরিকদের ক্ষোভ কার্যত এর বিরুদ্ধেও।
সোমা নন্দী, কলকাতা-৯
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy