—প্রতীকী চিত্র।
প্রেমাংশু চৌধুরীর ‘সাফল্যের কারখানায় অবসাদের সাইরেন’ (রবিবাসরীয়, ১০-১২) প্রবন্ধটি বর্তমান সমাজের ইঁদুর দৌড়ের বাস্তব ছবিটি তুলে ধরেছে। তবে, পড়ুয়ারা আত্মহত্যা করছে বা করতে বাধ্য হচ্ছে কেন— এর সদুত্তর মিলল না। একটা প্রজন্মের বেশ কয়েক জন মেধাবী, উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় কিশোর-কিশোরী বা সদ্য যুবক-যুবতী জীবনের জটিল অঙ্কে প্রবেশের আগেই নিজেকে শেষ করার চরম সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কেন? এর উত্তর দেওয়া প্রয়োজন ছিল। প্রবন্ধটি মনখারাপ বাড়িয়ে দেওয়া ও হতাশাক্লিষ্টদের মানসিক চাপ বাড়ানোর টনিক হিসাবে কাজ করবে। ও এ ভাবে মারা গিয়েছে, ও ওই ভাবে— এটা প্রচার করাও এক রকমের প্ররোচনা বটে। কোটা-কে ‘সুইসাইড সিটি’ তকমা লাগিয়ে প্রবন্ধকার কী বোঝাতে চাইছেন? কোটা পড়ুয়াদের স্বপ্ন গড়ার শহর, সেটাই থাক। একে ভবিষ্যৎ গড়ার শহর হিসাবে প্রচার করা হোক।
প্রতিটি কোচিং সেন্টারে মনোবিদ নিয়োগ ও তাঁদের ক্লাস আবশ্যিক করার সময় হয়েছে। পড়ুয়াদের সঙ্গে অভিভাবকদের বোঝা উচিত, জীবনে সাফল্য অর্জন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়াতেই সীমাবদ্ধ নয়। সাফল্য এক অন্তহীন যাত্রাপথ। ইচ্ছাপূরণের নামে সীমাহীন প্রত্যাশার চাপ নয়, কাঙ্ক্ষিত স্ট্রিমে পড়তে সুযোগ না পাওয়ায় জীবন থমকে দাঁড়ায় না বা থেমে থাকে না। ঘুরে দাঁড়ানোর নাম জীবন, আরও কঠিন লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়ার নাম সাফল্য।
সাধারণ মানুষের রক্ত ওঠা পরিশ্রমের ফসলে ফুলেফেঁপে ওঠা কোচিং সেন্টারের রমরমা ব্যবসার সঙ্গে নিট, জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষার কোনও বৈধ বা অবৈধ সংযোগ আছে কি না বা শিক্ষাব্যবস্থার কোনও ত্রুটি আছে কি না কিংবা জাতীয় শিক্ষানীতিতে কোনও ফাঁক আছে কি না— তার পর্যালোচনা প্রয়োজন। এত সরকারি-বেসরকারি স্কুল থাকা সত্ত্বেও অনলাইন ও অফলাইনে বহু পড়ুয়া যে কোচিং সেন্টারের উপর নির্ভরশীল— সেটাই আতঙ্কের। জাতীয় স্তরে এই রোগের চিকিৎসা না হলে দেশকে অনেক মূল্য দিতে হবে।
বিনয় কুমার পতি, খাতড়া, বাঁকুড়া
মনের খবর
প্রেমাংশু চৌধুরী তাঁর তথ্যসম্বলিত প্রবন্ধটি যথার্থই লিখেছেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু পড়ুয়া কোটায় পড়তে আসে। যাঁদের প্রচুর টাকা আছে তাঁরা তো ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার পিছনে অকাতরে টাকা ঢালছেন। কিন্তু যাঁদের অত টাকা নেই তাঁদেরও অনেকে শেষ সম্বলটুকু বেচে দিয়ে ছেলেমেয়েকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার লড়াইয়ে শামিল হয়েছেন। এত টাকা খরচ করে কোচিং দিয়েও ছেলেমেয়েরা সফল না হলে যে সমাজে মুখ দেখানোর উপায় থাকবে না, সে কথাও বাবা-মা শুনিয়ে থাকেন তাদের। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পড়ুয়ার মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে যেমন নজর দিচ্ছে, তেমনই অভিভাবকদেরও পড়ুয়াদের মনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা খুবই জরুরি। ছেলেমেয়েরা কতটা নিতে পারছে, কী শিখতে আগ্রহী, তা বোঝা দরকার। জোর করে কিছু চাপিয়ে দিলে তার পরিণাম ভেবে দেখা উচিত। সর্বোপরি, সহানুভূতি বা সহমর্মিতা নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ানোর খুবই প্রয়োজন। তা ছাড়া বাড়ির লোকজনকে ছেড়ে দীর্ঘ দিন দূরে অচেনা পরিবেশে থাকায় আর অত্যধিক প্রত্যাশার বোঝায় যে মানসিক চাপ তৈরি হয়, সেটাও আত্মহত্যার অন্যতম কারণ হতে পারে। তাই অভিভাবকদেরও কাউন্সেলিং করানো আবশ্যক।
প্রদীপ কুমার সেনগুপ্ত ব্যান্ডেল, হুগলি
মা-বাবাই পারেন
রবিবাসরীয়-তে প্রেমাংশু চৌধুরীর লেখাটি খুবই সময়োপযোগী। যেন এক চেনা মুখকে আরও গভীর ভাবে চিনতে শেখায়। কোটা আর নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের র্যাগিং-এ মৃত্যু মনস্তাত্ত্বিক দিকের দুই মেরুকে যেন এক মৃত্যুরেখায় যুক্ত করেছে। এক দিকে যেন সংশোধনাগারের সেল-বন্দি একাকী জীবনে নিজেকে চরম স্বার্থপর বানিয়ে শুধু সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ তৈরিতে বদ্ধপরিকর, আর বিপরীতে, সকলের সঙ্গী হওয়ার জন্য মুক্ত পরিবেশে মুক্ত মনের মানুষ হতে চেয়েও শেষ পর্যন্ত করুণ পরিণতি। দু’টি দু’রকম জীবন তৈরি করলেও কতকগুলো জায়গায় তাদের মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে— দু’টিতেই ছাত্রজীবনকে কারখানার কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার করা হয়, দু’টি জায়গাই আবার উন্নত পণ্য তৈরিতে বেশ নাম করেছে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করতে বাধ্য বা উদ্বুদ্ধ করাকে র্যাগিং বলতে বাধা কী। তাতে অনেকেই যুক্ত— কেউ সরাসরি কেউ বা অজানতেই। সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করতে মা-বাবারাও কিন্তু সেই ইঁদুর দৌড়ে শামিল। সেখানে কোথাও সন্তানদের ইচ্ছাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, আবার কোথাও দেওয়া হয় না। মনস্তাত্ত্বিক বা শিক্ষাবিদরা যতই উপদেশ দিন না কেন, আসলে মা-বাবার এই চাওয়ার শুরুটা কিন্তু সন্তানের জন্মের পর থেকেই। আমার সন্তান ওই শিশুটির মতো অত ছটফটে নয় কেন? ওর কি বুদ্ধি কম হবে? তিন বছর পার না হতে শিক্ষার নামে কারখানায় চালান করা। সেরা ইংরেজি বিদ্যালয়ে ভর্তি, পরীক্ষার প্রতিটা ধাপেই বুদ্ধির মাপজোখ চলে। সবাই সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে ব্যস্ত। প্রতিযোগিতার কারখানায় সন্তানকে চালান করা হয়, যাতে এমন একটা মস্তিষ্ক তৈরি হবে, যেটা আজীবন অর্থের জোগান দেবে। সেই দিয়ে বাড়ি হবে, গাড়ি হবে, সর্বাধুনিক সুখ কেনা যাবে। অতএব কোটা একটা নয়, অনেক তৈরি হবে, হস্টেলে র্যাগিং হবে— র্যাগিংময় জীবন হবে, মরণকূপে আত্মাহুতি হবে। সুতরাং, মন নিয়ে ব্যবসা বা জীবন নিয়ে ব্যবসা বন্ধ করতে পারেন একমাত্র মা-বাবারাই। তবে, প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতির দেশে ভিন্ন কথা ভাবাটাই বোকামি।
শুভেন্দু মণ্ডল, মধ্যপাড়া, নদিয়া
যন্ত্রমানব
প্রেমাংশু চৌধুরীর প্রবন্ধটি অতীব বাস্তবতার নিরিখে সুন্দর, নিখুঁত এবং মর্মস্পর্শী। বর্তমানে বহু পরিবারের মূল লক্ষ্য, ডাক্তারি পড়তে নিট, আর এঞ্জিনিয়ারিং পড়তে হলে জেইই মেন ও জেইই আ্যডভান্সড-এ ভাল র্যাঙ্ক করতে হবে। আর সেই সূত্রেই কোটার রমরমা। জানা গেল, পাক্কা ১০,০০০ কোটি টাকার বার্ষিক ‘অর্থনৈতিক ব্যবসা’ এখানে জড়িয়ে আছে। এখানকার বহু প্রাক্তনীও এই গালভরা কোচিং-ব্যবসা করে মহাসুখেই আছেন। কিন্তু ভবিষ্যতে মোটা বেতনের হাতছানিতে পড়ে প্রত্যেক বছর কত পড়ুয়া-প্রতিভাকে অঙ্কুর অবস্থায় এই পৃথিবী থেকে চিরকালের মতো সরে যেতে হচ্ছে, তার খবর কি আদৌ এখানে পড়তে আসা ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকরা রাখেন না? পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ক’বছরে কোটা-র বিভিন্ন সেন্টারে কোচিং নিতে আসা পড়ুয়াদের আত্মহত্যার হার ক্রমশ বেড়েই চলছে। তাই আজ কোটা-কে বলা হয় ‘সুইসাইড সিটি।’ তবে শুধু কোটা কেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এই ধরনের পড়ুয়া মৃত্যুর ক্রমবর্ধমান হার আমরা সংবাদমাধ্যমে প্রায়শই দেখতে পাই। উল্লেখ্য, কয়েক জন অভিভাবক এই পড়াশোনার বিষয়টিকে বিনিয়োগের আকারে চিন্তা-ভাবনা করেন। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতে গিয়ে লাভ-লোকসানের হিসাব কষতেই তাঁরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আক্ষেপ, অনুশোচনা আর হতাশায় মোড়া এই দুনিয়ায় সমাধানের পথই বা কোথায়, এই প্রশ্নই মনের গভীরে তোলপাড় করে চলে। একটা সময় আসবে যখন কিছু ছেলেমেয়ে বাস্তবে দু’-হাত ভরে টাকা রোজগার করবে ঠিকই, কিন্তু বাবা-মা-আত্মীয়পরিজন-সুস্থ সংস্কৃতি-চেতনাবোধ ভুলে রোজগেরে এক পূর্ণ ‘যন্ত্রমানব’-এ পরিণত হবে। এই পরিণতি যে কী করুণ, তা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছেন না কি এই তথাকথিত অভিভাবকরা? তাই বর্তমান অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে ‘ঠিক-বেঠিক’ মূল প্রশ্নটা গভীর ভাবে ভাবার সময় এসেছে।
শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, নবদ্বীপ, নদিয়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy