Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
Vote Workers

সম্পাদক সমীপেষু: খালি পেটে ভোট

এই বছর ভোটকর্মীদের পারিশ্রমিক ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে অনলাইনে পাঠানোর ব্যবস্থা হলেও ব্যাঙ্কব্যবস্থার গোলযোগে সকলে তা পেলেন না।

শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০২১ ০৫:০৪
Share: Save:

ভোট উৎসবে আমরা ভোটকর্মীরা চিরকালই ব্রাত্য থাকি। এই বছরও তার ব্যতিক্রম হল না। প্রায় দুটো দিন যে অবর্ণনীয় যন্ত্রণার মধ্যে আমাদের অতিক্রম করতে হয়, তা কখনও সংবাদমাধ্যমে প্রতিফলিত হয় না। তাই নির্বাচন কমিশনেরও দৃষ্টিগোচর হয় না। ফলে বছরের পর বছর ভোটকর্মীদের সমস্যা সমাধানহীন থেকে যায়।

এই বছর ভোটকর্মীদের পারিশ্রমিক ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে অনলাইনে পাঠানোর ব্যবস্থা হলেও ব্যাঙ্কব্যবস্থার গোলযোগে সকলে তা পেলেন না। ভোটের আগের দিন ভোটসামগ্রী সংগ্রহের কাউন্টারের সঙ্গে অফলাইনে পারিশ্রমিক দেওয়ার কাউন্টার হলেও ভিড়ের আধিক্যে যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হল, তাতে অনেক ভোটকর্মী বিনা পারিশ্রমিকেই ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে যেতে বাধ্য হলেন।

আমার ভোটগ্রহণ কেন্দ্র ছিল ভোটসামগ্রী সংগ্রহ ও প্রদান কেন্দ্র (ডিসি/আরসি) থেকে প্রায় ৪৫ কিমি দূরে। অত্যন্ত খারাপ রাস্তায় বাস মাঝপথে খারাপ হয়ে গেল। নির্বাচন আধিকারিকদের ফোন করে কোনও সদুত্তর পাওয়া গেল না। অগত্যা ভোটিং মেশিন-সহ দীর্ঘপথ হেঁটে যখন ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে পৌঁছলাম, তখন মধ্যরাত অতিক্রান্ত।

ভোটগ্রহণ কেন্দ্রটি ছিল একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। একটিমাত্র বাথরুম থাকলেও জলের কোনও ব্যবস্থা ছিল না। পুলিশ, সিআরপিএফ ও ভোটকর্মী মিলিয়ে দশ জনের ব্যবহারে অচিরেই তা নরককুণ্ড হয়ে উঠল। দূরবর্তী একটি টিউবওয়েল থেকে পানীয় জলের ব্যবস্থা হল বটে, কিন্তু মধ্যরাত্রে কোনও আহার্য পাওয়া গেল না। খালি পেটেই টিমটিমে আলোর নীচে মশার কামড় খেতে খেতে ভোটিং কম্পার্টমেন্ট, মক পোল-এর জন্য প্রস্তুতি ও আনুষঙ্গিক কাগজপত্র তৈরি করতে করতে ভোরের পাখি ডেকে উঠল। বিরতিহীন ভাবে সকাল সাতটা থেকে সন্ধে সাড়ে ছ’টা পর্যন্ত চলল ভোটগ্রহণ। কমিশনের তরফ থেকে খাবারের কোনও ব্যবস্থা ছিল না।

এজেন্টদের নানা বায়নাক্কা সামলে ভোট-মেশিন সিল করে যখন ভোটসামগ্রী জমা দেওয়ার কেন্দ্রে এসে পৌঁছলাম, ঘড়িতে তখন রাত এগারোটা বাজে। নির্বাচন কমিশন কিছু রুটে গাড়ির ব্যবস্থা করেছিল। আমি মাঝরাতে বাড়ি ফেরার গাড়ি পেলেও অনেক ভোটকর্মী তাও পেলেন না। তাঁদের সকালের জন্য অপেক্ষা করতে হল। অর্থাৎ, তাঁদের আরও একটা বিনিদ্র রাত্রি কাটল। নির্বাচন কমিশনের কাছে আলো, পাখা, বাথরুম, জল, খাদ্য ও যাতায়াতের ব্যবস্থা রেখে আগামী দিনে ভোটকর্মীদের ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে পাঠানোর অনুরোধ করছি।

কৌশিক চিনা, মুন্সিরহাট, হাওড়া

এমনও হয়?

গত ১০ এপ্রিল চতুর্থ পর্বের বিধানসভা নির্বাচনে অতি সংবেদনশীল কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ভাঙড়ে ১০০ শতাংশ মুসলিম ভোটার অধ্যুষিত একটি বুথে প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করে এলাম। সেখানে ভোট পড়েছে ৯১ শতাংশ। অথচ অশান্তি তো দূরের কথা, সারা দিন সামান্য জোরে আওয়াজ পর্যন্ত কেউ করেননি। ওই বিধানসভা কেন্দ্রের নিরিখে যাকে প্রায় বিস্ময়কর ঘটনা বলা যায়। বুথে চারটি প্রধান রাজনৈতিক দলের চার জন দায়িত্বশীল এজেন্ট কোনও রিলিভার না নিয়েই সারা দিন
একনিষ্ঠ ভাবে কর্মরত থেকে আমাদের ভোট পরিচালনায় সাহায্য করে গিয়েছেন। হয়তো সেই কারণেই এক জন ভোটারের ভোটদান নিয়েও বিতর্ক হয়নি। এমনতর অভিজ্ঞতা সত্যিই বিরল!

আমি আরও বিস্মিত হয়েছি, একে অপরকে সদা আক্রমণকারী মূলত তিনটি প্রভাবশালী দলের তিন জন পোলিং এজেন্টের মধ্যে বন্ধুসুলভ ব্যবহার দেখে। বলতে ভাল লাগছে, প্রিসাইডিং অফিসারের প্রথাগত দায়িত্বের ঊর্ধ্বে উঠে ভোট শুরুর প্রারম্ভে বন্ধুত্বের ও রাজনৈতিক হানাহানির অসারতার কিছু বাস্তব টোটকা তাঁদের মগজে হয়তো ঢোকাতে পেরেছিলাম। হ্যাঁ, ঝুঁকি নিয়েই। জানি না তাতে কাজ হয়েছিল কি না। তবে ফল যেন হাতেনাতে পেলাম। ভোটদান আক্ষরিক অর্থেই উৎসবে পরিণত হয়েছিল। ভোটারদের কেউ সমস্যায় পড়লে বা অজ্ঞতাবশত সামান্য বিভ্রান্ত হলেই তাঁরা সকলে মিলে ভোটার কোন দলের সমর্থক, তার মূল্যায়ন না করেই তাঁদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়াতে কুণ্ঠাবোধ করেননি, যা আমাদের কাজকে অনেক সহজ করে তুলেছিল। তাই হয়তো এত বিপুল ভোটদান! এজেন্ট ও স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, এত শান্তিপূর্ণ ভাবে এত বিপুল ভোটদান ওই বুথে তাঁদের স্মরণকালে এই প্রথম। ওঁরা দেখিয়ে দিলেন— সৎ ভাবে, শান্তিপূর্ণ উপায়েও ভোট দিয়ে গণতন্ত্রকে মর্যাদা দেওয়া যায়।

আসলে এ কথা চরম সত্য যে, রাজনীতির কারবারি নেতানেত্রীরা তাঁদের ক্ষুদ্র কায়েমি স্বার্থে মানুষের মাঝে কাঁটাতারের বেড়া তৈরি না করলে, হিংসা, দ্বন্দ্ব, ভেদাভেদকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করলে, বা অসহায়, অসচেতন মানুষদের মিথ্যা স্বপ্ন না দেখালে, অথবা বিভিন্ন টোপ ও লোভের ফাঁদে সরলমতি মানুষদের বিভ্রান্ত না করলে রাজনৈতিক হানাহানি ঘটানো সম্ভব হয় না।

তবে এ বারের ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনীর বলিষ্ঠ উপস্থিতি রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের কাছে নিশ্চিত ভাবে নাভিশ্বাসের কারণ হয়েছে। আমরা, যাঁরা ভোট পরিচালনায় সরাসরি যুক্ত, তাঁরা সকলেই বিষয়টি বিলক্ষণ জানি। গত পঞ্চায়েত (২০১৮) ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী দায়িত্বে থাকলে পশ্চিমবঙ্গে এত রক্তপাত, হিংসা, বুথ দখল, বিরোধীশূন্য গণতন্ত্রের বিপজ্জনক পরাজয় কি আমরা দেখতে পেতাম? তবুও তো কোচবিহারে প্রাণ গেল পাঁচ জন ভোটারের। ভোটারদের নিরাপত্তায় নিযুক্ত কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে এতগুলি মৃত্যু হল কেন? এর পিছনে ছিল কার প্ররোচনা?

তা সত্ত্বেও ভাঙড়-সহ অন্য কেন্দ্রের ভোটাররা শান্ত থেকেছেন, তা-ই বা কম কিসের! ভয় নিয়ে ভাঙড়ে ভোট করাতে গিয়েছিলাম। ফিরলাম এক অনাস্বাদিত অনুভূতি নিয়ে! এমনও তা হলে হয়।

কাজি মাসুম আখতার, কলকাতা-৩৯

ভিভিপ্যাট

আমার চাকরি জীবনে বেশ কিছু নির্বাচন প্রিসাইডিং অফিসার হিসেবে এই ইভিএম-এর মাধ্যমে পরিচালনা করেছি। কিন্তু ভিভিপ্যাট-এর প্রচলন হওয়ার পর বুথের অভ্যন্তরে ভোটারদের আচরণ দেখে আমার একটা কথাই মনে হয়েছে— ভোটারদের ভিভিপ্যাট নিয়ে আরও সচেতন করা প্রয়োজন। কারণ স্বল্পশিক্ষিত ভোটাররা এখনও তেমন সড়গড় হননি।

বুথের ভিতর দায়িত্ব পালন করার কারণে ব্যাপারটা আমি অনুভব করেছি বলেই বলতে পারছি। অনেক সময় ভোটার তাঁর পছন্দসই ব্যক্তিকে ভোট দেওয়ার জন্য ব্যালট ইউনিটের বোতামে চাপ দেওয়ার পর ভিভিপ্যাটের দিকে সঙ্গে সঙ্গে না তাকিয়ে সেই ব্যালট ইউনিটের বোতামের দিকেই তাকিয়ে থাকছেন। সামান্য কিছু ক্ষণের মধ্যে ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার জন্য তাঁর প্রদত্ত ভোটটি দেখতে না পেয়ে যখন ভিভিপ্যাটের দিকে তাকাচ্ছেন, তত ক্ষণে তাঁর প্রদত্ত ভোটের কাগজটি কেটে ভিভিপ্যাটের ড্রপবক্সে পড়ে গিয়েছে। কিন্তু ভোট দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে (সাত সেকেন্ড সময়ের মধ্যে) তিনি যদি ভিভিপ্যাটের দিকে তাকাতে পারেন, তা হলে পরিষ্কার দেখতে পাবেন, যাঁকে তিনি ভোট দিয়েছেন, তাঁর প্রদত্ত ভোট সেই ব্যক্তির ঘরেই জমা পড়েছে। এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহের, বা ভুল বোঝানোর অবকাশই নেই। ব্যাপারটা এতটাই বিজ্ঞানসম্মত যে, এখানে কারচুপির কোনও জায়গা নেই।

এই কারণে আমার মনে হয়, এখনও বেশ কিছু দিন, অর্থাৎ সাধারণ ভোটাররা যত দিন এই বিষয়ে সড়গড় না হচ্ছেন, তত দিন পর্যন্ত বুথ লেভেলে তাঁদের হাতেকলমে এই যন্ত্রের ব্যবহার সম্বন্ধে সচেতন করার প্রয়োজন আছে। তা হলেই রাজনৈতিক দলগুলোর ইভিএম সম্বন্ধে অপপ্রচার বন্ধ হবে।

সঞ্জয় কুমার মিশ্র, কলকাতা-১০

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE