—প্রতীকী ছবি।
ঈশানী দত্ত রায়ের ‘কারও কিছু যায় আসে না’ (২৫-১২) প্রবন্ধটি পড়ে জোসেফ অ্যাডিসনের ‘মিসচিফস অব পার্টি স্পিরিট’ (১৭১১) প্রবন্ধের কথা মনে পড়ে গেল। রাজনীতি কত নিখুঁত ভাবে নাগরিক জীবনকে পঙ্গু বানিয়ে দেয়, তা অ্যাডিসনের প্রবন্ধে বর্ণিত হয়েছিল। বর্তমানে শাসকের রাজনীতির প্রাথমিক লক্ষ্য, চেতনা বিকাশের সব দফতরকে দলীয় পার্টি অফিসে পরিণত করা। অসহায় মানুষদের সমস্যার স্থায়ী সমাধান না করে সাময়িক বাঁধ দেওয়ার চেষ্টা চলছে, তা-ও ভোট পাওয়ার লালসায়। ফলে মানুষ কোনও দিন স্বাবলম্বী হবে না, সারা জীবন শাসকের কাছে ভিখারি হয়ে থাকবে।
আসলে প্রবন্ধের যে শিরোনামটি ব্যবহৃত হয়েছে তা দেখিয়ে দেয়, এমন সহনশীলতা দেশের জন্য কতটা ক্ষতিকর। মানুষ যদি সব কিছু এ ভাবে বিনা যুক্তিতে মেনে নেয়, তা হলে সে তো ক্রীতদাস। তার কি বা সংবিধান, কি বা স্বাধীনতা? বিরোধিতা না থাকলে সমাজে দ্বন্দ্ব আসবে না, প্রগতি হবে না। নীরব হয়ে যাচ্ছে মানবিক সত্তা। সমাজ থেকে জীবন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। দেশ ক্রমশ মানবসম্পদে পিছিয়ে পড়ছে। গঠনগত উন্নতি কিছুই হচ্ছে না। সবাই ‘ইয়েস স্যর’ হলে আগামী দিনে গৃহযুদ্ধ অনিবার্য। তাই নেতিবাচক আলোচনাতে সময় নষ্ট না করে অরাজনৈতিক ভাবে পরিবর্তনের ডাক দেওয়া উচিত, যাতে মানুষের বিবেক ফিরে আসে। দুঃখের বিষয়, বর্তমানে এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী তো শুধুমাত্র মোমবাতির মিছিল করতেই ব্যস্ত। বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?
তন্ময় কবিরাজ, রসুলপুর, পূর্ব বর্ধমান
আয়নার সামনে
ঈশানী দত্ত রায়ের প্রবন্ধটি আমাদের সরাসরি আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। দিনের পর দিন সারা দেশে ও আমাদের রাজ্যে আমরা যে সব জ্বলন্ত সমস্যার সম্মুখীন হই, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে, সে সব যেন ধীরে ধীরে আমাদের গা-সওয়া হয়ে যাচ্ছে। সারা দেশে শাসকের চাপিয়ে-দেওয়া রাজনীতির চক্করে পড়ে মানুষ এখন সব কিছুই সয়ে চলেছেন নীরবে। জিনিসপত্রের আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, হঠাৎ নোটবন্দি, আধার কার্ডের সঙ্গে মোবাইল নাম্বারের লিঙ্ক, নির্দিষ্ট নির্দেশিকা ছাড়াই ভর্তুকিযুক্ত গ্যাসের সঙ্গে বায়োমেট্রিক তথ্য সংযুক্ত করার হিড়িক, এ সব নিয়ে জনসাধারণ তিতিবিরক্ত। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম এগুলো নিয়ে সরব হলেও, তা শীর্ষ কর্তাদের কর্ণগোচর হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। দেশের সমস্ত সাধারণ মানুষের অসুবিধা, দুর্ভোগ নিয়ে কেউ ভাবিত নন। প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, মিছিল, বিক্ষোভ, সমাবেশ হলেও আখেরে সুরাহা মিলছে কই? মানুষও তাই বুঝে গিয়েছেন, মেনে নেওয়া আর মানিয়ে চলাই এখন তাঁদের জীবনযাপনের পথ। আমরা দেখছি, গণতন্ত্রের নামে একনায়কতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশের আড়ালে ধর্মীয় বিভাজনের খেলা, উন্নয়নের উল্টো পিঠে দুর্নীতির কালাপাহাড়; নির্মম গণপিটুনি, মহিলা কুস্তিগিরদের প্রতি অশালীন আচরণ, বিচার ছাড়াই ‘এনকাউন্টার’-এ মৃত্যু নিয়ে শাসকের ঘোষিত ‘চৌকিদার’ নীরব। তা ছাড়া, শাসকের বিরুদ্ধে কথা বললে, রোষানলে পড়ে যে কোনও সময় শাস্তির খাঁড়া নেমে আসতে পারে। সেই ভয়ে মেনে নেওয়া, সয়ে চলাই শ্রেয় মনে করেন অনেকে।
অন্য দিকে, বিশ্ব জুড়ে দেখা যাচ্ছে, প্রতিটি দেশ নিজেদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষায় উদ্গ্রীব। পড়শি দেশের মানুষগুলোর কী হচ্ছে, তা নিয়ে তারা মোটেও উদ্বিগ্ন নয়, নিজেদের স্বার্থ দেখতেই ব্যস্ত। মানবজাতির পরিত্রাতা জিশু খ্রিস্টের জন্মস্থান আজ যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত। বিগত কয়েক মাস ধরে ইজ়রায়েল-হামাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের জেরে গাজ়ায় কয়েক হাজার শিশু-সহ প্রায় ২৩ হাজারের বেশি মানুষ নিহত, ২৩ লক্ষ মানুষ ঘরছাড়া, হাসপাতাল বন্ধ, জল, খাবারের তীব্র সঙ্কট। অথচ, বড়দিনে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে বসে হইহুল্লোড়, আনন্দ, ফুর্তি করে আমরা তো বেশ কাটিয়ে দিলাম। সহানুভূতি, সমানুভূতি, সহমর্মিতার কোনও ছবি আমাদের দেশ, কিংবা আমরা কেউই দেখাতে পারিনি। একটা সময় এই কলকাতার রাজপথ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ‘তোমার নাম, আমার নাম, ভিয়েতনাম’ প্রতিবাদী স্লোগানে ফেটে পড়েছিল। আজ সে সব কোথায়? এখন আমরা স্রেফ নীরব দর্শক হয়ে থাকতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমাদের জীবন তো বেশ কেটে যাচ্ছে। এক অদ্ভুত অসংবেদনশীল মনোবৃত্তি আমাদের তিলে তিলে গ্ৰাস করে ফেলছে।
অরুণ মালাকারকলকাতা-১০৩
প্রতিবাদী
‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গানটির শব্দ পাল্টে দেওয়ার প্রসঙ্গে রাজ্য তথা দেশের সাধারণ মানুষের সব কিছু সয়ে যাওয়ার নিদারুণ চালচিত্র তুলে ধরেছেন ঈশানী দত্ত রায়। প্রবন্ধটি পড়তে গিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকা-য় দু’দশক আগে প্রকাশিত একটা লেখার কথা মনে পড়ে গেল। এই সম্পাদকীয় পাতাতেই সেটি লিখেছিলেন অধ্যাপিকা সুমিতা চক্রবর্তী। তখন বিশ্বভারতীর মিউজ়িয়ম থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল চুরি হয়ে গিয়েছে। প্রশাসনের ঘাম ছুটে যাচ্ছে ঘটনার কিনারা করতে। তৎকালীন বিরোধী রাজনীতিকরা সরকারের মুণ্ডপাত করছেন। শেষে কিনা রবীন্দ্রনাথের নোবেল চুরি! এ কি মেনে নেওয়া যায়! চার দিকে ছিছিক্কার। এক শ্রেণির মানুষ লজ্জায় মাথা নত করেছেন। কেউ বা লজ্জায় মুখ ঢাকছেন। বাঙালিদের হৃদয় ও মস্তিষ্ক জুড়ে আত্মগ্লানির ঝড় বয়ে যাচ্ছে। তা সেই ভগ্ন মনোরথের দিনে সুমিতা চক্রবর্তী বলতে চেয়েছিলেন, নোবেল চুরি অবশ্যই একটা বড় ক্ষতি, কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি এবং মর্মন্তুদ ক্ষতি সে দিনের সোনালি চতুর্ভুজ সড়ক যোজনায় এক জন সৎ ও নির্লোভ প্রকল্প-ইঞ্জিনিয়ার সত্যেন্দ্র দুবের হত্যা। সেই সময়ে সত্যেন্দ্র দুবে ওই প্রকল্পের মধ্যে ঘটে যাওয়া দুর্নীতির প্রতিবাদ করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর দফতরে গোপন চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন দুর্নীতির বিষয়টি। প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে সেই চিঠি ফাঁস হয়ে গিয়েছিল, এবং খুন হতে হয়েছিল প্রতিবাদী মানুষটিকে। এ দিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পদকও ফিরে পাওয়া যায়নি। তবু প্রবন্ধকারের মতো অনেকে আজও মানুষের কাছে মানুষের জন্য প্রশ্ন করে যাচ্ছেন।
সব্যসাচী ধরসিউড়ি, বীরভূম
অন্য স্বর
‘কারও কিছু যায় আসে না’ প্রবন্ধটি নিয়ে কিছু বলার আগে ২০১৪-১৫ সালের সেই বিতর্কিত, সাড়া-জাগানো যারা আগুন লাগায় নাটকটির কথা বলতে হয়। একটি জার্মান নাটকের বাংলা অনুবাদ করেছিলেন নাট্যকার নবারুণ ভট্টাচার্য, পরিচালক ছিলেন সুমন মুখোপাধ্যায়। অ্যাকাডেমির মঞ্চে অভিনীত হয়েছিল। পরিচালককেও মূল্য দিতে হয়েছিল, তাঁর পরিচালনায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত নাটক রাজা লিয়ার প্রেক্ষাগৃহের অভাবে অনেক নাট্যপ্রেমী দেখতে পাননি। শিল্প-সংস্কৃতির কণ্ঠরোধ, কর্তৃপক্ষের বিষ নজরে পড়া, সব আমলেই হয়েছে। যেমন, অর্পিতা ঘোষের পরিচালনায় ‘পঞ্চম বৈদিক’-এর পশুখামার নাটকের শো বাতিলের চেষ্টা করা হয়েছিল। সফদর হাশমির রাজপথে করুণ মৃত্যুর মূল কারণ ছিল বিরোধী বার্তার প্রচার। এই দৃষ্টান্তগুলি প্রাসঙ্গিক, কারণ প্রতিষ্ঠান-বিরোধী, প্রতিবাদী কণ্ঠকে, সে যে মাধ্যমেই হোক না কেন, চিরতরে নির্বাপিত করা যায় না। প্রবন্ধকার রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক দমনপীড়ন এবং আমাদের অসাড়তার উল্লেখ করেছেন। সরকারের দুর্নীতি, ব্যর্থতার সামনে নাগরিক একেবারেই সরব হন না— এই মতও গ্রহণযোগ্য নয়। কৃষক আন্দোলনের সামনে সরকার নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল। আমাদের রাজ্যে অসদুপায়ে শিক্ষক নিয়োগের পর্দা ফাঁস হওয়ায় সরকারের অস্বস্তি বাড়ছে। ভোটের রাজনীতি দিয়ে উপভোক্তাদের পরিষেবা প্রাপ্তি বিচার্য নয়।
সুবীর ভদ্র, কলকাতা-১৫১
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy