গোটাটিকর গ্রাম এখন সিলেট শহরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। ফাইল ছবি।
সেবন্তী ঘোষের ‘হারানো ভিটার খোঁজ’ (১৭-৩) পড়ে কিছু কথা। আমার বাবা ১৯৪৭ সালে যে পথ ও সীমান্ত পেরিয়ে সপরিবারে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে এসেছিলেন, আমিও সেই সুতারকান্দি বর্ডার পেরিয়ে, সেই পথ ধরেই ২০১৯-এর ৮ জানুয়ারি পৌঁছলাম বর্তমান বাংলাদেশের সিলেটে। গোটাটিকর গ্রামে। কিংবদন্তি, গোটাটিকর গ্রামে সতীর গ্রীবা পড়েছিল। সেই গোটাটিকর গ্রাম এখন সিলেট শহরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।
আমার মেজদা ওই সময় ছিলেন বেঙ্গালুরুর মেয়ের বাসায়। দাদার স্মৃতিশক্তি অসাধারণ। দেশ ছেড়েছেন ১২ বছর বয়সে, কিন্তু গ্রামের বাড়ি-ঘর, লোকজন, প্রকৃতি তাঁর কাছে অক্ষয়, অব্যয়। আমাদের ভিটেটা বিক্রি হয়নি, ‘ভেস্টেড প্রপার্টি’। তবে চৌহদ্দিটা এখন সাদা মাঠ। বড় বড় ঘর আঁকা। কেউ যেন শক্ত ধাতুর সরু মাথা দিয়ে সীমানা টেনে দিয়েছে। ভাগ-বাঁটোয়ারা? একেবারে উত্তর প্রান্তে ব্যারাক গোছের চারটি ঘরের একখানা বাড়ি। এ বাড়িতে থাকেন দুলাল বা দুলু মিঁয়া। রসিক লোক। বাড়ির অদূরে সে কালের পুরোহিত শশীমোহন ভট্টাচার্যের ভিটে। তাঁর নাতি আছেন, বনজ্যোতি। তাঁদের সঙ্গে বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে কথা বলছি, এল দাদার ফোন।
— “কোথায় আছিস?”
— শশীভূষণ ভট্টাচার্যের বাড়ির উঠোনে।
— “দক্ষিণের দিকে একশো কদম যা, ধর ২৫/২৫, একটা পুকুর পাবি।”
তাই গেলাম, জানালাম পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছি।
— “পুকুর ভরা জার্মানি পেনা (কচুরিপানা), তিনটে বাঁশ দিয়ে পানা সরিয়ে আয়তক্ষেত্র বানানো হয়েছে। এর ভিতরের জল পরিষ্কার।”
— ঠিক তাই, ঠিক তাই!
— “পিছন ফিরে তাকা, একটা চালতা গাছ দেখতে পাচ্ছিস?”
আমি ইশারা করি বনজ্যোতিকে। কোথায় চালতা গাছ? বনজ্যোতি ইশারা করেন। আমি বলি, হ্যাঁ দাদা, মস্ত চালতা গাছ।
— “বড় বড় চালতা না রে?”
— হ্যাঁ, বেশ বড় বড় চালতা।
— “চালতা গাছে বাদুড় ঝুলছে?”
বনজ্যোতি বলেন, “ওই তো বাদুড়, অনেকগুলি।” ভাবি, কী আশ্চর্য কাণ্ড! সুদূর বেঙ্গালুরু থেকে ৮২-৮৩ বছরের দাদা সব অঙ্ক মিলিয়ে নিচ্ছেন এক-এক করে!
দাঁড়াতে পারি না, পাথরে বসে পড়ি। দেশত্যাগী সেই বালক অশীতিপর প্রবীণ আজ। বুঝতে পারি, আজও ঘুমে-জাগরণে দেশের মাটি মাঝে মাঝে তাঁকে অস্থির করে তোলে। তিনি আধুনিক শহুরে মানুষ, তবু তাঁর মনে গাঁয়ের জন্মভূমি, মানুষ, গাছপালা, জীবজন্তু— সব এখনও কেমন সজীব সাড়া দেয়!
অঙ্ক মিললেও অঙ্ক মেলে না যে!
উষারঞ্জন ভট্টাচার্য, উলুবারি, অসম
ত্রিমুখী লড়াই
ঈশানী দত্ত রায় লিখিত প্রবন্ধ ‘হেঁটে চলেছে একলা বৈশাখ’ (১৪-৪) আমাদের ভাবায়। শাস্ত্রকার মনু বলেছেন, মেয়েরা এক সময় পিতার ও পরবর্তী কালে স্বামী ও পুত্রের অধীন। যেন খোঁটায় বাঁধা এক গৃহপালিত দ্বিপদী। চারণভূমি তার আপন সংসার। সে সদাই অন্যের নির্দেশিত নির্ধারিত কর্তব্য করে চলে। এই পৃথিবীতে সে একা। সব থেকেও কিছু নেই।
ভাবনার জগৎও তার অন্যের লকারে তালা বন্ধ। সীতা তারা মন্দোদরী সাবিত্রী বেহুলা কোনও ব্যতিক্রমী নন। ঘরে বাঁধানো থাকে নকশা করা কাচের ফ্রেমে ‘তীর্থ পর্যটন নাহি প্রয়োজন যদি থাকে পতি পদে মন’। যত দায় বর্তায় মেয়েদের ঘাড়ে। সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। একা মহিলা শহরে ঘর ভাড়া পায় না। সন্দেহের চোখগুলো তার পিছনে পিছনে ঘোরে। কাজের জায়গায় ছলছুতোয় সুযোগ খোঁজে কিছু মানুষ। আপস করতে হয়, নয় কাজ হারাতে হয়।
শ্বশুরবাড়িতে পান থেকে চুন খসলে বাপের বাড়ি তুলনা টেনে খোঁচা। সবচেয়ে আপন জন বলতে যাঁকে বা যাঁদের ধরা হয়, তাঁরাও সহায় হন না। অর্থ উপার্জন ছাড়া গৃহকর্মও যে কম নয়, মান্যতা পায় না। গঞ্জনা লাঞ্ছনা নিগ্রহ নিত্য দিন। অসুস্থ হলে তো আরও অসহনীয় অবস্থা। সামান্য লেখাপড়া শিখে আর কী ভাবে নিজের পায়ে দাঁড়ানো যায়। সারা জীবন সহ্য করা ছাড়া উপায় থাকে না। ত্রিমুখী লড়াইয়ে নামতে হয় মেয়েদের। নিজের ঘর গোটা সমাজ আর নিজের স্বাধীন বোধ। সর্বত্রই ঘিরে রাখে এক মায়ার বাঁধন। কার উপর না রেগে ফোঁস করব ভয় দেখিয়ে! সবাই তো আমার আপনার জন। আমাকে ঘিরেই আছে। মেনে মানিয়ে নেওয়া ছাড়াও উপায় কী। হয়তো প্রবন্ধের বাচ্চা মেয়েটির মতো একটা মুখ বুজে থাকার পাঠ আপনা থেকেই শেখা হয়ে যায়। সেই শিক্ষা প্রথমে অনুকরণ, আর তার পর অভ্যাস শেষে তার প্রকৃতি হয়ে দাঁড়িয়ে যায়।
প্রতিমা মণিমালা, হাওড়া
একটি সংখ্যা
ঈশানী দত্ত রায় লিখিত প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। গনগনে আঁচে বসে থাকা বঞ্চনার পোস্টার সম্বলিত ছেলেমেয়েগুলোর ছবিটা সংবাদপত্রে দেখে মনের কোণে মেঘ জমে উঠেছিল। আমরা সবাই যখন নিজের মতো করে নিশ্চিন্ত ঠান্ডার আশ্রয়ে জীবনের পরিতৃপ্তিটুকু খুঁজে চলেছি, তখন ওরা কেউই চৈত্রের আগুনঝরা দিনেও ময়দান ছাড়বে না।
‘হিতবুদ্ধি হন্তারক এই কাল’ (দেশ, ৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৮) শীর্ষক প্রবন্ধে শাঁওলী মিত্র লিখেছিলেন, “...মানুষ তো যে-কোনও শিশুর মতন জন্মসূত্রে মানুষ হয় না। যেমন হতে পারে বাঘ কিংবা বাঁদর। যথার্থ মানুষ হতে গেলে কিছু গুণ আহরণ করতে হয়, চেতনার প্রসার ঘটাতে হয়। যে-চেতনার গর্বে গর্বিত হয়ে সে বলতে পারবে এই জন্যই পান্না হল সবুজ, চুনি উঠল রাঙা হয়ে। কত যুগ-যুগান্তরের তপস্যায় অসংখ্য নক্ষত্র রাজির মধ্যে পাক খেতে খেতে এই একটি গ্রহে জন্ম নিয়েছে ‘মানুষ’।”
সময়ের তালে পা ফেলে চলা সেই মানুষ যে আজ বড় একা। মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কথা আমরা ভুলেছি। আমাদের ‘ভাবনা কোণ’ ক্রমশ ছোট হতে হতে অন্ধকার চৌখুপিতে আবদ্ধ। আমরা এখন এক-একটা ‘ডিজিট’ কিংবা ‘সংখ্যা’র দাস। ছেলেবেলা-মেয়েবেলায় রেজ়াল্টের পাতায়, যৌবনে ওএমআর শিটে, পরিণত বয়সে ভোটবাক্সে, বিধানসভায়, লোকসভায়। সর্বত্র সংখ্যার জোরেই আমাদের উত্তরণ। একা একা পথচলা তাই বোধ হয় কখনও থমকে যায়। বুদ্ধ, চৈতন্য, হজরত মহম্মদ কেবলই বাণীর পাতায় ঠাঁই করে নেন।
সঞ্জয় রায়, দানেশ শেখ লেন, হাওড়া
একা ও সমষ্টি
ঈশানী দত্ত রায় এমন এক প্রাসঙ্গিক প্রসঙ্গকে সমষ্টি গঠনের দৃষ্টিভঙ্গিতে তুলে ধরলেন, যা এক কথায় অসাধারণ। ছেলেবেলার সেই গল্প একটা লাঠিকে সহজে ভাঙা যায় কিন্তু এক গুচ্ছ লাঠিকে কি ভাঙা যায়? ভাঙা যায় না। কারণ, এটাই তো মিলিত প্রচেষ্টা। ক্ষমতাসীন কেন্দ্রীয় সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলে এক সময় একটিমাত্র সংসদ ছিল, কিন্তু এখন তিন শতাধিক ছাড়িয়েছে। একলা চলা সমষ্টিতে রূপান্তরিত। ঠিক তেমন এই একলা নিয়েই চলা বৈশাখ বারোটা মাস বহন করে চলেছে। সে কিন্তু জানে না কোন মাসে কী সুখবর, কী দুঃখের সংবাদ বহন করে আনবে। তবু সে এগিয়ে চলে আপন নিয়মে, এটাই তো একলা থাকার পথ।
পিতা শুদ্ধোদন, সিদ্ধার্থর জীবনে সমস্ত রকম বিলাসিতা রাখলেও সমস্ত বস্তুগত ঐশ্বর্য যে জীবনের লক্ষ্য হতে পারে না, তা সিদ্ধার্থ উপলব্ধি করেন। তাই মোক্ষ লাভের জন্য সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। বৃদ্ধ মানুষ, অসুস্থ মানুষ, এক মৃত মানুষ এবং এক সন্ন্যাসীকে দেখেন। এক বারও না ভেবে তিনি সন্ন্যাস জীবন বেছে নেন। নিঃশব্দেই রাজৈশ্বর্য এবং রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করেন। দুঃখ নিবারণের পথে তিনি বোধিসত্ত্ব হলেন। এইটাই তো একলা চলার বৃহৎ সম্পষ্টিগত জীবন চেতনার পথ। ঠিক এই ভাবেই তো আমরা সবাই এগিয়ে যেতে পারি জীবনের চরম প্রাপ্তির লক্ষ্যে।
প্রদীপ মারিক, বারুইপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy