সম্প্রতি কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের আধুনিকীকরণের উদ্বোধনের জন্য প্রধানমন্ত্রী বারাণসী গিয়েছিলেন। এক জন ধর্মপ্রাণ মানুষ হিসাবে ঈশ্বরের কাছে যা যা করণীয়, তা তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন, আমরা প্রত্যক্ষ করেছি (‘রাতের কাশীতে জাগছেন তিনি, দেখালেন মোদী’, ১৫-১২)। কিন্তু ওই দিন মধ্যরাত্রে তিনি কাশী শহর ও বারাণসী রেল স্টেশনে সশরীরে উপস্থিত হয়ে পায়ে হেঁটে শহরের ও স্টেশনের পারিপার্শ্বিক অবস্থা সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন। বিষয়টি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ এবং অভাবনীয়ও বটে। যিনি নিজেকে দেশপ্রেমিক, দায়িত্ববান, সর্বোপরি ‘চৌকিদার’ হিসাবে পরিচয় দিতে আত্মশ্লাঘা অনুভব করেন, তাঁর এমন কাজ অপ্রত্যাশিত নয়। কিন্তু নাগরিক মনে খটকা লাগে অন্য জায়গায়। বারাণসী লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর অনেকটাই সময় অতিবাহিত হয়েছে। এক জন সাংসদ হিসাবে পুরো শহরের হাল-হকিকত জানার পক্ষে সময়টা কি খুব কম ছিল? রাতের কাশীতে জাগছেন তিনি, কিন্তু তাঁর আলোকচিত্রীরাও যে সেই কাজটি নিরলস ভাবে করে যাচ্ছেন, সে সংবাদটি অন্তরালেই থেকে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণের পর দেশের প্রতিটি মানুষের অভিভাবক যিনি, তিনি তাঁর পরিশ্রমের কাজগুলিকে বিজ্ঞাপিত করবেন কেন? ময়ূরকে দানা খাওয়ানো এবং সমুদ্রতীরে প্লাস্টিক কুড়োনোর সময় একই ভাবে ক্যামেরার লেন্স তাঁকে অনুসরণ করেছিল।
জানি না, এই রকম আত্মপ্রচার ইতিপূর্বে কোনও প্রধানমন্ত্রী করেছেন কি না! তবে অটলবিহারী বাজপেয়ী ছিলেন প্রচারবিমুখ। যে দেশে কৃষক আন্দোলন চলাকালীন মৃত কৃষকদের তথ্য, লকডাউনে পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যু, অথবা অক্সিজেনের অভাবে মুমূর্ষু রোগীর মৃত্যুর তথ্য অমিল থাকে, অথচ প্রধানমন্ত্রী প্রচারের সার্চলাইটটি নিজের দিকে ধরে থাকেন, সে দেশের নাগরিক হিসাবে আশঙ্কা হয়, আমাদের মতো সহায়-সম্বলহীন মানুষরা কতটা সুরক্ষিত!
রাজা বাগচি
গুপ্তিপাড়া, হুগলি
জয়ের জড়িবুটি
‘গঙ্গাস্নানে জপের মালা হাতে মোদী’ (১৪-১২)— বারাণসীতে পিটিআইয়ের এই ছবিতে প্রধানমন্ত্রীকে দেখতে পাচ্ছি জপের মালা। এক হাতে জপ করছেন, অন্য হাতে মঙ্গলঘট রেখেছেন, চোখ বুজে তারই পোজ়! ব্যক্তিগত ধর্মাচরণ প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে মানানসই কি না, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। নিন্দুকরা যা-ই বলুক, ও বিষয়ে কিছু বলতে চাই না। যা বলতে চাই, তা আলোকচিত্রের দৌলতে দেশের সর্বত্র ভাইরাল হয়েছে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, সামনেই উত্তরপ্রদেশের ভোট! ধর্মের আফিম খাইয়ে জিততেই হবে।
এ-হেন কৌশল একবিংশ শতাব্দীতে এসেও ব্যাপক ভাবে চলছে! আমরা অবাক হয়ে যাচ্ছি— ভারতবর্ষের চেহারা সুস্থতার দিকে, না কি অসুস্থতার দিকে— কোন দিকে এগোচ্ছে? সাধারণ মানুষ ধর্মীয় মাদক-জড়িবুটি কত দিন ধরে সেবন করে যাবেন?
বিবেকানন্দ চৌধুরী
কাটোয়া, পূর্ব বর্ধমান
জরুরি কাজ
সারা পৃথিবীতে এমন প্রধানমন্ত্রী আর দ্বিতীয়টি মেলা ভার, যেমন আমাদের নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী। ছোটবেলায় বাগদাদের খলিফা হারুন অল রশিদ সম্পর্কে বিচিত্র কাহিনি পড়েছি। তাঁর শাসনকালে বিজ্ঞান, সংস্কৃতি, ধর্ম, শিল্প ও সঙ্গীত— সব দিকেই প্রচুর উন্নতি ঘটে। তিনি নাকি নগরবাসীর দুঃখ-দুর্দশার খবর নিতে গভীর রাতে রাস্তায় হেঁটে বেড়াতেন। বর্তমানে আমাদের প্রধানমন্ত্রীও বারাণসীর রাস্তায়, রেল স্টেশনে গভীর রাতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অবশ্য একা নন, সঙ্গী উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। উদ্দেশ্য অতি মহৎ— কাশীর গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্পগুলি খতিয়ে দেখা, পবিত্র শহরে সম্ভাব্য শ্রেষ্ঠ পরিকাঠামো গড়তে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি রেল যোগাযোগ বাড়ানো ও পরিচ্ছন্ন আধুনিক যাত্রিবান্ধব রেল স্টেশন গড়ে তোলা। রাতের ঘুম নষ্ট করে এই সুসংবাদ স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে টুইট করে জানিয়েছেন রাত ১টা ১৩ মিনিটে। এক জন প্রধানমন্ত্রী আর কী-ই বা করতে পারেন? এমন মহৎ উদ্যোগের পরও কেউ কেউ মন্তব্য করছেন, “নিঃসন্দেহে স্টেশনটা ভাল দেখাচ্ছে, তা এটা আমরা কাকে বিক্রি করছি?” কারও টিপ্পনী, “নাটক বন্ধ করুন, গঙ্গা দিয়ে কত লাশ ভেসে গেল গুনে দেখেছেন কি?” বা “শহর ঘুরে দেখতে গিয়ে কি পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশা টের পেলেন প্রধানমন্ত্রী?” ইত্যাদি।
এ তো ভীষণ জ্বালা। কাজহারা পরিযায়ী শ্রমিকদের আজও কেন নতুন কর্মসংস্থান হয়নি, কেন সারা দেশের সব মানুষের দু’ডোজ় টিকাকরণ এখনও সম্পূর্ণ হয়নি, এ সব বিষয়ে মাথা ঘামানোর মতো সময় তাঁর কই? তিনি সর্বদা ব্যস্ত থাকেন জরুরি কাজে। যেমন, অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণ, বারাণসীতে বিশ্বনাথ মন্দিরের দেব দর্শনের জন্য রাস্তার সম্প্রসারণ, সেন্ট্রাল ভিস্টা প্রকল্পে প্রধানমন্ত্রীর বিলাসবহুল বাসগৃহ নির্মাণ, দেশের সম্পদ বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া, এই রকম আরও অনেক অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সে কারণেই তিনি বিরোধীদের তোলা প্রশ্ন তথা অভিযোগের উত্তর দিতে সংসদে ১২ মিনিটের বেশি উপস্থিত থাকতে পারেন না।
তাতে যদি দেশে বেকারত্ব বাড়ে, মানুষ নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হন, কৃষকরা আত্মহত্যা করেন, কৃষক আন্দোলনে এক বছর ধরে হাজার হাজার কৃষককে দুর্ভোগ পোহাতে
হয়, ৭০০ কৃষকের মৃত্যুও ঘটে, প্রধানমন্ত্রী কী করতে পারেন? তিনি তো দেশের কল্যাণে ঠান্ডার মধ্যে বারাণসীর পুণ্য গঙ্গায় স্নান সেরে মন্দিরে পুজো দিয়েছেন!
কুমার শেখর সেনগুপ্ত
কোন্নগর, হুগলি
ভোটের ধর্ম
‘ভোট আসিলে ধর্ম আসে’ (‘মূল্যবান’, ১৫-১২)— এই সম্পাদকীয় বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করি। আসন্ন উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে, ধর্মকে হাতিয়ার করে বিজেপি রাম মন্দির, কাশী-মথুরায় মন্দির তৈরি, তাজমহল ভেঙে শিব মন্দির তৈরির জিগির তুলছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ভোটকে সংহত করার উদ্দেশ্যে। আফগানিস্তানে তালিবান ক্ষমতা দখল করেছে, সেই জুজু দেখিয়ে তারা উত্তরপ্রদেশের হিন্দুদের ভয় দেখিয়ে ধর্মীয় মেরুকরণ করছে। দেশ ও রাজ্যের মানুষের সমস্যা— দারিদ্র, বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের সমস্যা, পানীয় জল, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মানুষের নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়ে কোনও বক্তব্য নেই বিজেপি নেতৃত্বের। উন্নয়নের কথার বদলে তারা মন্দির নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ তৈরি করছে। বস্তুত বিজেপির সাধারণ মানুষকে সাম্প্রদায়িকতা ছাড়া, অর্থনীতি এবং রাজনীতিগত ভাবে দেওয়ার মতো কিছু নেই।
এরই পাশাপাশি কংগ্রেস একটু অন্য সুরে নরম সাম্প্রদায়িক রাজনীতি চালিয়ে এসেছে। কংগ্রেসই বাবরি মসজিদের তালা খুলে বিতর্ক উস্কে দিয়েছে, তাদের নেতা-নেত্রীরা মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি করেছে; এখন ভোট বৈতরণি পার হতে রাহুল গাঁধীও নিজেকে হিন্দু সাব্যস্ত করতে ব্যস্ত। জাতপাতের রাজনীতি নিয়ে আঞ্চলিক দলগুলো ওই একই পথের পথিক। সম্পাদক যথার্থই বলেছেন, “আসমুদ্রহিমাচল প্রায় সকল দলই এই দোষে দোষী।”
ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ধর্মবিশ্বাসী মানুষ নিজ নিজ ধর্মাচরণ করবেন, এটাই স্বাভাবিক। অথচ, ভোট রাজনীতির কারবারিরা ভোটযুদ্ধের খোলা ময়দানে ধর্মকে ব্যবহার করে দেশকে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে কলুষিত করছেন, বিভেদ-বিদ্বেষ সৃষ্টি করে সাধারণ মানুষের ঐক্যকে বিনষ্ট করছেন। সমস্ত গণতন্ত্রপ্রিয়, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে এর বিরুদ্ধে সরব হতে হবে।
স্বপন মুনশি
দুর্গাপুর, পশ্চিম বর্ধমান
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy