মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপির ‘মিশন বাংলা’ রুখে দেওয়ায় গেরুয়া শিবির মুষড়ে পড়েছিল। মোদী-শাহ জুটির ক্যারিসমা নিয়ে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা সন্দিহান হয়ে উঠেছিলেন। পাঁচের মধ্যে চারটি রাজ্যে গেরুয়া শিবির নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ফিরে আসায় সে সব জল্পনার অবসান ঘটেছে। সাঁইত্রিশ বছর পর গো-বলয়ের সবচেয়ে বড় রাজ্য উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথ পর পর দু’বার মুখ্যমন্ত্রীর আসন ধরে রেখে রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। প্রায় চার মাস ধরে উত্তরপ্রদেশে ঘাঁটি গেড়ে উচ্চগ্রামে প্রচার চালিয়ে প্রধানমন্ত্রী প্রমাণ করে দিয়েছেন, ‘মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়’। কৃষক আন্দোলন, হাথরস-উন্নাওয়ের ঘটনা, লখিমপুর-খেরি কাণ্ড, মূল্যবৃদ্ধির ছ্যাঁকা, লাগামছাড়া বেকারত্ব, বেওয়ারিশ গরু-মহিষের দৌরাত্ম্যে ফসল নষ্ট, কোনও কিছুই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতায় ছাপ ফেলতে পারেনি। জাতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেসের বেহাল দশা আর এক বার বেআব্রু হয়েছে, রাহুল-প্রিয়ঙ্কার নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
অপর দিকে পঞ্জাবে কোন্দলে জর্জরিত কংগ্রেসের ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়াটা ছিল সময়ের অপেক্ষা। আপ-এর পঞ্জাব দখল দেশের রাজনীতিতে নতুন ভাষ্য রচনা করেছে। তৃণমূল কংগ্রেস প্রত্যাশিত ভাবে গোয়াতে কংগ্রেসের ভোট ব্যাঙ্কে ভাঙন ধরিয়ে বিজেপির গরিষ্ঠতা পেতে সাহায্য করেছে। উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের বিপুল জনাদেশ ২০২৪ সালে দিল্লির মসনদে ফেরার গ্যারান্টি কার্ড বলে গেরুয়া শিবিরে প্রত্যয়ের জন্ম দিয়েছে।
অতঃ কিম্! তবে কি নয়া কলেবরে কৃষিবিল ফিরে আসা কেবল সময়ের অপেক্ষা? ব্যাঙ্ক, বিমা-সহ বিবিধ রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বেচে ‘মনিটাইজ়েশন’-এর প্রচেষ্টায় গতি ফিরে পাওয়া? এই গেরুয়া ঝড় কি তবে এনআরসি, সিএএ-র দ্রুত বাস্তবায়ন, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি, বিধানসভা ও লোকসভার ভোট এক সঙ্গে করার ছাড়পত্র? নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ফল শুভ হলে দশের মঙ্গল, দেশেরও।
সরিৎশেখর দাস
ব্যারাকপুর, উত্তর ২৪ পরগনা
ভোটের ভাগ
‘জয়রথ’ (১৪-৩) সম্পাদকীয় প্রসঙ্গে বলতে চাই, উন্নাও, হাথরস, লখিমপুর উত্তরপ্রদেশেই অন্তর্গত। উত্তরপ্রদেশের জনমত আদিত্যনাথ যোগীর পক্ষেই এল। তা কি সুশাসনের জন্য? না, বিরোধী দলগুলোর চরম হঠকারিতা এর জন্য দায়ী! নিজেদের সীমাবদ্ধতা জানা সত্ত্বেও ‘একলা চলো’ নীতিকে অযথা আঁকড়ে থাকার অবশ্যম্ভাবী ফল অত্যাচারী শাসকের সাফল্য। অধিকাংশ আসনে ভোট ভাগের ফয়দা তুলে নিয়েছে যোগীর দল! সংখ্যার নিরিখে দেখা যাচ্ছে, সদ্যসমাপ্ত উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি সাত আসনে দু’শোর কম ভোটে, ২৩টি আসনে পাঁচশোর কম ভোটে, ৪৯টি আসনে এক হাজারের কম ভোটে এবং ৮৬টি আসনে দু’হাজারের কম ভোটে জয়লাভ করেছে! এর উপর গত বারের থেকে আসনও কমেছে। তাই বলা যায় যে, এই ‘জয়রথ’ আদৌ শক্তপোক্ত নয়, বিরোধী দলগুলোর উন্নত মানের হঠকারিতার নজরানা!
বিশ্বজিৎ কর
কলকাতা-১০৩
ঘোড়ার দৌড়
‘জয়রথ’ সম্পাদকীয়তে চার রাজ্যে বিজেপির জয়কে অশ্বমেধের ঘোড়ার সমার্থক বলা হয়েছে। এটি শুনতে যতই বীরত্বব্যঞ্জক হোক না কেন, আগ্রাসন ভিন্ন অন্য কিছু নয়। মহাভারতে কৌরবদের যুদ্ধে পরাজিত করে যুধিষ্ঠির স্বীয় ক্ষমতা জাহির করবার জন্য রাজসূয় যজ্ঞ করার আগে অনুজ তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনকে দিয়ে অশ্বমেধের ঘোড়া ছুটিয়েছিলেন। সে ঘোড়া যে রাজ্যের উপর দিয়ে যাবে, সে ভূখণ্ড ঘোড়ার মালিকের, এবং বিজয়শেষে সে ঘোড়াকে যজ্ঞে বলি দিয়ে মাংস খাওয়া হবে। পুরো বিষয়টি যে ধর্মনীতি বহির্ভূত, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
উত্তরপ্রদেশে অত্যাচার, অরাজকতা সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। হাথরস, উন্নাওতে গণধর্ষণ, খুন, লখিমপুর খেরিতে কৃষকদের উপর গাড়ি চালিয়ে হত্যা, কোভিড-কালে বারাণসীতে গণচিতা, গঙ্গা দিয়ে শত শত লাশ, এ সবের ভয়াবহতা কি ভোটারদের মনে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেনি? এখানে ধর্মকে সামনে শিখণ্ডী দাঁড় করিয়ে যাবতীয় অধার্মিক, অনৈতিক কাজ হয়েছে। মানুষ তার প্রতিবাদও করেছেন। নচিকেতা যেমন গান বেঁধেছিলেন, “তুমি আসবে বলে দেশটা এখনও গুজরাত হয়ে যায়নি,” তেমনই উত্তরপ্রদেশে একটা গান নেট-এ ভাইরাল হল, যেন এক জন দেহাতি মহিলা সমস্ত অত্যাচারের উল্লেখ করে দেশের ‘চৌকিদার’-এর কাছে তার জবাব চাইছেন। মানুষের অসহায়তা ছিল, কিন্তু বিরোধী দলগুলি এককাট্টা হয়ে যে তাদের সমর্থন, শক্তি জোগাবে, তা হয়নি। বরং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর মোদী আসরে নেমে ছল, বল এবং কৌশলকে কাজে লাগালেন। বৃহত্তম প্রদেশে হেরে গেলে তাঁর দিল্লির সিংহাসন টলমল হতে পারে। প্রথমেই কৃষি বিল প্রত্যাহার করে কৃষক ও দলিতদের জন্য কিছু কল্যাণ প্রকল্প ঘোষণা করলেন। উত্তরপ্রদেশের মাটি কামড়ে পড়ে থেকে বিভিন্ন দলিত এলাকায় গিয়ে তাঁদের মন জয়ের চেষ্টা করতে লাগলেন। এই সব এলাকায় প্রচুর অর্থ বিলি, ও শাসকের হুমকির ঠান্ডা চোরাস্রোত যে ছিল, তা সহজেই অনুমেয়। ও দিকে ব্রাহ্মণ অজয় মিশ্রকে মন্ত্রিত্ব থেকে সরালেন না বর্ণহিন্দু ভোটের জন্য। অযোধ্যার জৌলুস দেখিয়ে, বারাণসীর গঙ্গায় ডুব দিয়ে, বিশ্বনাথ মন্দির সংস্কার করিয়ে হিন্দু আবেগ সৃষ্টি করে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট কাড়তে চাইলেন। তার পর ভোটের সময় শাসক দল কর্তৃক ভোটচুরি, ইভিএম পরিবর্তনের অভিযোগ তো ছিলই।
উত্তরপ্রদেশের মানুষের দুর্ভাগ্য এই যে, প্রয়োজনের সময় বিরোধী শক্তিগুলো মানুষের সমর্থনে একজোট না হয়ে বরং নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ, লাভ-লোকসানের হিসাব কষতে লাগল। সম্পাদকীয় নিবন্ধে ঠিকই বলা হয়েছে যে, বিরোধী দলগুলোর দুর্বলতাই এই দিশা নির্দেশক ভোটে পরাজয়ের প্রধান কারণ।
শিখা সেনগুপ্ত
কলকাতা-৫১
বিরোধীর শিক্ষা
‘জয়রথ’ সম্পাদকীয় অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজে সুদক্ষ ভোট-সওদাগর। উত্তরপ্রদেশের প্রশাসনিক পারফরম্যান্স যোগী আদিত্যনাথের পুনরায় অভিষেক হওয়ার মতো অবস্থায় ছিল না। কিন্তু সরকারি তরফে উপভোক্তাদের নানাবিধ সুবিধা, শাসক দলের ক্ষমতা প্রদর্শন ও নেতাদের প্রচারের আড়ম্বর দেখে জনগণ বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিলেন, না কি বিজ্ঞাপনে মোহিত হয়েছিলেন, বলা কঠিন। মেরুকরণকে কাজে লাগিয়ে লাভের গুড় বিজেপি নেতারাই ঘরে তুলে নিয়েছেন। পাশাপাশি বিরোধীরা শুধুমাত্র নিজের নিজের প্রচার করেছে, হকারি করার মতো। যা কোনও ছাপ ফেলতে পারেনি। দরকার ছিল একই মঞ্চে প্রত্যেকের এগিয়ে আসা। ‘অশ্বমেধের ঘোড়া’ আটকানোর ক্ষমতা একটা শক্তিশালী জোটের দ্বারাই সম্ভব। নিজের পায়ে নিজেই কুড়ুল মারা এই অভিযাত্রীদের ‘বিরোধী’ হওয়া মানায় না। যদিও এই ভোট থেকে তাঁরা শিক্ষা নিলেন কি না, এখনও তার কোনও স্বীকারোক্তি মেলেনি।
মনশ্রী চৌধুরী
কাটোয়া, পূর্ব বর্ধমান
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy