‘রেকর্ডে আগমনি গান মানেই পুজোর লেখা শেষ’ (রবিবাসরীয়, ১২-৯) শীর্ষক প্রবন্ধে প্রসঙ্গক্রমে এসেছে সমরেশ মজুমদারের কথা। বিমল করের অতুলনীয় ভদ্রতার উল্লেখ করেছিলেন সমরেশবাবু। সল্টলেকে তাঁর বাড়ি তৈরি হলে জনাকয়েক তরুণ লেখক বিমলবাবুকে আর্জি জানিয়েছিলেন, কিঞ্চিৎ পান করাতে হবে। এক কথায় রাজি হয়ে বিমল কর নির্দিষ্ট দিনে এক গ্লাস জলে এক চামচ করে ব্র্যান্ডি মিশিয়ে পরিবেশন করেন। পরে আবার খোঁজ নিয়েছিলেন, কেউ ওটা খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ল কি না। আবার এমনই খুঁতখুঁতে ছিলেন যে, সামান্য দাঁতের ব্যথা, গলার ব্যথাকেও ক্যানসার মনে হত তাঁর।
এই খুঁতখুঁতেমি লেখার ক্ষেত্রেও। পরিচিতরা জানেন, একটা বাক্য তো দূরের কথা, একটা শব্দও যত ক্ষণ না মনের মতো হচ্ছে, বিমল কর লিখবেন আর কাটবেন। গল্পে-উপন্যাসে যৌনতা আনার বিষয়ে পরিশীলিত সচেতন ছিলেন তিনি। রতন ভট্টাচার্য একটি গল্প জমা দিয়েছিলেন দেশ পত্রিকায়, যেখানে কাকিমার সঙ্গে ভাশুরের ছেলের দৈহিক সম্পর্কের বর্ণনা ছিল। বিমল কর তখন দেশ-এ গল্প দেখেন। লেখাটি তিনি ফেরত দিয়েছিলেন। রতনবাবু আবার লেখাটি জমা দেন সামান্য পরিবর্তন করে। কাকিমার জায়গায় লিখেছিলেন ‘বৌদি’ এই ভেবে যে, এ বারে সম্পাদকমশাই কী করে প্রত্যাখ্যান করবেন, যে হেতু রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়’ও ওই বিষয়েই। বিমল কর বলেছিলেন, “আগে ওটা গল্প হবে, তার পর অন্য কথা।” আদিরস-আশ্রিত রচনাকে পাত্তা দেওয়ার প্রয়োজন বোধ তিনি করেননি। গল্প-আড্ডা দিতে খুব ভালবাসতেন। সে আড্ডায় কোনও কোনও উঠতি লেখক ঢোকার চেষ্টা করতেন এই কারণে, যদি বিমল করের হাতে তাঁর লেখাটা দেওয়া যায়, তা হলে হয়তো দেশ পত্রিকায় ওটা ছাপা হয়ে যাবে। সে রকম মতলব বুঝলে বিমলবাবু উক্ত ব্যক্তিকে সসম্মানে বিদেয় করে দিতেন। তিনি লেখক দেখতেন না, লেখা দেখতেন।
সমরেশ মজুমদারের প্রথম ছোটগল্পটি দেশ পত্রিকায় বিমল করের সম্পাদনাতেই ছাপা হয়েছিল। এর এক ইতিহাস আছে। দেশ পত্রিকা থেকে সমরেশবাবুকে জানানো হয়েছিল তাঁর প্রেরিত ‘অন্যমাত্রা’ শিরোনামাঙ্কিত ছোটগল্প দেশ-এর অমুক সংখ্যায় প্রকাশের জন্য মনোনীত হয়েছে। কিন্তু দিনকয়েক পরে গল্পটি ডাক-মারফত লেখকের কাছে ফেরত যায়। ক্রোধে-ক্ষোভে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন নবীন কলমচি। তাঁর মনে হয়েছিল, যে বিমল করের লেখার তিনি এত ভক্ত, সেই মানুষ প্রতিশ্রুতি দিয়েও গল্প প্রত্যাখ্যান করলেন! স্থির করলেন, লেখাই ছেড়ে দেবেন। তবে তার আগে বিমল করকে প্রচণ্ড গালাগালি দিয়েই কাজটা করবেন। সেইমতো শালীনতার সীমার মধ্যে থেকে যতটা কড়া ভাষায় আক্রমণ করা যায়, সেটাই করেছিলেন বিমল করকে এক দুপুরে টেলিফোনে। সবটা শোনার পরে বিমল শান্ত গলায় বললেন, “গল্পটা দিয়ে যান ভাই। পিয়নের ভুলে ওটা প্রেসে যাওয়ার পরিবর্তে আপনার ঠিকানায় চলে গিয়েছে।”
এই ঘটনাটা বলার কারণ, সেই রকম সম্পাদক হলে নবীনের ঔদ্ধত্যের জবাবে তিনি তাঁর লেখাই হয়তো চিরতরে সংশ্লিষ্ট পত্রিকায় বন্ধ করে দিতে পারতেন। কিন্তু অসামান্য ভদ্র, যুক্তিযুক্ত তথা গঠনমূলক সমালোচনা গ্রহণে উদারহৃদয় ছিলেন বলেই বিমল কর নিজের দোষ স্বীকার করে সসম্মানে তাঁকে ফিরিয়ে এনেছিলেন।
সুগত ত্রিপাঠী
মুগবেড়িয়া, পূর্ব মেদিনীপুর
বিচিত্র কলম
‘রেকর্ডে আগমনি গান মানেই পুজোর লেখা শেষ’ (রবিবাসরীয়, ১২-৯) শীর্ষক প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু কথা। বাংলা কথাসাহিত্যে সম্ভ্রমজাগানো ব্যক্তিত্ব বিমল কর। জীবনরহস্য-সন্ধানী এই শিল্পী পঞ্চাশের দশকে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন— “এমন একটি ভৌতিক যুগে আমরা বাস করছি যে-যুগে সবকিছু টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ছে। বিশ্বাস, নীতি, ধর্ম, কল্যাণবোধ, জীবন সৌন্দর্যের ধ্যান— কী না।” (‘মৃত্যু-ইচ্ছা’, সাপ্তাহিক দেশ, ৪ জুন, ১৯৫৫)।
এই সব দেখার অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা থেকেই হয়তো তিনি লিখেছিলেন যদুবংশ-এর (১৯৬৮) মতো উপন্যাস। হতাশাক্লিষ্ট, উদ্ভ্রান্ত, অবক্ষয়ী, সুস্থতাবিরোধী তারুণ্যের অগ্নিগর্ভ রূপ এর মধ্যে প্রতিভাত হয়েছে। চাঞ্চল্য ও বিক্ষোভে আন্দোলিত এই যুবসম্প্রদায় সমাজের আত্মপ্রতারণা ও মনুষ্যত্বের অবমাননার শিকার। আর ‘দেওয়াল’, ‘খড়কুটো’, ‘অসময়’ অতিক্রম করে স্বার্থপর সুবিধাবাদী হৃদয়হীন মধ্যবিত্তের অধোগতি অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে কালের নায়ক (দুই পর্ব ১৯৭৯-৮১)-এ এসে।
বিভিন্ন পত্রিকা সম্পাদনার মধ্য দিয়ে বিমল কর প্রচলিত জীবনযাত্রা ও সংস্কারের ঊর্ধ্বে উঠে গল্পের প্রচলিত সংজ্ঞাকে পাল্টে দিয়েছিলেন। ধর্মবোধ নিয়তি বিষাদ মৃত্যুচেতনার দাহ যন্ত্রণায় অন্য ধরনের গল্পতে মগ্ন হয়েছিলেন তিনি। আসলে “অন্তরের অনাবিষ্কৃত অন্ধকার বিশাল পৃথিবীর রহস্য উন্মোচনে তিনি যেন তদগত চিত্ত। মৃত্যুচেতনায় যন্ত্রণাবিদ্ধ কিংবা অমোঘ বিচ্ছিন্নতা ও নিঃসঙ্গতার অনুভবে বিষণ্ণ অসহায় মানুষের মগ্নচেতনার ছবি আশ্চর্য রেখায়” (বাংলা কথাসাহিত্য প্রকরণ ও প্রবণতা, গোপিকানাথ রায়চৌধুরী) ফুটিয়ে তুলেছিলেন। যেখানে ‘সুধাময়’, ‘জননী’, ‘আত্মজা’র পাশাপাশি ‘অপেক্ষা’, ‘শূন্য’, ‘সোপান’, ‘মানবপুত্র’, ‘উদ্ভিদ’ গল্পের কথাও বলতে হয়। আবার, নিঃসঙ্গ অন্তর্মুখী ও বিষাদে মগ্ন স্বীয় সত্তার রূপ বিশিষ্ট হয়ে আছে তাঁর ‘নিষাদ’, ‘অশ্বত্থ’, ‘যযাতি’, ‘হেমাঙ্গর ঘরবাড়ি’, ‘সুখ’, ‘হেমন্তের সাপ’ প্রভৃতি গল্পের মধ্যে।
দস্তয়ভস্কি’র ‘দ্য ডাবল’-এর থিম ব্যবহার করে তিনি লিখেছিলেন জীবিত ও মৃত উপন্যাস। আত্মবিশ্লেষণের চমৎকারিত্বে, যা মনকে বিশেষ ভাবে নাড়া দেয়। সেই সঙ্গে সায়ক, ঘাতক বা, শঙ্খ ছাড়াও তিনি লিখেছিলেন ঘুঘু-র মতো সংহত সংলাপের মঞ্চসফল নাটক বা, কর্ণকুন্তী সংলাপ-এর মতো আধুনিক মনের নাটক।
সুদেব মাল
খরসরাই, হুগলি
কিকিরার স্রষ্টা
অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা সাহিত্যিক বিমল করকে নিয়ে লেখা প্রবন্ধটি পড়তে পড়তেই মনে পড়ে গেল, তাঁর যে উপন্যাসটি আমি প্রথম পড়েছিলাম, তার কথা। তখন আমি স্কুলে পড়ি। হাতে এল বিমল করের উপন্যাস কাপালিকরা এখনও আছে। এত ভাল লেগেছিল, যে কী বলব! তার পর তো জাদুকর গোয়েন্দা কিঙ্করকিশোর রায়, অর্থাৎ কিকিরার গল্প মুগ্ধ হয়ে পড়েছি। বাংলা সাহিত্যে পাঠক-পাঠিকাদের গোয়েন্দা উপহার দিয়েছেন অনেক নামজাদা লেখক-লেখিকাই। কিন্তু বিমল করই সম্ভবত একমাত্র লেখক, যিনি উপহার দিয়েছেন জাদুকর গোয়েন্দা। যিনি একদা ছিলেন দুর্দান্ত ম্যাজিশিয়ান, এখন দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা। সেই জন্য নিশ্চিত ভাবে বলা যায়, বাংলা পাঠক-পাঠিকারা কৃতজ্ঞ থাকবেন চিরকাল কিকিরার স্রষ্টা বিমল করের কাছে।
সৌরীশ মিশ্র
কলকাতা-৯১
প্রথম পরিচয়
বিমল করের লেখার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলা-তে প্রকাশিত কিকিরা, তার দুই সহকারী তারাপদ, আর চন্দন ওরফে চাঁদুর কীর্তিকলাপের মাধ্যমে। ‘কৃষ্ণধাম কথা’, ‘একটি ফোটো চুরির রহস্য’, ‘একটি অভিশপ্ত পুঁথি ও অষ্ট ধাতু’, ‘শুদ্ধানন্দ প্রেতসিদ্ধ ও কিকিরা’, ‘কাপালিকরা এখনও আছে’ প্রভৃতি গল্প শুধু কিশোরবেলা নয়, প্রাপ্তবয়সেও আকর্ষক!
উড়ো খই পড়লে লেখকের লেখা চরিত্রগুলো খুব চেনা মনে হয়। বালিকা বধূ, বসন্ত বিলাপ-এ মধুর প্রেমের ছোঁয়া পাওয়া যায়। তাঁর লেখা সহজ, অথচ এত মনোগ্রাহী যে, এক বার পড়লে আবার পড়ার ইচ্ছা হয়।
সর্বানী গুপ্ত
বড়জোড়া, বাঁকুড়া
‘রেকর্ডে আগমনি গান মানেই পুজোর লেখা শেষ’ (রবিবাসরীয়, ১২-৯) শীর্ষক প্রবন্ধে প্রসঙ্গক্রমে এসেছে সমরেশ মজুমদারের কথা। বিমল করের অতুলনীয় ভদ্রতার উল্লেখ করেছিলেন সমরেশবাবু। সল্টলেকে তাঁর বাড়ি তৈরি হলে জনাকয়েক তরুণ লেখক বিমলবাবুকে আর্জি জানিয়েছিলেন, কিঞ্চিৎ পান করাতে হবে। এক কথায় রাজি হয়ে বিমল কর নির্দিষ্ট দিনে এক গ্লাস জলে এক চামচ করে ব্র্যান্ডি মিশিয়ে পরিবেশন করেন। পরে আবার খোঁজ নিয়েছিলেন, কেউ ওটা খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ল কি না। আবার এমনই খুঁতখুঁতে ছিলেন যে, সামান্য দাঁতের ব্যথা, গলার ব্যথাকেও ক্যানসার মনে হত তাঁর।
এই খুঁতখুঁতেমি লেখার ক্ষেত্রেও। পরিচিতরা জানেন, একটা বাক্য তো দূরের কথা, একটা শব্দও যত ক্ষণ না মনের মতো হচ্ছে, বিমল কর লিখবেন আর কাটবেন। গল্পে-উপন্যাসে যৌনতা আনার বিষয়ে পরিশীলিত সচেতন ছিলেন তিনি। রতন ভট্টাচার্য একটি গল্প জমা দিয়েছিলেন দেশ পত্রিকায়, যেখানে কাকিমার সঙ্গে ভাশুরের ছেলের দৈহিক সম্পর্কের বর্ণনা ছিল। বিমল কর তখন দেশ-এ গল্প দেখেন। লেখাটি তিনি ফেরত দিয়েছিলেন। রতনবাবু আবার লেখাটি জমা দেন সামান্য পরিবর্তন করে। কাকিমার জায়গায় লিখেছিলেন ‘বৌদি’ এই ভেবে যে, এ বারে সম্পাদকমশাই কী করে প্রত্যাখ্যান করবেন, যে হেতু রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়’ও ওই বিষয়েই। বিমল কর বলেছিলেন, “আগে ওটা গল্প হবে, তার পর অন্য কথা।” আদিরস-আশ্রিত রচনাকে পাত্তা দেওয়ার প্রয়োজন বোধ তিনি করেননি। গল্প-আড্ডা দিতে খুব ভালবাসতেন। সে আড্ডায় কোনও কোনও উঠতি লেখক ঢোকার চেষ্টা করতেন এই কারণে, যদি বিমল করের হাতে তাঁর লেখাটা দেওয়া যায়, তা হলে হয়তো দেশ পত্রিকায় ওটা ছাপা হয়ে যাবে। সে রকম মতলব বুঝলে বিমলবাবু উক্ত ব্যক্তিকে সসম্মানে বিদেয় করে দিতেন। তিনি লেখক দেখতেন না, লেখা দেখতেন।
সমরেশ মজুমদারের প্রথম ছোটগল্পটি দেশ পত্রিকায় বিমল করের সম্পাদনাতেই ছাপা হয়েছিল। এর এক ইতিহাস আছে। দেশ পত্রিকা থেকে সমরেশবাবুকে জানানো হয়েছিল তাঁর প্রেরিত ‘অন্যমাত্রা’ শিরোনামাঙ্কিত ছোটগল্প দেশ-এর অমুক সংখ্যায় প্রকাশের জন্য মনোনীত হয়েছে। কিন্তু দিনকয়েক পরে গল্পটি ডাক-মারফত লেখকের কাছে ফেরত যায়। ক্রোধে-ক্ষোভে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন নবীন কলমচি। তাঁর মনে হয়েছিল, যে বিমল করের লেখার তিনি এত ভক্ত, সেই মানুষ প্রতিশ্রুতি দিয়েও গল্প প্রত্যাখ্যান করলেন! স্থির করলেন, লেখাই ছেড়ে দেবেন। তবে তার আগে বিমল করকে প্রচণ্ড গালাগালি দিয়েই কাজটা করবেন। সেইমতো শালীনতার সীমার মধ্যে থেকে যতটা কড়া ভাষায় আক্রমণ করা যায়, সেটাই করেছিলেন বিমল করকে এক দুপুরে টেলিফোনে। সবটা শোনার পরে বিমল শান্ত গলায় বললেন, “গল্পটা দিয়ে যান ভাই। পিয়নের ভুলে ওটা প্রেসে যাওয়ার পরিবর্তে আপনার ঠিকানায় চলে গিয়েছে।”
এই ঘটনাটা বলার কারণ, সেই রকম সম্পাদক হলে নবীনের ঔদ্ধত্যের জবাবে তিনি তাঁর লেখাই হয়তো চিরতরে সংশ্লিষ্ট পত্রিকায় বন্ধ করে দিতে পারতেন। কিন্তু অসামান্য ভদ্র, যুক্তিযুক্ত তথা গঠনমূলক সমালোচনা গ্রহণে উদারহৃদয় ছিলেন বলেই বিমল কর নিজের দোষ স্বীকার করে সসম্মানে তাঁকে ফিরিয়ে এনেছিলেন।
সুগত ত্রিপাঠী
মুগবেড়িয়া, পূর্ব মেদিনীপুর
বিচিত্র কলম
‘রেকর্ডে আগমনি গান মানেই পুজোর লেখা শেষ’ (রবিবাসরীয়, ১২-৯) শীর্ষক প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু কথা। বাংলা কথাসাহিত্যে সম্ভ্রমজাগানো ব্যক্তিত্ব বিমল কর। জীবনরহস্য-সন্ধানী এই শিল্পী পঞ্চাশের দশকে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন— “এমন একটি ভৌতিক যুগে আমরা বাস করছি যে-যুগে সবকিছু টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ছে। বিশ্বাস, নীতি, ধর্ম, কল্যাণবোধ, জীবন সৌন্দর্যের ধ্যান— কী না।” (‘মৃত্যু-ইচ্ছা’, সাপ্তাহিক দেশ, ৪ জুন, ১৯৫৫)।
এই সব দেখার অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা থেকেই হয়তো তিনি লিখেছিলেন যদুবংশ-এর (১৯৬৮) মতো উপন্যাস। হতাশাক্লিষ্ট, উদ্ভ্রান্ত, অবক্ষয়ী, সুস্থতাবিরোধী তারুণ্যের অগ্নিগর্ভ রূপ এর মধ্যে প্রতিভাত হয়েছে। চাঞ্চল্য ও বিক্ষোভে আন্দোলিত এই যুবসম্প্রদায় সমাজের আত্মপ্রতারণা ও মনুষ্যত্বের অবমাননার শিকার। আর ‘দেওয়াল’, ‘খড়কুটো’, ‘অসময়’ অতিক্রম করে স্বার্থপর সুবিধাবাদী হৃদয়হীন মধ্যবিত্তের অধোগতি অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে কালের নায়ক (দুই পর্ব ১৯৭৯-৮১)-এ এসে।
বিভিন্ন পত্রিকা সম্পাদনার মধ্য দিয়ে বিমল কর প্রচলিত জীবনযাত্রা ও সংস্কারের ঊর্ধ্বে উঠে গল্পের প্রচলিত সংজ্ঞাকে পাল্টে দিয়েছিলেন। ধর্মবোধ নিয়তি বিষাদ মৃত্যুচেতনার দাহ যন্ত্রণায় অন্য ধরনের গল্পতে মগ্ন হয়েছিলেন তিনি। আসলে “অন্তরের অনাবিষ্কৃত অন্ধকার বিশাল পৃথিবীর রহস্য উন্মোচনে তিনি যেন তদগত চিত্ত। মৃত্যুচেতনায় যন্ত্রণাবিদ্ধ কিংবা অমোঘ বিচ্ছিন্নতা ও নিঃসঙ্গতার অনুভবে বিষণ্ণ অসহায় মানুষের মগ্নচেতনার ছবি আশ্চর্য রেখায়” (বাংলা কথাসাহিত্য প্রকরণ ও প্রবণতা, গোপিকানাথ রায়চৌধুরী) ফুটিয়ে তুলেছিলেন। যেখানে ‘সুধাময়’, ‘জননী’, ‘আত্মজা’র পাশাপাশি ‘অপেক্ষা’, ‘শূন্য’, ‘সোপান’, ‘মানবপুত্র’, ‘উদ্ভিদ’ গল্পের কথাও বলতে হয়। আবার, নিঃসঙ্গ অন্তর্মুখী ও বিষাদে মগ্ন স্বীয় সত্তার রূপ বিশিষ্ট হয়ে আছে তাঁর ‘নিষাদ’, ‘অশ্বত্থ’, ‘যযাতি’, ‘হেমাঙ্গর ঘরবাড়ি’, ‘সুখ’, ‘হেমন্তের সাপ’ প্রভৃতি গল্পের মধ্যে।
দস্তয়ভস্কি’র ‘দ্য ডাবল’-এর থিম ব্যবহার করে তিনি লিখেছিলেন জীবিত ও মৃত উপন্যাস। আত্মবিশ্লেষণের চমৎকারিত্বে, যা মনকে বিশেষ ভাবে নাড়া দেয়। সেই সঙ্গে সায়ক, ঘাতক বা, শঙ্খ ছাড়াও তিনি লিখেছিলেন ঘুঘু-র মতো সংহত সংলাপের মঞ্চসফল নাটক বা, কর্ণকুন্তী সংলাপ-এর মতো আধুনিক মনের নাটক।
সুদেব মাল
খরসরাই, হুগলি
কিকিরার স্রষ্টা
অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা সাহিত্যিক বিমল করকে নিয়ে লেখা প্রবন্ধটি পড়তে পড়তেই মনে পড়ে গেল, তাঁর যে উপন্যাসটি আমি প্রথম পড়েছিলাম, তার কথা। তখন আমি স্কুলে পড়ি। হাতে এল বিমল করের উপন্যাস কাপালিকরা এখনও আছে। এত ভাল লেগেছিল, যে কী বলব! তার পর তো জাদুকর গোয়েন্দা কিঙ্করকিশোর রায়, অর্থাৎ কিকিরার গল্প মুগ্ধ হয়ে পড়েছি। বাংলা সাহিত্যে পাঠক-পাঠিকাদের গোয়েন্দা উপহার দিয়েছেন অনেক নামজাদা লেখক-লেখিকাই। কিন্তু বিমল করই সম্ভবত একমাত্র লেখক, যিনি উপহার দিয়েছেন জাদুকর গোয়েন্দা। যিনি একদা ছিলেন দুর্দান্ত ম্যাজিশিয়ান, এখন দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা। সেই জন্য নিশ্চিত ভাবে বলা যায়, বাংলা পাঠক-পাঠিকারা কৃতজ্ঞ থাকবেন চিরকাল কিকিরার স্রষ্টা বিমল করের কাছে।
সৌরীশ মিশ্র
কলকাতা-৯১
প্রথম পরিচয়
বিমল করের লেখার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলা-তে প্রকাশিত কিকিরা, তার দুই সহকারী তারাপদ, আর চন্দন ওরফে চাঁদুর কীর্তিকলাপের মাধ্যমে। ‘কৃষ্ণধাম কথা’, ‘একটি ফোটো চুরির রহস্য’, ‘একটি অভিশপ্ত পুঁথি ও অষ্ট ধাতু’, ‘শুদ্ধানন্দ প্রেতসিদ্ধ ও কিকিরা’, ‘কাপালিকরা এখনও আছে’ প্রভৃতি গল্প শুধু কিশোরবেলা নয়, প্রাপ্তবয়সেও আকর্ষক!
উড়ো খই পড়লে লেখকের লেখা চরিত্রগুলো খুব চেনা মনে হয়। বালিকা বধূ, বসন্ত বিলাপ-এ মধুর প্রেমের ছোঁয়া পাওয়া যায়। তাঁর লেখা সহজ, অথচ এত মনোগ্রাহী যে, এক বার পড়লে আবার পড়ার ইচ্ছা হয়।
সর্বানী গুপ্ত
বড়জোড়া, বাঁকুড়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy