বিশ্বজিৎ রায়, ‘আমাদের টনক নড়েছে কি’ (১৫-৩) শীর্ষক প্রবন্ধে বলেছেন, বাংলাকে কাজের ভাষা না করতে পারলে বাঙালিরই দুর্গতি। এই বিষয়ে তিনি অগ্রজ সাহিত্যিকদের অনেক উদাহরণ দিয়েছেন যে, তাঁরা কেমন করে সহজবোধ্য বাংলায় সর্বসাধারণের কাজের সুবিধার জন্য বই লিখে গিয়েছেন। যে বাংলা কাব্যসাহিত্যের জন্য রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, যে বাংলা ভাষা এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা, যে সমৃদ্ধ বাংলা ভাষা সাহিত্যের ইতিহাসের জন্য বাঙালি হিসাবে আমাদের গর্ব বোধ করা উচিত, আজ সাধারণ বাঙালি সমাজ সেই মাতৃভাষার চর্চা করে না। বরং, জগাখিচুড়ি হিন্দি ও কিছুটা ইংরেজি মিশিয়ে এক গুরুচণ্ডালী ভাষা বলে বা ইংরেজি অক্ষরে দুর্বোধ্য বাংলা লেখে।
অথচ, বাংলা ভাষার এমন দৈন্যদশা হওয়ার কথা নয়। বর্তমানে বাংলার গ্রামের গরিষ্ঠসংখ্যক অধিবাসী শুধু বাংলা লেখাপড়াটাই জানেন। কৃষিঋণের প্রয়োজনে, সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে, ওষুধের তালিকা ও নির্দেশিকায়, কৃষি, সমবায়, স্বরোজগার সম্পর্কিত বই সহজ প্রাঞ্জল বাংলা ভাষায় লেখা থাকা জরুরি। সম্প্রতি লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপেল টিউব স্টেশনের নাম বাংলায় লেখা হয়েছে, অথচ নিজের মাতৃভাষাকে কেন আমরা সহজ সরল কাজের ভাষা হিসাবে ব্যবহার করছি না! বাংলার শিক্ষক, সাহিত্যিকদের এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে, যাতে শুদ্ধ অথচ সহজ বাংলা কাজের ভাষা হিসাবে ব্যবহার করা যায়। বঙ্কিমচন্দ্র সহজ রচনাশিক্ষা-র মতো বই লেখার পাশাপাশি স্নাতকোত্তরে বাংলা বিষয় হিসাবে রাখার জন্য ঔপনিবেশিক আমলে লড়ে গিয়েছেন। বিদ্যাসাগর বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগে সহজ বাংলা লিখেছেন, যাতে পড়ুয়ার মনে তা সহজেই জায়গা পায়। রবীন্দ্রনাথের সহজ পাঠ-এও সহজ বাংলার ব্যবহার হয়েছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে আমরা জানি যে, তাঁদের সাহিত্য যাতে বাস্তবনির্ভর ও কালজয়ী হয়, সে জন্য কারখানার মজুর বস্তিতে বা মাঝিপাড়ায় গিয়ে তাঁদের সঙ্গে থাকতেন।
অতঃপর বাংলার শিক্ষিত বিদ্বান সমাজকেই এগিয়ে আসতে হবে শুদ্ধ, সহজ, বোধগম্য বাংলা কাজের ভাষা প্রণয়নে, যে কাজটি এখনই ভীষণ ভাবে দরকার।
শিখা সেনগুপ্ত
কলকাতা-৫১
কাজের ভাষা
‘আমাদের টনক নড়েছে কি’ পড়ে বুঝলাম, বাংলাকে কাজের ভাষা করতে না পারলে বাঙালিরই দুর্গতি কেন। বোঝা গেল, বাংলাকে কাজের ও অবশ্যই কাছের ভাষা করতে পারলে বক্তা ও শ্রোতা, লেখক ও পাঠকের মধ্যে অস্তিত্ব পরিচয়ের পার্থক্য থাকলেও তাঁদের মনের ভাষা বোঝার মধ্যে বিস্তর ফারাক অনেকটাই দূর হয়, ভুল বোঝাবুঝি কম হয়, সুসম্পর্ক তৈরি হয়। এটা সুস্থ সমাজের প্রগতির অনুকূল পরিবেশ।
লেখক উনিশ শতকে প্যারীচাঁদ মিত্রের কৃষিপাঠ, অক্ষয়কুমার দত্তের বাষ্পীয় রথারোহীদিগের প্রতি উপদেশ প্রভৃতি বইয়ের উদাহরণ দিয়েছেন, যা সে কালে বৈপ্লবিক উদাহরণ। সেই পথেই আজকের বাংলা পড়ে আছে। কারণ, কাজের ভাষা অনেকটাই মুখের ভাষা, যার সঙ্গে দেহভঙ্গির ভাষাও ঘনিষ্ঠ ভাবে জুড়ে থাকে। এই ভাষাকে লিখে প্রকাশ করতে গেলে অল্প কথায় লেখা মুশকিল। তখন সাহায্য নিতে হয় তৎসম সন্ধিসমাসবদ্ধ কোনও কঠিন শব্দের, যার অর্থ গভীর এবং সুদূর ইতিহাস আছে। লেখকের প্রবন্ধের উদাহরণ লক্ষ করা যাক, যা স্বয়ং লেখক এড়াতে পারেননি। ‘ব্যবহারযোগ্যতা অর্জন’, ‘বোধগম্য’, ‘প্রতিষ্ঠিত’, ‘সৃষ্টিময়তা’, ‘দুর্বোধ্য’, ‘কৃতবিদ্য’, ‘খ্যাতকীর্তি’ প্রভৃতি শব্দ মাধ্যমিক স্তরের কত জন শিক্ষার্থী স্বাভাবিক ভাবে পড়ে বুঝতে ও লিখতে পারে, তা হাতে গোনা যায়। অর্থাৎ, এই শব্দগুলো কাজের ও কাছের ভাষা নয়। কিন্তু লেখক বাধ্য হলেন এই শব্দগুলো লিখতে, কারণ অল্প কথায় তিনি অনেক বেশি বোঝাতে চেয়েছেন।
খবরের কাগজের ভাষা মোটামুটি বৃহত্তর কলকাতার মান্য ভাষা। বৃহত্তর কলকাতার বেশির ভাগ লোক শিক্ষিত মানুষ। তাঁরাই পাঠক। কলকাতা আর পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষার ছবি এক নয়। জীবিকার সঙ্গে জীবনের ভাষাও বদলে যায়। পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ও বাঙালির মোটামুটি তিনটি ছবি পাওয়া যায়— ১) পশ্চিম বর্ধমান-বিহার সীমানায় হিন্দি ভাষা প্রধান, রাঢ় এলাকা রুক্ষ, শিল্পাঞ্চল ও খনি প্রধান; ২) উত্তরবঙ্গ পার্বত্য অঞ্চল। চা, ফল, পর্যটন শিল্পপ্রধান, এখানে হিন্দি, নেপালির সঙ্গে কোচ, রাজবংশী জাতির ভাষার প্রভাব বেশি; ৩) বাকি বাংলা কৃষি ও ক্ষুদ্রশিল্প প্রধান, গঙ্গা ও সমুদ্রের কাছাকাছি। সমুদ্র থেকে পাহাড়, প্রকৃতির এই বৈচিত্রের ফলে বৈষম্যের প্রভাব অনেক বেশি বাংলা ভাষায়। ১৯৫৬ সালে ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য পুনর্গঠন হলে এই বৈচিত্র ও বৈষম্য নিয়েই পশ্চিমবঙ্গ ও তার বাংলা ভাষা গড়ে উঠেছে। এটা বাংলা মায়ের নিয়তি। এত বিচিত্র মানুষের কাছে বাংলা ভাষাকে কাজের ও কাছের ভাষা করতে গেলে ওই তৎসম যৌগিক সমাসবদ্ধ শব্দগুলোর বদলে সোজাসাপ্টা শব্দ চাই, যা কানের ভিতর দিয়ে সটান মনের অন্দরমহলে ঘা মারে।
মানবসভ্যতার পথে এক-একটি ঘটনা কখনও এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয় যে, ভাষানিরপেক্ষ নতুন শব্দগুলো চিহ্নবিশেষ হয়ে যায়। অতিমারি এমনই এক বিশ্বজনীন পরিবর্তন। এই পরিবর্তন বাংলা ভাষা জগৎকেও নাড়িয়ে দিয়েছে। প্রায় সর্বদা ব্যবহার করা মাস্ক-এর যোগ্য বাংলা শব্দ মিলছে না। ঘরবন্দি মানুষ প্রাণের দায়ে, অন্য বিষয়ের অভাবে বা এই বিষয়ের গুরুত্ব স্বীকার করে কিছু শব্দ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে শিখে নিয়েছেন। শব্দগুলো বেশির ভাগ স্বাস্থ্য, চিকিৎসার জগতে ব্যবহৃত হচ্ছে। রোগ সংক্রান্ত শব্দ— করোনাভাইরাস, স্পাইক প্রোটিন, অ্যান্টিবডি, পিপিই কিট, স্যানিটাইজ়ার, ভেন্টিলেটর ইত্যাদি। সংক্রমণে সতর্কতা সংক্রান্ত— লকডাউন, আইসোলেশন, কোয়রান্টিন। রোগ পরীক্ষা বিষয়ে শব্দ— ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল, হিউম্যান ট্রায়াল, কোমর্বিডিটি ইত্যাদি অবাধে ব্যবহার হচ্ছে। বিকল্প জীবনে ঢুকে পড়েছে অনলাইন ক্লাস, ভার্চুয়াল ক্লাস, ওয়ার্ক ফ্রম হোম ইত্যাদি। ইংরেজি ভাষার এই শব্দগুলির হয় বাংলা প্রতিশব্দ তৈরি হয়নি বা জনপ্রিয় হয়নি। এটাই ‘কাজের’ ও কাছের ভাষা হয়ে গিয়েছে।
আজ মায়েদের রান্নাঘর থেকে উনুন, কড়াই, হাঁড়ি, মালশা, কলসি, শিল-নোড়া, গেলাস ইত্যাদির জায়গায় ধীরে ধীরে ঢুকে গিয়েছে ওভেন, কুকার, এলপিজি গ্যাস, ইলেকট্রিক গ্রিল, ফুড প্রসেসর, মিক্সার, মডিউলার কিচেন। মেনুতে সাবেক ভাত, ডাল, ছেঁচড়া, কালিয়া, মাছ, পোস্ত, মালাইকারি, লুচি, বেগুনভাজার জায়গায় মোগলাই পরোটা, চিলি চিকেন, বাটার নান, বিরিয়ানি, পিৎজ়া, মসালা পনির ইত্যাদি জায়গা করে নিয়েছে। গ্রামেও ঢুকে পড়েছে নুডলস, ইনস্ট্যান্ট কফি, জ্যাম, জেলি। আমার বাঙালি উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া জিভ, পাকস্থলী, অন্ত্র এখন নতুন শব্দে থই না পেলেও মানিয়ে নিতে হচ্ছে। কারণ এটাই ‘কাজের’ ভাষা, কাছের ভাষা।
এ ভাবে অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়, যেখানে বাংলা ভাষা ও বাঙালির অস্তিত্ব এক জটিল পরিস্থিতির মুখে। লেখক শেষে লিখেছেন, “ব্যবহারিক বাংলার, সংযোগের বাংলার দীনতা বাঙালির অস্তিত্বকেই বিপন্ন করছে।” বাঙালির অস্তিত্ব বললে বাংলাদেশের কথা আসবেই। তা হলে বাংলাদেশ কী করছে? লেখক তা আলোচনা করেননি। পূর্ববঙ্গীয় উচ্চারণে কিছু কথায় ‘ভ’-কে ‘ব’ শোনায়। ‘ভাষা’-কে ‘বাসা’ উচ্চারণ করায় পশ্চিমবঙ্গীয় এক জন তথাকথিত ঘটি অনুযোগ করলে পূর্ববঙ্গীয় তথাকথিত বাঙাল জবাব দেন— “তোমরা বাসাটাই দ্যাখলে, বাব দ্যাখলে না।” ধর্ম, বর্ণ, জাত, অঞ্চল, জীবিকা, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদি নিয়ে বাঙালির বৈচিত্র বহুমুখী। এই বৈচিত্রকে পার্থক্য ভাবলেই সর্বনাশ। ওই ‘বাব’-কে যত সহজে ‘ভাব’ হিসাবে নেওয়া যাবে, পার্থক্য কমবে, বাংলার দীনতা কমবে, বাঙালির অস্তিত্বের বিপন্নতা দূর হবে। ঐক্য সুদৃঢ় হবে।
শুভ্রাংশু কুমার রায়
চন্দননগর, হুগলি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy