Advertisement
১৭ ডিসেম্বর ২০২৪
Manna Dey

সম্পাদক সমীপেষু: রেগে যান মান্না দে’ও

প্রশ্ন জাগে, বাংলায় থেকে বাংলা গানের প্রতি এত উপেক্ষা তথা অবহেলা কেন? আসলে আজকাল অনেক শিল্পীই দ্রুত জনপ্রিয়তার জন্য হিন্দি গান করেন।

শেষ আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৬:২৪
Share: Save:

মেট্রোতে এক হিন্দিভাষী যাত্রী বাংলায় কথা বলার জন্য অন্য এক যাত্রীকে শাসিয়েছিলেন। ক’দিন পর শিল্পী ইমন চক্রবর্তীর একটি অনুষ্ঠানে শ্রোতা অভব্যতা করে বলতে থাকেন, বাংলা গান শুনব না। প্রশ্ন জাগে, বাংলায় থেকে বাংলা গানের প্রতি এত উপেক্ষা তথা অবহেলা কেন? আসলে আজকাল অনেক শিল্পীই দ্রুত জনপ্রিয়তার জন্য হিন্দি গান করেন। ফলে হিন্দি গান শোনার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। বাংলা গান শোনার আগ্রহ এত চটজলদি সৃষ্টি হয় না।

প্রসঙ্গত, একটি ঘটনা মনে পড়ল। গত শতাব্দীর সত্তরের দশক। সে সময় প্রবাদপ্রতিম হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও মান্না দে দু’জনেরই অসংখ্য হিট হিন্দি গান ছিল। কিন্তু কোনও জলসায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে কখনও কোনও হিন্দি গান গাইতে শুনিনি। তবে মান্না দে যে কোনও অনুষ্ঠানে শ্রোতাদের অনুরোধে বাংলা গানের সঙ্গে কয়েকটি হিন্দি গানও গাইতেন, মানে শ্রোতাদের চাপে গাইতে এক প্রকার বাধ্য হতেন। কোনও এক নববর্ষে মান্না দের একটি অনুষ্ঠান ছিল। জনপ্রিয় বাংলা গানগুলি একের পর এক গেয়ে চলেছেন। শ্রোতাদের আসন থেকে তাঁর কাছে বার বার হিন্দি গান গাইবার জন্য অনুরোধ আসছে, বিশেষত ‘লাগা চুনরি মে দাগ’। তাতে তিনি ভীষণ বিরক্ত হলেন। রাগত স্বরে বললেন, “আজ পয়লা বৈশাখ, বাংলার নববর্ষ। আজ আমি কোনও হিন্দি গান গাইতে পারব না।” সে দিন তিনি গোটা কুড়ি গান গেয়েছিলেন, যার মধ্যে একটিও হিন্দি ছিল না। শ্রোতারা অনেকেই হয়তো হতাশ হয়েছিলেন, কিন্তু বাংলা গান মন দিয়েই শুনেছিলেন। কারণ তিনি যে মান্না দে!

আজ ইমন চক্রবর্তীর মতো শিল্পীরা যদি শ্রোতাদের বাংলা গান শুনিয়ে শুনিয়ে তাঁদের মধ্যে বাংলা গানের প্রতি আগ্রহ তথা ভালবাসা তৈরি করতে পারেন, তা হলে তাঁরাও বাংলা গান শুনবেন। তবে কাজটা কঠিন এবং এক দিনে হবে না।

কুমার শেখর সেনগুপ্ত, কোন্নগর, হুগলি

বাঙালির গর্ব

খুব কাছাকাছি সময়ের মধ্যে, নেটমাধ্যমে আলোড়িত এবং আলোচিত দুটো ঘটনা নিয়ে একটু বলি। কলকাতা মেট্রোতে সহযাত্রী দুই মহিলার মধ্যে বাগ্‌বিতণ্ডা চলছে। বাঙালি মহিলার প্রতি হিন্দিভাষী তরুণীর বক্তব্য, “আপনি কি বাংলাদেশি! এক জন ভারতীয় হয়ে, ভারতে থেকে আপনি হিন্দি জানেন না?” বাঙালি মহিলার উত্তর, “নিজের রাজ্যে, নিজের ভাষায় কথা বলেছি।” প্রত্যুত্তরে অবাঙালির দাবি, “পশ্চিমবঙ্গ ভারতের অংশ। মেট্রো ভারতের অংশ।” বাঙালি স্পষ্ট উত্তর দিচ্ছেন, “পশ্চিমবঙ্গ আমার। মেট্রো আমার। রাজ্য সরকারকে সব কিছুর জন্য আমরা ট্যাক্স দিচ্ছি।”

প্রতিটা মানুষের নিজের মতো করে নিজের ভাষার অধিকার বুঝে নেওয়ার উদাহরণ রয়েছে এই দৃশ্যে। কয়েকটা তথ্য স্মরণ করা যাক। ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী অন্যতম সরকারি ভাষা হল হিন্দি। এ ছাড়া কিচ্ছু নয়। প্রতিটা রাজ্য তাদের নিজস্ব ভাষার চর্চা করে। কর্নাটকে কন্নড়, মহারাষ্ট্রে মরাঠি, ওড়িশায় ওড়িয়া, ঠিক তেমন পশ্চিমবঙ্গে বাংলা। এটাই ভারতীয় রীতি। তবে বাঙালির নিজের ভাষার প্রতি দীর্ঘ অবহেলাই এ ধরনের বিশৃঙ্খলা ডেকে এনেছে। ভাবুন তো, বহু বছর আগে ‘মিলে সুর মেরা তুমহারা’ গানে কলকাতা মেট্রো বা মেট্রো স্টেশনের গায়ে রবীন্দ্রলেখনীর কাটাকুটির নকশা দেখলে আমাদের কত আনন্দ হত! মেট্রোতে এখনও লেখা থাকে ‘আমার মেট্রো আমার গর্ব’। কাজেই বাঙালি মহিলার কথাগুলিকে নিছক ব্যক্তিগত স্বার্থপ্রণোদিত না ভেবে একটা সার্বিক প্রতিবাদ, অনেক দিনের জমা ক্ষোভের জরুরি প্রকাশ— ভাবা ভাল।

দ্বিতীয় ঘটনা আরও সাম্প্রতিক। ‘বাংলা গান শুনব না’ শুনে মঞ্চে দাঁড়িয়ে বাঙালি গায়িকার সপাট জবাব, ভণ্ডামি কোরো না। স্টেটটার নাম বাংলা। সব ধরনের গান শোনো। মরাঠি, পঞ্জাবি, গুজরাতি, ইংরেজি গান শোনো। কিন্তু তুমি কে হে! এত বড় সাহস যে বাংলায় থেকে, উপার্জন করে বলছ, বাংলা গান শুনব না!

বাংলা ভাষায় গাওয়া গান নিয়ে যিনি ‘অস্কার’-এর দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছেন, মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি সেই ভাষার পক্ষ নিলে একটা ওজন নিশ্চয়ই থাকে! এই ‘প্রতিবাদ’টিকে বাংলা ভাষার পক্ষে স্বাস্থ্যকর ভাবা উচিত। নগরজীবনে, বিভিন্ন ওয়টস্যাপ গ্রুপ বা রেস্তোরাঁ— সর্বক্ষেত্রে কৌলীন্যের খাতিরে বাঙালি অন্য ভাষা নিয়ে মেতে থেকেছে। শহুরে বিদ্যায়তনগুলিতে ছোট্ট শিশুকে ভর্তির সময় অভিভাবককে কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়, “বাড়িতে বাংলায় কথা বলবেন না।” কয়েক বছর আগে শহরের এক ঐতিহ্যপূর্ণ কলেজ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল, বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করা ছাত্রীরা ভর্তির আবেদন করতে পারবে না। কর্পোরেট সংস্থার জন্য বাংলা মাধ্যম অনুপযুক্ত— এ ধারণা অনেকেরই। অনেকেই প্রতিবেশী মেয়ের দিকে ‘বাংলা মিডিয়াম’ বলে তাচ্ছিল্য ছুড়ে দেন, আবার তাঁরাই সমাজমাধ্যমে ভাষা-প্রীতির পোস্টগুলিকে শেয়ার করে আবেগে উথলে ওঠেন। কলকাতায় বহু অবাঙালি সংস্থা কর্মী নিয়োগের বিজ্ঞাপনে সাফ লিখে দেয়, বাঙালিদের জন্য নয়। আশ্চর্য! পশ্চিমবঙ্গে বাস করে বাংলার প্রতি কেন মানুষ ন্যূনতম সংবেদনশীল নয়? একমাত্র পশ্চিমবঙ্গ বলেই হয়তো এ সব সম্ভব।

এই মুহূর্তে দুটো কারণে বাংলা ভাষাকে নিয়ে গর্ব আরও বেড়ে গিয়েছে। ১৪ অগস্ট এক স্বতঃস্ফূর্ত গণআন্দোলন সংঘটিতই হয়েছে মাতৃভাষাকে বুকে নিয়ে। জনতার গানে এসেছেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল থেকে সলিল চৌধুরী। বাঙালির লেখা-গাওয়া ‘আর কবে’ দ্রোহের অ্যান্থেমের গুরুত্ব পেয়েছে! বাংলা ছড়া, আতা গাছে তোতা পাখি বা বৃষ্টি পড়ে টাপুরটুপুরের শরীরে স্লোগান জুড়ে দেওয়া হয়েছে। দারুণ এ দুর্দিনে বাংলার এক রিকশাচালক হিন্দিতে স্পষ্ট বলেছেন, আমির-গরিব সবকা বেটি বহেন হ্যায়! নির্ণয় চাহিয়ে! তখনই প্রাঞ্জল হয়ে যায় এটাই আমার পশ্চিমবঙ্গ। বহুভাষী, অন্য রাজ্যগুলির মানুষের সহাবস্থান। তবে, নিজের রাজ্যে নিজের ভাষা আক্রান্ত হলে, যে কোনও ধরনের প্রতিবাদ সব সময় তারিফযোগ্য। বাংলা ভাষার জন্য কত মানুষ প্রাণ দিয়ে গিয়েছেন, তা ভোলা চলে না।

মাতৃভাষা আমাদের গর্বের। বাংলা ‘ধ্রুপদী’ ভাষার অভিধা বা মর্যাদা পেয়েছে। ভাষাবিদ, প্রত্নতাত্ত্বিকরা দেখিয়েছেন ‘চর্যাগান’ বাংলা পদ্য ভাষার লিখিত রূপ। কথ্য ভাষার শুরু অনেক আগে। সপ্তম-অষ্টম শতাব্দী থেকে। কত যুগ আগেই দেশের বাইরে চিন-জাপানের অভিধানে বাংলা শব্দ রয়েছে। অতীতের চন্দ্রকেতুগড় বা তাম্রলিপ্ত বাঙালির নাগরিক সভ্যতার সংস্পর্শ পেয়েছে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী থেকে। অশোকের শিলালিপি থেকে রামায়ণ-মহাভারত-এ বাংলা-বাঙালির অতীত ইতিহাস ধরা আছে। এই ধ্রুপদী বাংলা ভাষাকে নিয়ে পৃথিবীর সমস্ত বাঙালির রীতিমতো গর্ব করাই উচিত।

পায়েল বসু, কলকাতা-৮৪

অনীহা কেন

‘বাংলা গানে আপত্তি খাস বঙ্গেই, দায়ী কি বাঙালিই’ (৮-১২) প্রতিবেদনটি বেদনা জাগাল। অনেক শিল্পীই এক-দেড় ঘণ্টা ধরে টানা বাংলা গান পরিবেশনে অপারগ। কম করে ১৪-১৫টা বাংলা গানের পূর্ণ প্রস্তুতিই যে তাঁদের থাকে না! কানে-মাথায় তার গুঁজে বাংলা গান শোনার প্রবণতাও কমছে! ইংরেজি মাধ্যমে পড়ালেও সন্তানকে অনেক অভিভাবক বাংলা আবৃত্তি, সঙ্গীত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি করছেন, সেটাই আশার আলো। পুজোয় মাইক থেকে ভেসে আসা বাংলা গানের মাদকতাই ছিল আলাদা।

বিশ্বজিৎ কর, কলকাতা-১০৩

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali language Mother Tongue
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

সরাসরি দেখুন বছরের বেস্ট সন্ধ্যা

বছরের বেস্ট ২০২৪

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy