কৌশিক সেন যথার্থ বলেছেন, শিল্পীর বা শিল্পের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী নয় কোনও রাজনৈতিক দল (‘কিন্তু, আমরা কোন দিকে?’, ২৬-৬)। রাষ্ট্রশক্তি দ্বারা নির্যাতিত সাহিত্যিক সলঝেনিৎসিন বলেছিলেন, “সাধারণ মানুষের কাজ মিথ্যায় অংশ না নেওয়া। লেখক-শিল্পীদের কাজ আরও একটু বড়— মিথ্যাকে পরাস্ত করা।” প্রতিস্পর্ধার এই মূর্ত প্রতীকের একক অনমনীয় সংগ্রাম অবশ্যই এক গভীর প্রণোদনা। লেখক-উল্লিখিত নাট্যব্যক্তিত্ব স্তানিস্লাভস্কিকেও (ছবিতে) তৎকালীন রুশ কর্তৃপক্ষের বিরাগভাজন হওয়ায় হেনস্থার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। ‘মস্কো আর্ট থিয়েটার’-এর প্রতিষ্ঠাতা স্তানিস্লাভস্কিকে ২৯ অগস্ট, ১৯১৮ সালে সোভিয়েট রাশিয়ার পুলিশ ওই প্রেক্ষাগৃহ থেকে গ্রেফতার করে, পর দিন অবশ্য তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ১৯২১ সালে সরকারি অনুদান বন্ধ হয়ে গেলে অর্থের সংস্থান করতে তাঁকে নাট্যদল নিয়ে ইউরোপ এবং আমেরিকা সফরে যেতে হয়। তিনি মৃত্যুশয্যায় যাঁকে উত্তরসূরি বলে চিহ্নিত করে গিয়েছিলেন, সেই মায়ারহোল্ড-ও স্তালিনের বিরাগভাজন হন। নাট্যাভিনয়ে বায়োমেকানিক্স পদ্ধতির জনক মায়ারহোল্ডকে ১৯৩৯-এ গ্রেফতারের পর অত্যাচার করে ‘স্বীকারোক্তি’ লিখিয়ে নেওয়া হয় যে, তিনি ব্রিটিশ এবং জাপানি গুপ্তচর সংস্থার কর্মী ছিলেন। তাঁকে ১৯৪০-এ ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হয়। উল্লেখ্য, সলঝেনিৎসিনের মতো মায়ারহোল্ডও একদা ছিলেন বলশেভিক দলের সদস্য। কেবলমাত্র এঁরা বা পাস্তেরনাক নন, বিখ্যাত কবি আনা আখমাতোভা এবং ওসিপ মান্দেলস্তামও ‘স্তালিন এপিগ্রাম’ রচনার অপরাধে বন্দি হন ১৯৩৪-এ।
তথাকথিত ‘গণতান্ত্রিক’ ব্যবস্থাতেও প্রতিবাদী, স্বাধীনচেতা লেখকদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা বিরল নয়। থাকে প্রলোভন এবং পারিতোষিকের নাগপাশও। শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এক বশংবদ গোষ্ঠী গড়ে তোলা হয় কৌশলে, সরকারি স্বীকৃতি ও আনুকূল্য বিতরণের মাধ্যমে। প্রশ্ন জাগে, শিল্পীসাহিত্যিক আর বুদ্ধিজীবীরা কেন নিজেদের ব্যবহৃত হতে দেবেন?
শান্তনু রায়
কলকাতা-৪৭
স্তালিনের স্তাবক?
বলিষ্ঠ মতামতের জন্য কৌশিক সেন শ্রদ্ধার পাত্র। তাঁর নিবন্ধ পাঠ করে কতকগুলো প্রশ্ন মনে ধাক্কা দিয়েছে। যেমন, তিনি লিখেছেন, ১৯৩০ সালের গোড়া থেকে জোসেফ স্তালিন এক অভূতপূর্ব ভয়ের পরিবেশ তৈরি করেছিলেন, যার জন্য বেশির ভাগ শিল্পী তাঁদের সমর্থন ও আনুগত্য সঁপে দিয়েছিলেন পার্টির কাছে। কিন্তু, ১৯৩০ সাল থেকে রাশিয়ার শিল্প-সাহিত্য জগতে অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি হয়েছিল। যেমন, দ্য লাইফ অব ক্লিস সামগিন, দ্য ভার্জিন সয়েল আপটার্নড, দ্য বিগ রিফট, দ্য লাস্ট ডে অব দি উদেঘে-র মতো উপন্যাস। উচ্ছ্বসিত গোর্কি তখন বলেছিলেন, “কাহিনির নতুনত্বের দিক থেকে আমাদের সাহিত্য পশ্চিমকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। মনে রাখতে হবে, অষ্টাদশ শতাব্দীর পর রাশিয়ার বুর্জোয়া সাহিত্যকে জীবনে জোরের সঙ্গে প্রবেশ করতে এবং তার উপর একটা সুনির্দিষ্ট প্রভাব বিস্তার করতে একশো বছর লেগেছিল। সোভিয়েট বিপ্লবী সাহিত্য পনেরো বছরের মধ্যে সেই প্রভাব অর্জন করতে পেরেছে।” (সোভিয়েট সোশ্যালিস্ট রিয়্যালিজ়ম, সি ভন জেমস, লন্ডন, ১৯৭৩)। এর পরেও রুশ সাহিত্যে এক এক করে প্রকাশিত হয়েছে অনেকগুলি কালজয়ী গ্রন্থ। কৌশিকবাবুর কি মনে হয়, এই লেখকরা স্তালিনের বশংবদ মেরুদণ্ডহীন মানুষ ছিলেন? তাঁরা স্তালিন-পরিচালিত সমাজতন্ত্রের মধ্যে মানবাত্মার মুক্তির পথ দেখতে পেয়েছিলেন। ১৯৩০ সাল থেকে ১৯৫২ ছিল এক স্বর্ণযুগ, যখন সোভিয়েট ইউনিয়নে শিল্প-সাহিত্য-নাট্যকলা-চলচ্চিত্রের যে বিকাশ হয়েছিল, বিজ্ঞানের যে অভূতপূর্ব অগ্রগতি হয়েছিল, তার তুলনা কোথায়? স্তালিনের নেতৃত্ব বাদ দিয়ে এই যুগান্তকারী অগ্রগতির ব্যাখ্যা সম্ভব? স্তানিস্লাভস্কির জীবনে সৃষ্টির সেরা সময় হল ১৯২৪-১৯৩৮, সবটাই স্তালিন জমানায়। সোভিয়েট সমাজতন্ত্র তাঁকে নানা সম্মানে ভূষিত করেছিল। তাঁর পরিচালিত বুলকাগভের ডেজ় অব দ্য টারবিনস নাটকটি স্তালিন ১৫ বার দেখেছিলেন। স্তানিস্লাভস্কির প্রতিভার সঙ্গে যুক্ত হয় সমাজতন্ত্রের অকৃপণ সাহায্য। এই কৃতিত্ব স্তালিনকে দিতে লেখকের এত কার্পণ্য কেন?
সংযুক্তা দত্ত
হাবড়া, উত্তর ২৪ পরগনা
নাটকের বিপরীত
ভারতে শাসক দলের গণতান্ত্রিক মুখোশের আড়ালে স্বৈরতন্ত্রী মুখ দেখে শিল্পীদের সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার আবেদন করেছেন কৌশিক সেন। বাংলা নাটক গত অর্ধ শতক ধরে এক গৌরবময় অধ্যায় রচনা করে এসেছে। সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধ, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পাপ, পুরনো প্রগতি-বিরোধিতা— সমস্ত বাধার পাথর সরানোর কথাই বলেছে থিয়েটার। কিন্তু আজ সে অসহায়। ঘরের মধ্যে এসেছে সিরিয়াল। দর্শক ক্রমাগত দেখে চলেছেন অলৌকিক শক্তির দৌরাত্ম্য। থিয়েটারকে আড়াল করে সামনে এসেছে এক ঘরোয়া দানব। সন্ধ্যার পর সে বলতে থাকে— তাঁকে স্মরণ করো, সব পেতে শুধু তাঁকেই ডাকতে হবে। বাংলা থিয়েটার কিছু কি ভাবছে এখন? থিয়েটারের দর্শক যুক্তিগ্রাহ্য দর্শনের পথে বিপুল আলোড়ন আর তুলতে পারবে না?
তরুণ কুমার ঘটক
কলকাতা-৭৫
নির্বিচার সমর্থন
‘কিন্তু, আমরা কোন দিকে’— এ প্রশ্ন যে কোনও সচেতন মানুষের। আমাদের মধ্যে অনেকেই কোনও একটি রাজনৈতিক দলের সমর্থক। সেই দলের অনেক অ-সমর্থনযোগ্য কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে উদাসীন। অথচ, আমাদের তো সমর্থক হওয়া উচিত ছিল বিশেষ বিশেষ কর্মসূচির, যা দেশ, সমাজ, সর্বোপরি মানবজাতির কল্যাণ করে। অবশ্য, কোন কর্মসূচি কল্যাণকর, তার বোধ তৈরি হবেই বা কী করে? ইতিহাসের পাঠ্যক্রমে রাজা-বাদশাদের কর্মকাণ্ড বা স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস সবিশেষ প্রাধান্য পায়, কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী গণআন্দোলনগুলি প্রায় অনুল্লিখিত থেকে যায়। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসেও প্রাধান্য পায় শাসক-নির্দিষ্ট অংশ, বহু গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রাম চলে যায় বিস্মৃতির অন্তরালে।
গৌতম মুখোপাধ্যায়
কলকাতা-৭৫
স্বাতীলেখা
শিলাদিত্য সেনের ‘সেই নিরাসক্ত, কিন্তু প্রত্যয়ী মুখ’ (২৬-৬) নিবন্ধটি গত শতকের নব্বইয়ের দশকের এক অপরাহ্ণের স্মৃতি ফিরিয়ে আনল। তখন আমি আশুতোষ কলেজের ছাত্র। দেখলাম জীবনের প্রথম গ্রুপ থিয়েটার, শেষ সাক্ষাৎকার। নাটকে একটি চরিত্র সারা ক্ষণ মঞ্চের এক কোণে বসে থেকে ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যে সশব্দে পড়ে গেলেন। চরিত্রটির মুখে কোনও সংলাপ ছিল না। নির্বাক অভিনয়ে মূর্ত হয়ে উঠেছিল একমাত্র সন্তানের হত্যার শোক ও প্রতিবাদ। পরে জেনেছিলাম অভিনেত্রীর নাম স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত, সত্যজিতের বিমলা। নিবন্ধকার কেবল একটি চলচ্চিত্রে তাঁর অভিনয় মুনশিয়ানায় আবদ্ধ থেকেছেন। অবশ্য, ঘরে-বাইরে ও সম্প্রতি বেলাশেষে ছাড়া তিনি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রে অভিনয় করেননি। নিবন্ধে অনুল্লিখিত থেকে গেল স্বাতীলেখার প্রধান পরিচয়— মঞ্চের অভিনেত্রী। কেয়া চক্রবর্তীর অকালপ্রয়াণ ও অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলত্যাগের পরও ‘নান্দীকার’ নাট্যদলটি যে সফলতার সঙ্গে নাট্যাভিনয় বজায় রাখতে পেরেছিল, তাতে স্বাতীলেখার ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাঁর মতো মেধাবী, শিক্ষিত, নাচ ও গানে পারদর্শী অভিনেত্রী বাংলার নাটমঞ্চে বিরল। দর্শক আন্তিগোনে, ফুটবল, এক জন ফেরিওয়ালার মৃত্যু থেকে হাল আমলের মাধবী বা নাচনী নাটকে তাঁর অভিনয় বহু দিন মনে রাখবেন।
কৌশিক চিনা
মুন্সিরহাট, হাওড়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy