সেমন্তী ঘোষের “‘সমাজ’ আপনাদের দেখছে” (২-৪) নিবন্ধে সঙ্গত ভাবেই দিলীপ ঘোষের ‘ন্যাকামি করবেন না’ জাতীয় অভব্য মন্তব্যের তীব্র নিন্দা করা হয়েছে। কিন্তু ‘বিজেপি একা নয়’ বলার পরও শুধুমাত্র বিনয় কোঙার, অনিল বসু আর অনুব্রত মণ্ডলের নাম উল্লেখ করেছেন। এই তালিকায় আসতে পারত বিমান বসু, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, মদন মিত্র, এমনকি স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামও। মেয়েদের প্রতি অসৌজন্যমূলক উক্তি শুধু পুরুষ রাজনীতিবিদরাই করে থাকেন, এমন নয়। সর্বভারতীয় সংবাদ চ্যানেলে অপছন্দের প্রশ্ন উচ্চারণ-করা ছাত্রীকে মমতা ‘মাওবাদী’ তকমা দিয়েছিলেন। সেটাও অসহিষ্ণুতা। পার্ক সার্কাসের ঘটনায় সত্য উদ্ঘাটনকারী মহিলা পুলিশ অফিসারের বদলির নির্দেশ, কিংবা ঐশী ঘোষ আক্রান্ত হলে সেটাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা— একটু খুঁজলে এগুলোর মধ্যেও অশালীনতা পাওয়া যাবে। নারীর প্রতিপক্ষ যখন আর এক জন নারী হয়ে ওঠেন, অনেক সময় তখনই নারীর প্রতি মর্যাদাবোধ ও সৌজন্যের ছদ্ম আবরণটি খসে পড়ে। লিঙ্গ পরিচিতিকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ঢাল হিসেবে ব্যবহারের দৃষ্টান্তও ভারতীয় রাজনীতিতে বিরল নয়।
আসলে ক্ষমতার বৈশিষ্ট্যই হল আগ্রাসন। সে যাকে অপেক্ষাকৃত দুর্বল বলে গণ্য করে, তাকে হেয় করে সে যেন এক ধরনের আত্মতৃপ্তি অনুভব করতে চায়। নারীদের প্রতি সমাজে ঘটে যাওয়া অসৌজন্য বা অমর্যাদাকর ঘটনাগুলির পিছনেও ক্রিয়াশীল থাকে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের এই বৈষম্য। সে দিক দিয়ে পুরুষতান্ত্রিকতা আসলে খানিকটা লিঙ্গনিরপেক্ষ ধারণা। ‘পুরুষ’ এখানে ক্ষমতার প্রতীক। ক্ষমতার নির্লজ্জ আস্ফালন যখন অপেক্ষাকৃত দুর্বল স্বরটিকে গ্রাস করে নেওয়ার চেষ্টা করে, তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করার স্পর্ধা পায়, তখনই জন্ম হয় পুরুষতন্ত্রের। দিলীপ ঘোষের মতো রাজনৈতিক নেতারা সব দলেই রয়েছেন কমবেশি। আসলে নেতা-নেত্রীরা তো এই সমাজ কাঠামো থেকেই উঠে আসেন। দিলীপ ঘোষ, অনুব্রত মণ্ডলের মতো জনপ্রিয়তা সুগত বসু কিংবা নন্দিনী মুখোপাধ্যায় কোনও দিন পেয়েছেন কি?
এর থেকেই মনে হয়, আমাদের গণচেতনায় কোথাও যেন ক্ষমতার ভাষাটির প্রতি এক ধরনের আনুগত্য থেকে গিয়েছে। সার্বিক ভাবে সাম্য, সদাচার ও সৌজন্যের সংস্কৃতি ফিরে না এলে, রাজনীতিকে এই কদর্যতা থেকে মুক্ত করা সম্ভব নয়।
অপূর্ব সৎপতি, সারেঙ্গা, বাঁকুড়া
নীরব দল
“‘সমাজ’ আপনাদের দেখছে” নিবন্ধটিতে সেমন্তী ঘোষ টিভি চ্যানেলে মহিলাদের উদ্দেশে দিলীপ ঘোষের কিছু মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সামগ্রিক ভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের নারী বিদ্বেষমূলক মন্তব্যের কথাই বলেছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি সিপিএমের অনিল বসু, বিনয় কোঙার, কংগ্রেসের কমল নাথ, তৃণমূলের অনুব্রত মণ্ডল প্রমুখ নেতার কুরুচিকর মন্তব্যের কথাও উল্লেখ করেছেন। তবে খুব মূল্যবান যে কথাটা বলেছেন তা হল, অন্য দলগুলোর প্রধান নেতারা নারীদের সম্বন্ধে কিছু বিদ্বেষমূলক কথা বললে সেটা নিয়ে সংশ্লিষ্ট দল এবং দলের বাইরে সমালোচনার ঢেউ ওঠে। কিন্তু বিজেপির ক্ষেত্রে দেখা যায়, সাধারণ নেতৃত্ব কোনও কুরুচিকর মন্তব্য করলে, তা দলের বক্তব্য বলেই মনে হয়। এমনকি প্রধানমন্ত্রীও বিদ্রুপের সুরে এক মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখতে দ্বিধা করেন না।
অবাক লাগে, যখন প্রচারমাধ্যম, নাগরিক সমাজ বা বিদ্বজ্জনেরা বিজেপির এই ধরনের বক্তব্যের বিরুদ্ধে চুপ থাকাই পছন্দ করেন। এর দুটো ব্যাখ্যা। হয় তাঁরা সবাইকে কামড় দেওয়া পছন্দ করেন না, নয়তো কিছু লাভের আশায় মুখে কুলুপ আঁটেন। এই ধরনের নেতাদের কাছে দ্রৌপদীর লাঞ্ছনা যেমন দ্রৌপদীরই চরিত্রহীনতা, তেমনই সীতার সতীত্ব প্রমাণে অগ্নিপরীক্ষাও রামচন্দ্রের সঠিক সিদ্ধান্ত বলেই মনে হয়। তাই লেখকের বক্তব্যকে আরও একটু এগিয়ে নিয়ে বলতে হয়, এই নির্লজ্জ পুরুষ আধিপত্যবাদী সংস্কৃতিকে এখনই এমন ধাক্কা মারা প্রয়োজন, যাতে তার অচিরেই বিলুপ্তি ঘটে। যাকে বলে ‘রামধাক্কা’।
অশোক দাশ, রিষড়া, হুগলি
সমাজের দৃষ্টি
সেমন্তী ঘোষের প্রতিবেদনটি একটি প্রয়োজনীয় প্রতিবাদ। বাংলা ভাষায় ‘দিদি’ বা ‘দাদা’ সম্বোধনটির মধ্যে মিশে থাকে গভীর শ্রদ্ধা আর ভালবাসা। সেই সুন্দর সম্বোধনটিকে কত কদর্য ভাবে ডাকা যায়, তা প্রমাণ করলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। নিচুতলার রাজনৈতিক কর্মীর মতো ভাষাজ্ঞান ও প্রকাশভঙ্গিমা এক জন প্রধানমন্ত্রীর হতে পারে না। তাঁর কাছে মানুষ অনেক বেশি সংবেদনশীল এবং রুচিসম্পন্ন প্রকাশভঙ্গি আশা করেন। আর এক নেতা দিলীপ ঘোষ। ওঁর কথাবার্তায় চিরকালই ভব্যতার অভাব। এঁদের মনগড়া সমাজের বাইরেও এক অন্য সমাজ আছে। তাঁরা কিন্তু দেখছেন।
পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা-৫০
নেতাদের সংযম
“‘সমাজ’ আপনাদের দেখছে” নিবন্ধটি কিছুটা একপেশে লেখা বলেই মনে হল। কোনও পুরুষ নেতা যখন বিরোধী নেত্রীকে ‘দিদি’ বলে সম্বোধন করেন, তখন সেই শব্দ ‘হিস্-হিস্’ এক ব্যঙ্গ ধ্বনি লেখকের মর্মপীড়ার কারণ ঘটায়। অথচ, কোনও মহিলা নেত্রী যখন কোনও পুরুষ জননেতাকে প্রকাশ্য জনসভায় ‘তুই’ সম্বোধন করে তাঁর ‘বাপ’কে উল্লেখ করে গালিগালাজ করেন, অথবা তাঁদের ‘কান ধরে’ শিক্ষা দেওয়ার কথা বলেন, তখন অনেক বুদ্ধিজীবীই নীরব থাকা শ্রেয় মনে করেন, হয়তো বা এক ধরনের আত্মশ্লাঘা অনুভব করেন। সদ্য-অনুষ্ঠিত এক টিভি চ্যানেলে প্রশ্নোত্তর পর্বের অনুষ্ঠানে জনৈক মহিলার প্রশ্নের উত্তরে দিলীপ ঘোষ মহাশয়ের মুখে ‘ন্যাকামি’ শব্দটা মহিলাদের কাছে অবমাননাকর মনে হলেও কোনও মহিলা নেত্রীর মুখে ‘ঢং করা’ শব্দগুলো চলনসই মনে হয়। আসল কথা হল, লিঙ্গ-নির্বিশেষে সমস্ত নেতা-নেত্রী সংযমী হয়ে আচার-আচরণে শালীনতা বজায় রাখবেন, এটাই কাম্য। বর্তমান অস্থির যুগে মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের সময় তাঁরাই জনগণের পথপ্রদর্শক।
সোমনাথ চৌধুরী, বোলপুর, বীরভূম
কদর্য শব্দ
সেমন্তী ঘোষের লেখা পড়ে সাহস পেলাম। যেন দমবন্ধ অবস্থায় ছিলাম। নারীবিদ্বেষের প্রবল চাপে হাঁপিয়ে ওঠা মন যেন অনেকটা স্বস্তি পেল। নারীর সম্মান সাধনই হল আমাদের মূল মন্ত্র। কিন্তু সহস্র নারীবিদ্বেষী কাজ ও মন্তব্যে আমরা দিশেহারা। এই ভোটযুদ্ধে দানবিক শব্দ ব্যবহারে আমরা ভীত, সন্ত্রস্ত। এই যুদ্ধে শুধু দেখছি হীন শব্দ-অস্ত্রের ছড়াছড়ি। লক্ষ্য, নারী। নারীদের অন্তঃস্থলকে রক্তাক্ত করছে এই কদর্য শব্দভান্ডার। নারীহৃদয়ে এই মর্মান্তিক আঘাত কি নির্যাতন নয়?
মিনি ঘোষ, ইমেল মারফত
অসহ্য
সংবাদ চ্যানেলে বিশিষ্ট জনদের ভিড় এখন লেগেই আছে। দেখে মনে হয়, এঁরা ঝগড়া-বিশেষজ্ঞ। এঁদের প্রতিযোগিতা চলে নিজেকে জাহির করার জন্য। যেন ভুলে যান, এঁরা পাড়ার চায়ের দোকানে বসে নেই। তাঁদের কথার সম্প্রচার হচ্ছে দেশে-বিদেশে সর্বত্র। প্রত্যেকেই সমাজে প্রতিষ্ঠিত, শিক্ষিত জনপ্রতিনিধি, গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। কী করে ভুলে যান, গণতন্ত্রে সবার অধিকার আছে মত জানানোর? শ্রোতাদের সহ্যের একটা সীমা আছে। পয়সা খরচ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করে এই নোংরামি দেখতে আমরা রাজি নই। অন্যের বক্তব্য শোনার ধৈর্যের এত অভাব কেন? শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধের এত অভাব কেন?
বিপ্লব ভট্টাচার্য, কলকাতা-৩১
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy