‘কৌশলী’ (২৪-৬) সম্পাদকীয় সময়োপযোগী। প্রতীক আর বাস্তবের মধ্যে ফারাক বরাবরই বিস্তর। অতীতে জ়াকির হুসেন, ফকরুদ্দিন আলি আহমেদ, মহম্মদ হিদায়েতুল্লা (অস্থায়ী) এবং বিজ্ঞানী এপিজে আব্দুল কালাম ভারতের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। এটা নিশ্চিত ভাবেই রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের প্রমাণ। আবার একই সঙ্গে প্রতীকীও বটে। এর পিছনে ‘সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং’-এর কৌশল এখনকার মতো এতটা প্রকট না হলেও একেবারে যে কাজ করেনি, তা বলা যাবে না। কিন্তু এত জন বিশিষ্ট দিকপাল মুসলমান ব্যক্তিত্ব দেশের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদ অলঙ্কৃত করা সত্ত্বেও এ দেশের সংখ্যালঘু মুসলমান সমাজের প্রতি রাষ্ট্র কি মনোযোগী হয়েছে? তাঁদের অধিকাংশের জীবনযাত্রার মান কতটা উন্নত হয়েছে? সারকারিয়া কমিশনের রিপোর্ট বরং উল্টো সাক্ষ্যই দেয়। বার কাউন্সিল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি চাকরি ইত্যাদিতে মুসলমানদের অনুপাত দেশের জনসংখ্যায় তাঁদের অনুপাতের চেয়ে কম। তফসিলি জাতিভুক্ত বর্তমান রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের নির্বাচন সাড়া ফেলেছিল সারা ভারতে। তেমনই, জনজাতিভুক্ত এক মহিলা রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে যে সাড়া পড়বে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু কোবিন্দ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর তফসিলি জাতিভুক্ত মানুষদের জীবনযাত্রার মান কতটা উন্নত হয়েছে? তা হলে কী ভাবে আশা করা যেতে পারে যে, দ্রৌপদী মুর্মু রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর জনজাতিদের অবস্থারও উন্নতি হবে?
সুনীল মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-১১৪
বিরোধীর বার্তা
ভারতের স্বাধীনতা লাভের পঁচাত্তর বছরে রাষ্ট্রপতি ভবনের স্থায়ী বাসিন্দা হতে চলেছেন আদিবাসী সম্প্রদায়ের এক সম্মাননীয় মহিলা সদস্য, ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে যা একই সঙ্গে গর্বের ও আক্ষেপের। গর্বের, কারণ প্রথম বারের জন্য এক জন আদিবাসী রাষ্ট্রপতি পেতে চলেছি আমরা। আক্ষেপের, কারণ এমন একটি পদক্ষেপ করতে লেগে গেল সাত দশকেরও বেশি সময়! স্বাধীনতার পরে ভারতীয় সংবিধান প্রতিটি নাগরিকের জন্য সাম্য ও ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু বারেবারেই সে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের সাক্ষী থেকেছে ভারতের জনজাতি সমাজ। রাষ্ট্রের নানা শাসনযন্ত্রের সামনে প্রশ্নের মুখে পড়েছে তাঁদের প্রকৃতিবান্ধব জীবনযাপন, জীবিকা ও বাসস্থানের অধিকার, ন্যায়বিচার। তাই এক জন আদিবাসী মহিলাকে দেশের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদে দেখতে পাওয়াটা গর্ব ও তৃপ্তির মুহূর্ত।
পাশাপাশি প্রশ্ন উঠবে বিরোধীদের প্রার্থী নির্বাচন নিয়ে। আমরা সংবাদমাধ্যমে পড়েছি, পরাজয় নিশ্চিত জেনেও দেশের বিজেপি-বিরোধী দলগুলি ঐক্যবদ্ধ জোটপ্রার্থী দিতে বদ্ধপরিকর, কারণ তাতে একটা বার্তা দেওয়া যাবে। এ ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে দিল্লিতে বৈঠকে বসেছিলেন দেশের বিরোধী নেতারা। শরদ পওয়ার ও ফারুখ আবদুল্লাকে নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তাঁরা রাজি না হওয়ায় শেষে যশবন্ত সিন্হা। কিন্তু এত বড় একটি বৈঠকে অধিকাংশ নামই বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদদেরই উঠল কেন? রাষ্ট্রপতি পদের জন্য কি অন্য কোনও ‘যোগ্যতামান’ সে ভাবে বিবেচ্য নয়?
ভারতের প্রথম মহিলা রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিল নির্বাচিত হলেন স্বাধীনতার ষাট বছর পরে। ভারতের প্রথম দলিত রাষ্ট্রপতি কে আর নারায়ণন রাইসিনা হিলসে এসেছিলেন পঞ্চাশ বছর পরে। সে দিক দিয়ে দেখলে বিজেপির তরফে আদিবাসী সম্প্রদায় থেকে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী নির্বাচন নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। এই একই কাজ কি বিরোধীদের বৈঠকে করা সম্ভব ছিল না? যদি ‘বার্তা দেওয়া’-ই মূল উদ্দেশ্য হয়, তা হলে জনজাতি সম্প্রদায়ের কোনও বিশিষ্ট সদস্য বা প্রান্তিক সমাজের প্রতিনিধিকে এই পদে মনোনয়ন দিলে বোধ হয় আরও ভাল হত। ২০১৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের জয়িতা মণ্ডল প্রথম ‘ট্রান্সজেন্ডার’ বিচারক হিসেবে লোক আদালতের দায়িত্বভার নিয়েছেন। ২০১৯ সালে তামিলনাড়ুর নর্তকী নটরাজ প্রথম ‘ট্রান্স’ মহিলা নৃত্যশিল্পী হিসেবে পদ্মশ্রী সম্মান পেয়েছিলেন। ২০২১ সালে রাষ্ট্রপতি ভবনে পদ্মশ্রী সম্মান গ্রহণ করেছিলেন কর্নাটকের ‘ট্রান্সজেন্ডার’ লোকনৃত্যশিল্পী মাতা বি মঞ্জাম্মা জগতী। বিরোধীদের তরফে ‘বার্তা’ দেওয়ার হলে ঐক্যবদ্ধ বিরুদ্ধ মতের পাশাপাশি অনুরূপ প্রতিফলন কি রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী নির্বাচনেও করা যেত না?
সৌরদীপ চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা-৫৫
উপঢৌকন মাত্র
দ্রৌপদী মুর্মুকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন করে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং প্রগতিশীল চিন্তার প্রতি দায়বদ্ধতার দাবি করছে এনডিএ। কোনও ব্যক্তিকে আলঙ্কারিক উচ্চপদে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কী ভাবে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হবে, তা বোধগম্য হল না। অতীতেও এই ধরনের প্রতীকী পদক্ষেপ কোনও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। বরং তা সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে উপঢৌকন দেওয়ার শামিল।
শ্রীমতী মুর্মু ছিলেন জনপ্রতিনিধি, ইতিপূর্বে মন্ত্রী এবং রাজ্যপালের পদে ছিলেন। ভারতের সামাজিক সোপানে তাঁর যে অবস্থান, দেশের আদিবাসী সম্প্রদায়ের অধিকাংশ মানুষের অবস্থা তার ধারেকাছেও নয়। বিজেপি তথা এনডিএ জোটের সংসদীয় এবং পরিষদীয় শক্তি এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের নিরিখে নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিত্বকে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে মনোনীত করতেই পারে। কিন্তু এ-হেন রাজনৈতিক পদক্ষেপকে সামাজিক ন্যায়ের পঙ্ক্তিতে রাখা কতটা যুক্তিযুক্ত, প্রশ্ন থেকে যায়।
ভারতের প্রতিটি রাজনৈতিক দল ও জোট নিজেদের সুবিধামতো জনগণকে নৈতিকতার মোড়কে বিভ্রান্ত করে চলেছে। এই বিভ্রান্তি এবং তঞ্চকতার ধারা আর কত দিন ধরে চলবে?
তীর্থঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, হাউন্সলো, ইংল্যান্ড
কিসের ঐক্য?
মতাদর্শগত ভাবে যারা দুই মেরুতে অবস্থান করছে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রার্থী বাছাইয়ের লক্ষ্যে তাদের এক মঞ্চে চলে আসা খুবই আশ্চর্যজনক (‘বিরল ঐক্যের বার্তা, নাম ঠিক হবে পরে’, ১৬-৬)। রাজনীতির এই রঙ্গ বোঝা সাধারণ মানুষের পক্ষে কষ্টকর। ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে কখন যে কে কার হাত ধরবে, তা বোঝা বড় মুশকিল। ১৯৮৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময় যেমন অটলবিহারী বাজপেয়ী, জ্যোতি বসু এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বদের ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে এক মঞ্চে দেখা গিয়েছিল। সেই সময় ভিপি সিংহের নেতৃত্বাধীন সরকারকে বামফ্রন্ট বাইরে থেকে ও বিজেপি ভিতর থেকে সমর্থন করেছিল। পরবর্তী কালে সেই জ্যোতিবাবুই বাজপেয়ীর নেতৃত্বে চলা বিজেপি দলকে ‘বর্বর’ আখ্যা দিয়েছিলেন।
রাজ্যের বর্তমান শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসকেও দেখা গিয়েছে বার বার অটলবিহারীর নেতৃত্বে চলা বিজেপির হাত ধরে চলতে। বর্তমানে এই দুই দলের সম্পর্ক ‘সাপে-নেউলে’। দেশের পরিস্থিতির স্বার্থে এক সময় সিপিএম-এর দুই নেতৃত্ব কমরেড সৈফুদ্দিন চৌধুরী ও কমরেড সমীর পুততুণ্ড দলের অভ্যন্তরে কংগ্রেসের সঙ্গে হাত ধরে চলার কথা বলেছিলেন। দলের রাজনৈতিক অবস্থানের বাইরে গিয়ে এই কথা বলার কারণে তাঁদের দল থেকে সাসপেন্ড করা হয়েছিল। পরবর্তী কালে কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট পরমবন্ধুতে পরিণত হয়েছে।
সম্প্রতি বিজেপি সাংসদ, বিধায়ক ও অন্যান্য নেতৃত্বের দলবদল দেখেও মনে হয়, মতাদর্শ শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলের নিচু স্তরের কর্মীদের জন্য। ‘বৃহত্তর স্বার্থের লক্ষ্যে’ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নেতাদের এই একজোট হওয়া লোকসভা বা বিধানসভা ভোটের সময় বজায় থাকবে কি না, তা ভবিষ্যৎই বলবে।
পার্থসারথী মণ্ডল, কৃষ্ণনগর, নদিয়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy