‘মোদীপাড়ায় যা হয়’ (২১-৩) নিবন্ধ প্রসঙ্গে বলি, কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস— বঙ্গ সংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত এক পীঠস্থান, যেখানে এক উদার, আলোকিত মননের একত্রীকরণ ও চর্চা বয়ে চলেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। বাংলা সাহিত্য, চলচ্চিত্র, শিল্পকলার উপর স্বাস্থ্যকর আলোচনা ছাড়াও, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ও সেখানকার আলোচনায় সমান গুরুত্ব পায়। সেই কারণেই কফি হাউস নিয়ে মান্না দে-র আইকনিক গান প্রতিটি সংস্কৃতিমান বাঙালির হৃদয়ে সসম্মানে প্রতিষ্ঠিত!
সুতরাং, কফি হাউসে অশালীন তাণ্ডব কেবলমাত্র ‘বিজেপিকে একটিও ভোট নয়’ পোস্টারগুলির ছিন্ন পর্বের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, যা অতি সহজেই প্রতিস্থাপন করা যায়। প্রকৃতপক্ষে এই ঘটনা সংবেদনশীল, উদার বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের উপর এক আক্রমণ। কফি হাউসের নাম ‘ইন্ডিয়ান’ দিয়ে আরম্ভ হওয়ায় দুষ্কৃতীরা জোর দিয়ে ঘোষণা করেছে, প্রত্যেক ভারতীয়ের এখানে প্রবেশাধিকার আছে! কেউ কোনও ভারতীয়কে (বা বিদেশিকে) কফি হাউসে প্রবেশ করতে বাধা দেয়নি, এর নাম যদি ‘বেঙ্গল কফি হাউস’ হত, তা হলেও কেউ বাধা দিত না! তবে কফি হাউসে সবার প্রবেশাধিকার থাকলেও, সেখানে তাণ্ডব চালানোর অধিকার কারও নেই!
তৃতীয়ত, হিন্দুত্ববাদীদের মুখে ভারতীয়ত্বের বাগাড়ম্বর শুনলে সত্যিই হাসি সংবরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে! ভারতের আসল মর্মকে উপলব্ধি করতে যারা চূড়ান্ত ব্যর্থ, তারা স্বাভাবিক ভাবেই বহু-সংস্কৃতির এই দেশে বাঙালি মুসলিম, খ্রিস্টান, জনজাতি, দলিতদের যে সহজে বরণ করে নেবে না, এ তো বলা বাহুল্য! মনের উন্মুক্ত জানালা দিয়ে চিনা, রুশ-সহ যে কোনও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বায়ু যে অবাধে খেলা করতে পারে, তা এঁরা মানতে চান না।
যে গোষ্ঠীটি কফি হাউসে ঢোকার বেলা সকল ভারতীয়ের ‘সমানাধিকার’ সম্বন্ধে জ্ঞান দান করার স্পর্ধা দেখায়, তারা সর্বপ্রথমে ‘হিন্দি-হিন্দু’ সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতা থেকে নিজেদের উত্তরণ ঘটিয়ে, এই দেশের প্রতিটি নাগরিকের মাতৃভাষা আর ধর্মীয় আবেগকে শ্রদ্ধা করতে শিখুক!
কাজল চট্টোপাধ্যায়, সোদপুর, উত্তর ২৪ পরগনা
চাই প্রতিরোধ
‘মোদীপাড়ায় যা হয়’ নিবন্ধে গৌতম চক্রবর্তী যে ভাবে কফি হাউসে গেরুয়া বাহুবলীর তাণ্ডবনৃত্যের ছবিটি তুলে ধরেছেন, তার জন্য ধন্যবাদ। যে ভাবে এক দল গেরুয়া লুম্পেন কফি হাউসের পোস্টার ছিঁড়ে তাণ্ডব চালিয়ে ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠানকে কালিমালিপ্ত করল, তা নিন্দনীয়। ‘বুদ্ধিজীবী’ হিসেবে পরিচিত যে চলচ্চিত্র পরিচালক, গায়ক, সিরিয়ালের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা বিজেপির হয়ে ভোটে দাঁড়িয়ে তাদের সমর্থন করলেন, নীরবে এই কলঙ্কজনক ঘটনাকে মেনে নিলেন, তা নিঃসন্দেহে বাঙালির দুর্ভাগ্য। তবে বাংলার বর্তমান সংস্কৃতি জগতের লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, খেলোয়াড় প্রমুখ ‘প্রতিবাদী’ বুদ্ধিজীবীরা এই ঘটনার প্রতিবাদে রাস্তায় বেরোলেন না কেন?
১৯৭৪-৭৫ সালে কলকাতায় যখন পড়তাম, আমরা বন্ধুরা চার-পাঁচ জন মিলে মাঝে মাঝে দল বেঁধে কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসে ঢুঁ মারতাম। উদ্দেশ্য, একতলার টেবিলে ঘুরে ঘুরে কবি, সাহিত্যিক, কোনও দিন সঙ্গীতশিল্পী, খেলোয়াড় দেখা। কখনও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পা ছুঁয়ে প্রণাম, কখনও শ্যামল মিত্রকে জড়িয়ে ধরা, আবার কখনও চুনী গোস্বামীর সঙ্গে করমর্দন করে আনন্দে আপ্লুত হওয়া, সবই আজ স্মৃতি। বাংলার শিক্ষিত মানুষের কাছে অনুরোধ, অবিলম্বে এই দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলুন।
তপনকুমার বিদ , বেগুনকোদর, পুরুলিয়া
দুর্বৃত্তের আনন্দ
গৌতম চক্রবর্তীকে অভিনন্দন, তিনি সঠিক সময়ে উপযুক্ত শেল নিক্ষেপ করেছেন। তবে যারা কালি লেপে দিয়েছিল ভিন্ন মতাদর্শকে মান্যতা না দিতে পেরে, যাদের আঁতে ঘা লাগে বিরূপ কিছু দেখলে, তাদের খুব একটা পাত্তা দেওয়ারই বা কী প্রয়োজন? কফি হাউস তার স্বনামে পৃথিবীবিখ্যাত। আমরা যাঁদের ছবি দেখে সিনেমার ভাষা বুঝতে শিখেছি, যাঁদের গুরুগম্ভীর গদ্য না বুঝেও নতজানু হয়েছি কফি হাউসের কাছে, কারণ তাঁরা এখানে দিনের পর দিন কয়েক শতক এগিয়ে-যাওয়া ভাবনা সরবরাহ করেছেন উত্তরসূরিদের জন্য, তাঁদের কথা জানার মানসিকতা নেই ওই মারকুটে দাঙ্গাবাজ নেতার, যিনি জনা বিশ শাগরেদ নিয়ে দাপিয়ে বেড়ালেন সারস্বত-পীঠস্থান। তাই, ‘কালবেলা’-র সংলাপ এবং নিহিতার্থ এদের কাছে পেশ করার অর্থ, উলুবনে মুক্তো ছড়ানো। কফি হাউস নারী-পুরুষের বিভাজন রেখার ঊর্ধ্বে উঠে দামাল-বিদগ্ধ জ্ঞান-বৈভবকে সম্মান প্রদান করে। তাকে পদদলিত করাতেই যাদের আনন্দ, তাদের কে বোঝাবে— একটা পোস্টারের যা বক্তব্য, পাশের পোস্টারে জ্বলজ্বল করতেই পারে তা থেকে ভিন্ন মত।
এখন অহরহ উচ্চারিত মনীষীদের ভুলভাল উক্তি, এমনকি রবি ঠাকুরের জন্মস্থান নিয়েও অজ্ঞানতা যাদের লজ্জিত করে না, তাদের কাছে ওই সিঁড়ির দেওয়ালের বিবিধ চিন্তাধারার ‘গ্রাফিতি’ স্রেফ একটা বাজারচলতি ছবির পোস্টারের মতো। যাদের দম্ভ প্রকাশিত হয় ‘জয় শ্রীরাম’ উচ্চারণে, তারাই তো স্বৈরতন্ত্রের প্রবর্তক। কফি হাউসের ইতিহাসকে তোয়াক্কা না করাতেই তাদের আনন্দ।
ধ্রুবজ্যোতি বাগচি, কলকাতা-১২৫
অসৌজন্য
২২ মার্চ কাগজের প্রথম পাতায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য ছাপা হয়েছে। মোদী বলেছেন, “দিদি আপনি চাইলে আপনার পা আমার মাথায় রাখতে পারেন। আমাকে লাথিও মারতে পারেন। কিন্তু আপনাকে আর বাংলার বিকাশকে লাথি মারতে দেব না” (“তৃণমূল মানেই ‘স্ক্যাম’: মোদী”)। অন্য দিকে মমতা এ দিন বলেছেন, “ভেবেছ এক পায়ে কিচ্ছু করতে পারব না। ওই এক পায়েই এমন শট মারব বাংলার বাইরে গিয়ে পড়বে” (‘না গেলে আমরা তাড়াতাম: মমতা’)। একটি বক্তব্যে সৌজন্যের অভাব, ও অন্যটি প্রতিহিংসার মতো শোনাচ্ছে। রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের মধ্যে যে হিংসাত্মক বাক্য বা অপশব্দ ব্যবহার হচ্ছে, সেটা বাংলা বা ভারতের সংস্কৃতি নয়। দেশ বা রাজ্যের সর্বশক্তিমান পদে যাঁরা অধিষ্ঠিত, তাঁদের মধ্যে সংযমের অভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। রাজনীতিতে তর্ক থাকবে, কিন্তু সৌজন্যের অভাব যেন না থাকে। অনেক সময়ে মমতার কথা শুনে ও ব্যবহার দেখে মনে হয়, ঘরের মেয়ে। আবার কিছু সময় সেই ঘরের মেয়েকে ঠিক চিনতে পারি না।
তাপসকুমার সরকার, কলকাতা-১২৫
কেবল তোষণ
আজকাল রাজ্যের রাজনীতিতে মতুয়া সম্প্রদায়কে নিয়ে যে জাতপাতের রাজনীতির প্রসার ঘটছে, তা দুঃখজনক ও নিন্দনীয় (“‘মতুয়ারা হতাশ’, বেসুরো মঞ্জুলকৃষ্ণ”, ২২-৩)। সংখ্যালঘু ও দলিতদের নিয়ে ভোটব্যাঙ্ক তৈরির তোষণের রাজনীতি আমরা দেখেছি। এ বার যোগ হচ্ছে এই রাজ্যের মতুয়া সম্প্রদায়। অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসঙ্ঘের বিধানসভার ভোটে বিজেপির কাছে ৩০টি আসন দাবি করা (যদিও মানা হয়নি) বলে দিচ্ছে, আগামী দিনে জাতপাতের নিরিখে তাঁদের রাজনৈতিক দর কষাকষি বড় আকার নেবে। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে তোষণ, আর জাতপাতের নামে ইন্ধন, এটাই এখন গণতন্ত্রের একমাত্র রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘সংরক্ষণ’-এর মতো বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা এখনও এ দেশে টিকে আছে। এর থেকে লজ্জা আর কী হতে পারে?
মিহির কানুনগো, কলকাতা-৮১
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy