পয়লা বৈশাখ শুধু একটি তারিখমাত্র নয়, বাঙালির উৎসবের দিন। ফাইল ছবি।
অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘যুক্তসাধনার নববর্ষ’ (১১-৪) পড়ে বাঙালি হিসাবে বাংলা নববর্ষ নিয়ে কিছু বলার ইচ্ছা জাগল। পয়লা বৈশাখ বাঙালির অসাম্প্রদায়িক উৎসব। বাংলা নববর্ষ বাঙালি সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে। ইংরেজি নতুন বছরের দিন শুরু হয় মধ্যরাতে। আর বাংলা সাল শুরু হয় ভোরে, সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে। ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে হয়েছিল বাংলা সনের প্রবর্তন। মোগল সম্রাট আকবরের আদেশে তাঁর রাজস্ব কর্মকর্তা ফতেহ উল্লাহ সিরাজি ‘সৌর সন’ এবং আরবি ‘হিজরি’ সালের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সন তৈরি করেন। হজরত মহম্মদের মক্কা থেকে মদিনা যাত্রার সময়টিকে (৬২২ খ্রিস্টাব্দে) সূচনা বিন্দু ধরে ‘হিজরি’ অব্দের গণনা শুরু হয়। প্রথমে এই সালের নাম ছিল ‘ফসলি সন,’ পরে তা ‘বঙ্গাব্দ’ বা ‘বাংলা নববর্ষ’ নামে পরিচিত হয়। অনেকে মনে করেন, বাংলা দিনপঞ্জির উদ্ভব ঘটান বাংলার স্বাধীন রাজা গৌড়েশ্বর শশাঙ্ক। ইতিহাসবিদদের মতে, বঙ্গাব্দের গণনায় আকবরের রাজ্যাভিষেককেই সূচনা বলে ধরে নেওয়া হয়।
সম্রাট আকবরের বাংলা সন প্রবর্তনের সঙ্গে শুরু হয় ‘হালখাতার প্রথা’। হালনাগাদের খাতাটি হল বিগত বছরের যাবতীয় হিসাব বিবরণীর নথি। আজও ব্যবসায়ীরা লাল রঙের শালু কাপড়ের মলাটে মোড়ানো খাতাটি ব্যবহার করেন। নববর্ষের প্রথম দিন ব্যবসায়ীরা গ্রাহকদের হিসাবের হালখাতা অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ করেন। থাকে মিষ্টিমুখের আয়োজন। পয়লা বৈশাখ শুধু একটি তারিখমাত্র নয়, বাঙালির উৎসবের দিন। আহারে-বিহারে সাজগোজে বাঙালিয়ানার ছোঁয়া থাকে এই দিনটিতে। বাঙালির অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে হলে নিজস্ব সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে। চর্চা করতে হবে। মনে-প্রাণে তাকে লালন করতে হবে। যে জাতি যত সংস্কৃতিমান, সেই জাতি তত উন্নত এবং সমৃদ্ধ। নববর্ষ মানে বিগত বছরের সমস্ত জীর্ণতা ও মলিনতাকে মুছে দিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর দিন।
বিপদতারণ ধীবর, বেলিয়াতোড়, বাঁকুড়া
ভাস্করাব্দ
‘যুক্তসাধনার নববর্ষ’ পড়তে পড়তে ১৪০০ বঙ্গাব্দে ‘বঙ্গাব্দ’ নিয়ে আয়োজিত একটি সেমিনারের কথা মনে পড়ল। আব্বাসউদ্দিন স্মরণ সমিতি আয়োজিত ওই আলোচনা সভার আয়োজক ছিল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, সভাপতি ছিলেন প্রতাপচন্দ্র চন্দ্র। উক্ত সেই সভায় গুণধর বর্মণ উত্থাপিত ‘বঙ্গাব্দ কি আসলে ভাস্করাব্দ’ বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলেন। ভারতকোষ মতে, মুসলমানদের আগমনের পর এ দেশে রাজকার্যে হিজরি অব্দ ব্যবহৃত হয়। কিন্তু হিজরি অব্দ ৩৫৪ দিনে পূর্ণ হয় বলে হিজরির বর্ষারম্ভ বৎসরের যে কোনও দিনে, বা সময়ে হতে পারে। এতে রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত রাজকার্যে অসুবিধা হয়। দাবি করা হয় যে, সেই কারণে মোগল সম্রাট আকবর বঙ্গাব্দ প্রচলন করেন। বাদশার দিল্লির সিংহাসনে আরোহণের বছর ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু হয় এই বঙ্গাব্দ।
পৃথিবীর উপগ্রহ চাঁদ পৃথিবীর চার পাশে এক বার ঘুরে আসতে সময় নেয় ২৯.৫৩০৫৮৮ অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ঊনত্রিশ সৌর দিন। এই সময় পরিমাণকে বলা হয় এক চান্দ্র মাস। অতএব, এক চান্দ্র বৎসর হয় সাড়ে ঊনত্রিশ গুণিতক বারো, অর্থাৎ ৩৫৪ দিন, যা সৌর বৎসরের থেকে ১১ দিন কম। এই চান্দ্র বৎসর অনুসারে ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জুলাই শুক্রবার ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হজরত মহম্মদের মক্কা থেকে মদিনায় প্রস্থানের ‘হিজরত’ দিনটিকে ধরে নিয়ে শুরু হয়েছিল ‘হিজরি’ অব্দ। হিজরির শুরু ৬২২ থেকে ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ, হল ৯৩৪ খ্রিস্টাব্দ। আবার যে-হেতু প্রতি সাড়ে বত্রিশ খ্রিস্ট সনে এক বৎসর হিজরি সন বৃদ্ধি পায়, তাই ৯৩৪ খ্রিস্ট বৎসরে অতিরিক্ত হিজরি বছরের সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৩৪/৩২.৫= ২৮.৭৩, অর্থাৎ ২৯। অর্থাৎ, ৯৩৪ খ্রিস্ট বছর মানে ৯৩৪+২৯=৯৬৩ হিজরি বৎসর।
ভারতকোষ প্রদত্ত সূত্রে “১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের হিজরা সংখ্যা ৯৬৩-এর সহিত তৎ পরবর্তী সৌর বৎসর সংখ্যা যোগ করিলে বর্তমান কালের বঙ্গাব্দ পাওয়া যায়।” সেই হিসাবে, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ হল ২০২৩-১৫৫৬=৪৬৭+৯৬৩=১৪৩০ বঙ্গাব্দ। স্পষ্টতই, বঙ্গাব্দের প্রাক্ ১৫৫৬ অংশ চান্দ্রমতে এবং পরবর্তী অংশ সৌরমতে গণনা করা হয়েছে। বঙ্গাব্দে সূর্য ও চন্দ্র, দুইয়েরই ভূমিকা রয়েছে।
তত্ত্বটিতে গোঁজামিল আছে বলে মনে হয়েছে। আমরা জানি, বিশেষ বিশেষ অব্দ শুরু হয়েছে কোনও রাজা, বাদশা বা সম্রাটের সিংহাসন আরোহণ তারিখ, বা কোনও মহাপুরুষের জন্ম তারিখ থেকে। খ্রিস্টের জন্মকাল স্মরণ করে সারা বিশ্বে যে ‘খ্রিস্টাব্দ’ শুরু হয়েছিল গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডার রূপে ৩৬৫ বা ৩৬৬ দিনের সৌরবৎসর ধরে নিয়ে, তার সঙ্গেই সম্পর্কযুক্ত করা হয়েছে সব অব্দকে। ‘শকাব্দ’ শুরু হয়েছিল ৭৮ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট কনিষ্কের সিংহাসন আরোহণের বর্ষ থেকে। ‘হর্ষাব্দ’ প্রচলিত হয় ৬০৬ খ্রিস্টাব্দে কান্যকুব্জরাজ হর্ষবর্ধনের সিংহাসন আরোহণের বর্ষ থেকে। সেই সময়ে পূর্ব ভারতে প্রতাপশালী রাজা ছিলেন কামরূপাধিপতি ভাস্কর বর্মা বা ভাস্কর বর্মণ। হিউয়েন সাং-এর বিবরণ মতে, শশাঙ্কের মৃত্যুর পরে সমস্ত পশ্চিমবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গের অধিপতি হয়েছিলেন ভাস্কর বর্মা, যাঁর কামরূপ সিংহাসন আরোহণে ৫৯৩ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয়েছিল ‘ভাস্করাব্দ’। আমার ধারণা, এই ভাস্করাব্দই হল বঙ্গাব্দ। ২০২৩ থেকে ৫৯৩ বাদ দিলেই ১৪৩০। অসম ও বাংলা পঞ্জিকায় ভাস্করাব্দের উল্লেখ ও গণনা এই বিশ্বাসকে দৃঢ় করে।
সুখবিলাস বর্মা, কলকাতা-৯১
তারিখ-ই-ইলাহি
অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের প্রবন্ধটি সময়োপযোগী রচনা। মোগল সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহণের সাল ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দকে ধরা হয়েছে বঙ্গাব্দের সূচনা হিসাবে। মনে হয়, এখানে একটি সামান্য বিভ্রান্তি রয়ে গেছে। এর সঙ্গে আরও ২৮ বছর যুক্ত করলে তবে হিসাব মিলছে। সুতরাং, ১৫৮৪ সালকে বঙ্গাব্দের সূচনা কাল ধরতে হবে, যখন আকবর বিভিন্ন আঞ্চলিক সাল গণনা পদ্ধতির অসঙ্গতি দূর করার জন্য জ্যোতিষ শাস্ত্রবিদ ফতেহ উল্লাহ সিরাজির নেতৃত্বে ‘তারিখ-ই-ইলাহি’ প্রচলন করেন। চান্দ্রমাস ভিত্তিক ইসলামিক ক্যালেন্ডার ও সৌরমাস ভিত্তিক হিন্দু ক্যালেন্ডার-এর সমন্বয়ে এক নতুন গণনা পদ্ধতির সূচনা হয়। হিজিরা সন ৬২২-কে ভিত্তি বছর ধরে, ও ১৫৮৪ সালকে সূচনা বছর ধরলে তবেই আমরা ৯৬২ হিজিরা সনকে বঙ্গাব্দের শুরু ধরতে পারি। মূলত, বাৎসরিক শস্য উৎপাদন এবং রাজস্ব আদায়ের হিসাব রাখার সুবিধার জন্য এই নতুন ‘তারিখ-ই-ইলাহি’ সন পদ্ধতির সূচনা করা হয়, এবং আমাদের বঙ্গদেশে বঙ্গাব্দের ক্যালেন্ডার চালু হয়, যার ফলে আঞ্চলিক অসঙ্গতি দূর হয়।
তপনকুমার মুখোপাধ্যায়, সুভাষপল্লি, বর্ধমান
কেন প্রবাসী?
বুবুন চট্টোপাধ্যায়ের ‘দেশ ছেড়ে যেতে মরিয়া’ (২৯-৪) একটি বাস্তব সমস্যার প্রতি আলোকপাত করেছে। যাঁদের আর্থিক সচ্ছলতা আছে, তাঁরা অনেকেই দেশ ছাড়তে আগ্রহী। শুধু নবপ্রজন্মকে দোষারোপ করলেই হবে না। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও এত দুর্নীতি, কুসংস্কার, ধর্মীয় উন্মাদনা, অপদার্থদের আস্ফালন, অসহনীয় দূষণ, নতুন প্রজন্মের মধ্যে দেশের প্রতি বিরাগের জন্ম দিয়েছে। আমার পরিচিত এক জনের মেয়েকে লন্ডনে পড়তে যাওয়ার প্রাক্কালে প্রশ্ন করেছিলাম, সে কেন যাচ্ছে। উত্তরে সে বলেছিল, ভারতের মানুষ শুধু যে অনুন্নত জীবন যাপন করে তা-ই নয়, তারা উন্নত হতেও চায় না।
সুরজিত কুন্ডু, উত্তরপাড়া, হুগলি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy