ইতিহাসে এক সময় জায়গা ছিল শুধু রাজা-রানিদের। —ফাইল চিত্র।
কৌশিক সেন যথেষ্ট নৈপুণ্যে তাঁর প্রবন্ধে (আমাদের টিনের তলোয়ার, ৯-৭) সঙ্কীর্ণ রাজনীতিতে সাধারণ মানুষের ভূমিকা আর শিল্প সংস্কৃতির গুরুত্ব সম্পর্কে মনোজ্ঞ আলোচনা করেছেন। ইতিহাসে এক সময় জায়গা ছিল শুধু রাজা-রানিদের। ইতিহাস লিখতেন মূলত ফরমায়েশি ইতিহাসবিদরা। ফলে সে লেখা কেমন হয়ে ওঠে, আজ আর অজানা নয়। পরবর্তী কালে সমাজ বা সাধারণ মানুষের ইতিহাসে আসতে শুরু করল আরও অনেক সূক্ষ্ম ও জটিল বিষয়। ইসলামি শাসকদের সমালোচনা, ব্রিটিশদের সাম্রাজ্যবাদ, রেনেসাঁসের আলোর ছটার সঙ্গে কূটনৈতিক স্বার্থপরতার বিষ মিশিয়ে এসে গেল স্বাধীনতা। পরবর্তী কালে বাবরি মসজিদের ধ্বংস রূপ নিল ভারতের ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ অবাঞ্ছিত দুর্ঘটনার। স্বাধীনতার পরে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া অসামাজিক শান্তি ভঙ্গকারী এত বড় মাপের কোনও ঘটনা ঘটেনি। এ দেশের হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের মানুষের মধ্যের সম্পর্কে সেটা যেন মর্মান্তিক এক আঘাত। ঠিক তার পরের দিন মাতামহের এক মুসলিম বন্ধু বাজারে দেখা হতে বলেছিলেন, “কী রে তোরা কি আমাদের এ দেশ থেকে তাড়াবি?” করুণ কাতর খেদোক্তি। বয়স তখন কম। কিন্তু ধাক্কা খেয়েছিলাম বেশ।
আজ এক শ্রেণির বিভেদকামী শক্তি ধর্মীয় ঘৃণা ছড়াতে বিজ্ঞান ইতিহাস পুরাণ থেকে উপাদান নিয়ে মানুষকে প্রভাবিত করার জন্য আর্থিক বিনিয়োগ করছে। তৈরি হচ্ছে চলচ্চিত্র, রচিত হচ্ছে নতুন ইতিহাস, বিকৃত হচ্ছে বিজ্ঞান, বাদ যাচ্ছেন মুক্তমনা উদার মানুষের কর্ম কৃতিত্ব। এ সবের মোকাবিলায় দরকার পাল্টা শিল্পস্রষ্টা ও উদারপন্থী সৃষ্টিশীল মানুষের সমবেত প্রয়াস। বহু মানুষের মধ্যে বিদ্বেষহীন ঘৃণামুক্ত মানবিক বোধসমৃদ্ধ মন আজও বেঁচে। নেই শুধু বহু মানুষের যে বিশেষ ক্ষেত্রে ঐকমত্য, সেগুলো চিহ্নিত করে দেশজ উপাদান মিশিয়ে শিল্প সংস্কৃতি নাটক কবিতা গানে রূপ দেওয়া।
সব মানুষকে নিয়ে যে যার শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্র থেকে ছোট ছোট প্রতিবাদের স্বরগুলোকে মিশিয়ে এক জায়গায় আনলে এবং ভূমিকাগুলো নির্দিষ্ট করে দিলে প্রতিবাদ জোর পায়। সামাজিক ঐক্য বিনাশকারী শক্তিকে পরাভূত করার লড়াইয়ে সেই টিনের তরোয়ালই হয়ে উঠতে পারে ইস্পাতের।
শান্তি প্রামাণিক, হাওড়া
দায়িত্ব সবার
কৌশিক সেনের প্রবন্ধ সম্পর্কে কয়েকটি কথা। উনি সাম্প্রদায়িকতাকে আটকানোর জন্য কেবলমাত্র বিজেপি-আরএসএস’এর মতাদর্শকে রুখে দেওয়ার কথা বলেছেন। কেন তিনি মুসলিম লীগ বা অন্য ঘোষিত সাম্প্রদায়িক দলগুলির মতাদর্শের বিরুদ্ধে লড়াই করার কথা বললেন না? সাম্প্রদায়িকতাবাদকে সফল ভাবে বিরোধিতা করার জন্য তার বিকাশের অনুকূল সামাজিক অবস্থাকে উচ্ছেদ করতে হবে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সাম্প্রদায়িক হিংস্রতা, দাঙ্গা ও সন্ত্রাসবাদের বিরোধিতা করেও কোনও ব্যক্তি শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িকতাবাদে বিশ্বাসী, এমনকি তার প্রচারকও হয়ে যান।
আসলে সাম্প্রদায়িক মতাদর্শের পক্ষে বহু বছর ধরে বেঁচে থাকা ও বাড়তে থাকা সম্ভব। দুর্ভাগ্যবশত, আমরা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা না ঘটলে এই মতাদর্শকে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখাই। আমরা সাম্প্রদায়িকতাবাদ সম্পর্কে সচেতন হই কেবল দাঙ্গা হলে। কিন্তু এটা যে একটা মতাদর্শ এবং তা যদি কেবল বিজেপি-আরএসএস’এর মধ্যেই খুঁজে বেড়াই, তা হলে বিপদটা আরও বেড়ে যাবে। বিগত দেড়শো বছর ধরে এই মতাদর্শকে ঢোকানো হয়েছে। তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার আড়ালে প্রায় সকল রাজনৈতিক দল এই সাম্প্রদায়িক মতবাদকেই তোষণ করে ভোটের লোভে। বলপ্রয়োগ করে এই মতাদর্শকে রোখা যায় না। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে অবশ্যই বলপ্রয়োগ করে রাষ্ট্র দমন করবে। কিন্তু সর্ব স্তর থেকে সাম্প্রদায়িকতাবাদকে নিশ্চিহ্ন করতে হলে আরও বেশি করে দায়িত্ব নিতে হবে বুদ্ধিজীবী, প্রচারমাধ্যম, স্বেচ্ছাসেবক গোষ্ঠী এবং শ্রমিক-কৃষক সংগঠনগুলিকে। সংখ্যাগরিষ্ঠের সাম্প্রদায়িকতাবাদের পরিণতি যেমন ফ্যাসিবাদ, তেমনই সংখ্যালঘুর সাম্প্রদায়িকতাবাদের পরিণতি বিচ্ছিন্নতাবাদ। এই দু’টি দিকের বিরুদ্ধেই আমাদের সচেতন হতে হবে। রাজনৈতিক দল, পুলিশ, গোয়েন্দা ও প্রশাসনকেও সাম্প্রদায়িকতামুক্ত হতে হবে।
সন্দীপ সিংহ, হরিপাল, হুগলি
ঠকে শেখা
ভারতীয় রাজনীতিতে ধর্ম এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় কথা, নিশ্চিত ভাবে। দেশ জুড়ে কম-বেশি সব রাজনৈতিক দল ধর্মকে নিজেদের মতো করে ব্যবহার করে। এর মধ্যে দু’-একটি দল আছে যারা রাখঢাক না করে সরাসরি ধর্মের রাজনীতি করে। খুব স্বাভাবিক ভাবে এমন রাজনীতির বিপদ পদে পদে। যখন সাধারণ মানুষের অতি সাধারণ চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলে না, তখনই ধর্মের তাস খেলার একটা মোক্ষম সময়। আমরা বিগত কয়েক দশক ধরে খুব ধারাবাহিক ভাবে এমন রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছি। মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন এখন জলভাত। হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটির প্রভাব মারাত্মক। জাল খবরের দৌরাত্ম্য চলছে অবিরাম ভাবে। গরিব, ভূমিহীন, প্রান্তিক মানুষের জীবনের কথা কোথাও আলোচনা চলছে না। কেবলমাত্র ধর্মের মোহে পড়ে অন্ধ হয়ে বসে আছে। এই ভাবে মুক্তির সোপান মিলবে না। আগামী দিনে এর ভয়াল থাবা থেকে বাঁচতে পারব কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। অধিকাংশ মানুষ ঠকে শেখে, ভারতীয় রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার মানুষ কতটা ঠকে শিখতে পারল, আগামী দিনে হয়তো তার উত্তর মিলতে পারে।
সৈয়দ সাদিক ইকবাল, সিমলা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
অন্য আগ্রাসন
‘আমাদের টিনের তলোয়ার’ শীর্ষক প্রবন্ধে কয়েকটি কথা খুবই আপত্তিকর ঠেকল। মনে হল, আমাদের দেশে একটি সম্প্রদায়েরই কি সমস্ত দায় ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখার? তারাই কি এ দেশের সমস্ত দাঙ্গার জন্য দায়ী? প্রথমত, প্রবন্ধে বলা হয়েছে, “...বিনায়ক দামোদর সাভারকর এবং মাধব সদাশিবরাও গোলওয়ালকরের বিপজ্জনক মতাদর্শকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার প্রয়াস।” সাভারকর ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেন। তা ছাড়া, এই দুই পুরুষই নিজের ধর্মকে রক্ষা করার প্রয়াস করেছেন মাত্র। এখানে প্রশ্ন তোলা যায়, অন্যান্য ধর্মের নেতারা যখন ঘৃণাভাষণ দিয়ে নিজের ধর্মের লোকেদের উস্কে দিলেন, তখন তো কই লেখক তাঁকে বিপজ্জনক মতাদর্শের তকমা দিলেন না! ‘সাম্প্রদায়িকতা’ শব্দটি কি কেবল এক ধর্মের প্রতিই খাটে?
দ্বিতীয়ত, লেখকের বক্তব্য, “প্রয়োজন বিজেপি আরএসএস-এর মতাদর্শকে রুখে দেওয়া।” আমার প্রশ্ন, দেশের জনগণ কি এতটাই অবুঝ যে, তারা এক ধর্ম-আগ্রাসী পার্টিকে দু’বার লোকসভা ভোটে জয়ী করল? পাশাপাশি, শুধুমাত্র আরএসএস ধর্ম-আগ্রাসী, আর পিএফআই, এআইএমআইএম প্রভৃতি পার্টি কি ধর্মনিরপেক্ষ পার্টিমাত্র? তাদের মতাদর্শ রুখে দেওয়ার কোনও প্রয়োজন প্রবন্ধকারের চোখে পড়েনি? তৃতীয়ত, বাবরি মসজিদ ধ্বংস হয়েছে, তা অত্যন্ত দুঃখের কথা। তাকে প্রচারকেন্দ্রে আনা দরকার। কিন্তু কাশ্মীরি পণ্ডিতদের প্রতি অন্য ধর্মের আগ্রাসন, তাঁদের উপর অত্যাচার ও তাঁদের মন্দির ধ্বংস করার খবর প্রচারকেন্দ্রে আনার স্বল্পতম প্রয়াসও কি একেবারেই অপ্রয়োজনীয়?
আত্রেয় মণ্ডল, যোগেশপল্লি, বাঁকুড়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy