—প্রতীকী ছবি।
ওসমান মল্লিকের ‘শরিয়া পুরুষেরও প্রতিকূল’ (২৪-৭) শীর্ষক প্রবন্ধে কেন্দ্রীয় সরকারের পদক্ষেপকেই প্রকারান্তরে সমর্থন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্রায়ই যে স্লোগান তুলে ৩৭০ ধারা বাতিল-সহ নানা বিভেদ-সৃষ্টিকারী আইন প্রণয়ন করছেন, তা হল, ‘এক দেশ এক আইন’। বাস্তবে ভারত কি এক দেশ, এক জাতি হিসাবে গড়ে উঠেছে? ধর্ম-বর্ণ-জাতপাতের বিভাজন কি দূর করা গেছে? না কি গত এক দশক ধরে প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে বিভাজনের এই প্রক্রিয়া আরও সক্রিয় হয়েছে?
সংখ্যালঘু মুসলিম ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ তৈরিই হয়েছে মোদীর দলের লক্ষ্য। তাই তাদের খাদ্যের অধিকার, ধর্মাচরণের অধিকার, ভারতীয় নাগরিক হিসাবে বসবাসের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। সেই উদ্দেশ্যেই এনআরসি-সিএএ নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের হুমকি শুনেছে দেশবাসী। খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধেও আমরা তাদের একই রকম আচরণ প্রত্যক্ষ করছি। দেশটাই যেখানে এক হতে পারেনি, সেখানে ‘অভিন্ন’ দেওয়ানি বিধি চালু করার জমি তৈরি হতে পারে কি? এই কারণেই একুশতম আইন কমিশন অভিন্ন বিধি প্রণয়নে কেন্দ্রের প্রচেষ্টাকে ‘অপ্রয়োজনীয়’ বলে অভিহিত করে বলেছে, বেশির ভাগ দেশ এখন পার্থক্যের স্বীকৃতির দিকে এগোচ্ছে। পার্থক্যের অস্তিত্ব কেবল বৈষম্যকে বোঝায় না, একটি শক্তিশালী গণতন্ত্রের ইঙ্গিত দেয়। কমিশনের পরামর্শ, পারিবারিক আইনের বৈচিত্র রক্ষাই বর্তমানে সর্বোত্তম উপায় হতে পারে। তবে নিশ্চিত করতে হবে, সেগুলি সংবিধানের মৌলিক অধিকারগুলির বিরোধিতা যেন না করে।
একুশতম আইন কমিশনের পরামর্শপত্রটি তিন বছরের পুরনো হয়েছে এই অজুহাত দিয়ে তড়িঘড়ি বাইশতম আইন কমিশন গঠন করেছে কেন্দ্র। এর উদ্দেশ্য কী? নরেন্দ্র মোদীর শাসনকালে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর উপর যখন হিন্দুত্ববাদীদের আক্রমণ হয়েছে, তখন তিনি নীরব থেকে এগুলো ঘটতে দিয়েছেন। তিনি ধর্ম-বর্ণ-জনজাতি নির্বিশেষে সকল মানুষের কল্যাণের জন্য অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আনবেন, তা কি বিশ্বাস করা যায়? আশঙ্কা হয়, তাঁর তৎপরতার পিছনে রয়েছে আগামী লোকসভা নির্বাচনে ভোটের হিসাব। সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির লক্ষ্যেই যে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রণয়নের এই প্রচেষ্টা, তা কি দিনের আলোর মতো পরিষ্কার নয়?
সুব্রত গৌড়ী, কলকাতা-১২
ভোটের বিষ
ওসমান মল্লিকের স্পষ্ট উচ্চারণ, “কোনও ধর্মই নারীকে সমানাধিকার দিতে রাজি নয়” প্রতিষ্ঠিত সত্য। সমাজের প্রগতিশীল, মুক্তচিন্তক, ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কারকরা নানা অছিলায় অভিন্ন দেওয়ানি বিধিকে আলোচনার পরিসরের বাইরে রেখেছেন। সংশ্লিষ্ট সমাজে অভিন্ন বিধি সহায়ক জনমত তৈরি না হলে, আরও সময় দিতে নাগরিক সমাজের ধৈর্যের অভাব ঘটতে পারে। কারণ ভোটে রাজনৈতিক দল বিষয়টিকে বিষাক্ত করবে। পরিস্থিতি জটিল হয়েছে— ১) ১৯৭২-এ ‘দত্তক আইন’ প্রণয়নে ধর্মীয় বিরোধিতায় তৎকালীন সরকারের নতিস্বীকারে; ২) ১৯৮৬-র শরিয়া আইনের মান্যতায় শাহ বানো রায় ও তার পর মুসলিম উইমেন আইন (প্রোটেকশন অব রাইটস অন ডিভোর্স) প্রণয়নে। স্বাধীনতার ৭৬ বছর পেরিয়েছে, ধর্মনিরপেক্ষ দেশের পক্ষে যা কম সময় নয়। উদার মনোভাব নিয়ে সংস্কারের কর্তব্য নিজ ধর্মের মধ্যে থেকে শুরু করলে, অন্যদের মাথা গলানোর সুযোগ খর্ব হবে।
মানস দেব, কলকাতা-৩৬
অগ্রপথিক
‘শরিয়া পুরুষেরও প্রতিকূল’ শীর্ষক প্রবন্ধে যথার্থই বলা হয়েছে, হয়তো কেন্দ্রের বর্তমান শাসক দল বিজেপি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আনতে চেয়েছে বলেই বিবিধ প্রশ্ন আসছে। আর এই আপত্তিতে চাপা পড়ে যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি— সংবিধান সভা এ ব্যাপারে ভাবী সংসদের উপর যে গুরুদায়িত্ব ন্যস্ত করেছিল, তা পালনের সদিচ্ছা কি কখনও দেখিয়েছে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিভিন্ন সরকার? সংশ্লিষ্ট সমাজের অভ্যন্তরের আলোকপ্রাপ্ত অংশ থেকেই অভিন্ন বিধির দাবি ওঠার কথা ছিল। বাস্তবে কিন্তু সংস্কারের বিপরীতমুখী প্রবণতা লক্ষ করা গেল।
তবে অনেক আগেই কেউ কেউ সংস্কারের পথে খানিকটা হেঁটেছেন। হামিদ দালোয়াই মহারাষ্ট্রের রত্নগিরি জেলার এক সাধারণ মরাঠি পরিবারের সন্তান ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে ১৮ এপ্রিল, ১৯৬৬ তিন তালাক প্রথা রদের দাবিতে সাত জন মুসলিম মহিলা বম্বে (অধুনা মুম্বাই) মন্ত্রণালয়ের উদ্দেশে ঐতিহাসিক পদযাত্রা করেন। প্রথম যৌবনে রামমনোহর লোহিয়া, জয়প্রকাশ নারায়ণ প্রমুখের প্রভাবে সোশ্যালিস্ট পার্টির শাখা সংগঠন রাষ্ট্রীয় সেবা দলের সদস্য ছিলেন তিনি। পরে সক্রিয় রাজনীতি ত্যাগ করে মুসলিম সমাজ সংস্কারে নিজেকে উৎসর্গ করেন। ষাটের দশকে দালোয়াই যখন তিন তালাক, বহুবিবাহ প্রভৃতি কুপ্রথা নিরসনে রাষ্ট্র কর্তৃক বিধিবদ্ধ আইনের দাবি করেছিলেন, তখনও পর্যন্ত রাজনৈতিক বা সামাজিক পরিসরে এ সব দাবি ওঠেনি। মহারাষ্ট্রে মুসলিমদের উর্দুর পরিবর্তে মাতৃভাষা মরাঠিতে শিক্ষা লাভের দাবিতে সরব হয়েছিলেন দালোয়াই।
সাংবাদিক ও চিন্তক দালোয়াইয়ের শ্রেষ্ঠ রচনা, মুসলিম পলিটিক্স ইন ইন্ডিয়া। সে অর্থে দালোয়াই এ দেশে মুসলিম সমাজে সংস্কারের অগ্রপথিক। ১৯৭৭ সালে দালোয়াইয়ের প্রয়াণের পর তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘সত্যশোধক মণ্ডল’-এর (১৯৭০) দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তাঁর স্ত্রী মেহরুন্নেসা। অনেকের অনুমান, দালোয়াইয়ের সমাজসংস্কারের কর্মকাণ্ডকে প্রতিহত করতেই ১৯৭৩ সালে তৈরি হয় মুসলিম পার্সোনাল ল প্রোটেকশন কমিটি, যেটি পরবর্তী কালের মুসলিম ল বোর্ড, যা আজ ভারতে মুসলিম সমাজের প্রতিনিধিত্বের দাবিদার। এরা যেমন তিন তালাক বাতিলের বিরোধিতা করেছে, তেমনই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রবর্তনের কথা উঠলেই রে রে করে উঠছে।
অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা ও যৌক্তিকতা সমাজচিন্তকদের অনুভবে ও ভাবনায় এসেছিল অনেক আগেই। প্রায় দু’শো বছরেরও আগে তার হদিস পাওয়া যায় এ দেশে সমাজসংস্কারে পথিকৃৎ রামমোহনের রচনায়। ১৮৩১-এ পার্লামেন্টারি কমিটি প্রেরিত আইন ও বিচারব্যবস্থায় সংস্কার সম্বন্ধে প্রশ্নমালার উত্তরে রামমোহন দেওয়ানি আইনকে বিধিবদ্ধ করা, এবং গোটা সমাজ যাতে একই উত্তরাধিকার আইন গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হয়, তার জন্য প্রচারের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। সাহিত্যিক হুমায়ুন কবীরের সাম্প্রতিক উপন্যাসের নায়ক, আধুনিকমনস্ক মুসলমান যুবক ইউসুফ বলে, “...আমরা, ইসলাম ধর্মের মানুষরা কোনও সমালোচনা শুনতে চাই না। ...প্রাচীন হিন্দু ধর্মের বিস্তার তেমন ভাবে না হলেও সংস্কার হয়েছে যুগে যুগে। ...আধুনিকতার সঙ্গে সঙ্গে শংকরাচার্য, রামানুজ, রাজা রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ এঁরা লড়াই করে কুসংস্কারগুলোর অপ্রয়োজনীয়তা মানুষকে বোঝাতে পেরেছেন, অথচ মহম্মদের পর ইসলাম ধর্মের সংস্কারক কেউই আসেননি। তাই সবচেয়ে আধুনিক ধর্ম হয়েও, আধুনিকতার রক্তাল্পতায় ধুঁকছে এই ধর্মের মানুষজন।” তেমনই আশার বাণী শোনায় আলোচ্য প্রবন্ধটি। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, এই আমার ভারতবর্ষ যেখানে হামিদ দালোয়াইরা ভারতীয় মুসলিম সমাজের যে আত্মোপলব্ধির কথা বলেছিলেন, তা বিলম্বে হলেও আরম্ভ হয়েছে।
শান্তনু রায়, কলকাতা-৪৭
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy