—প্রতীকী ছবি।
‘সত্য যে সনাতন’ (২১-১) শীর্ষক সম্পাদকীয়টি নীতিপুলিশদের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ উপস্থাপনা। কর্নাটকের হোটেলে এক পুরুষ ও মহিলার উপর যে দীর্ঘ হেনস্থার ঘটনা ঘটেছে, তা নিন্দার ভাষা নেই। পোশাক দেখেই ভিন্ন ধর্মের মানুষ চিহ্নিত করা হচ্ছে। এক সঙ্গে সময় কাটানো ‘অপরাধ’, এই দাবি করে গালাগালি-মারধর করা হচ্ছে। তা হলে প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের নিজের জীবন, কর্ম ও পছন্দ বেছে নেওয়ার অধিকার, যাকে আমাদের সংবিধান সম্মান করে, তার মর্যাদা রক্ষা হচ্ছে কি? নীতিজ্ঞানহীন এই যুবকেরা এক ভিন্ন নীতি ও নৈতিকতার বোধে তাড়িত ও চালিত। তাই প্রাপ্তবয়স্ক নারীপুরুষ সহমত পোষণ করে নিভৃতে সময় কাটাতে চাইলে তারা শাসনদণ্ড হাতে তুলে নেয়। সম্পাদকীয়তে তাই সঠিক ভাবেই উল্লিখিত হয়েছে, কোনটি ভারতীয় সংস্কৃতি নয়, কোনটি ‘সনাতন’ ভারতের নৈতিকতা নয়, তা নিয়ে এই যুবকেরা কেবলই বিচার করছে। কোনটি ভারতীয়, তা কি তারা নিজেরাও জানে? আসলে এরা দিগ্ভ্রান্ত। রামমোহন বিদ্যাসাগর রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দের মতো মনীষীরা যে আধুনিকতায় দেশকে দীক্ষিত করে গিয়েছেন, তাকে উপেক্ষা করে বিংশ শতাব্দীর প্রায় মাঝখানে এসেও তথাকথিত সনাতনপন্থী ভারতীয়রা ভিন্ন মতের মানুষকে ‘বিধর্মী ও বেজাত’ আখ্যা দিয়ে বিশুদ্ধতা রক্ষায় সচেষ্ট!
স্বাধীন ভারতের রূপকাররা এই সনাতন পরম্পরা সূত্রেই চেয়েছিলেন আধুনিক ভারত হবে জাতি-বর্ণ-ধর্মের ঊর্ধ্বে, এক মিলনক্ষেত্র। বহুত্বের মধ্যে একত্বই হল ভারতীয়ত্ব, বিবিধের মাঝে মিলনই হল তার সনাতন সুর। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ভারততীর্থ’ কবিতায় নানা দেশ জাতি সংস্কৃতি ও ধর্মের মানুষের এই ভূমিতে এসে একত্রবাসের কথা বলেছেন। কবি অতুলপ্রসাদ সেন লেখেন, “নানা ভাষা নানা মত, নানা পরিধান, বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান।” সম্পাদকীয়ের শেষাংশে তাই খেদের সঙ্গে বলা হয়েছে, সনাতন ভারতের একটি সঙ্কীর্ণ ধারণাকেই প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। মানুষের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের মর্যাদা দেওয়াটা যে সহবত, এই বোধটি গত দশ বছরে ক্রমক্ষয়িষ্ণু। তাই বিভিন্ন রাজ্যে স্বঘোষিত নীতি-পুলিশদের নিয়মিত তর্জনগর্জন শোনা যাচ্ছে। কেন্দ্রের শাসক দলের নৈতিক ও রাজনৈতিক ছত্রছায়াতেই এদের এই বাড়বাড়ন্ত।
প্রবীর কুমার সরখেল, পশ্চিম মেদিনীপুর
বামেদের বিভ্রান্তি
অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘কোন লড়াই, কী ভাবেই বা’ (২৩-১) প্রবন্ধটির পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। সামাজিক ও শ্রেণিবৈষম্যের নিয়মটাকে বদলে দেওয়ার অঙ্গীকার নিয়ে আজ থেকে ১৭৬ বছর আগে ২১ ফেব্রুয়ারি দুই তরুণ, কার্ল মার্ক্স এবং ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস যে দলিল পেশ করেছিলেন, বামপন্থীরা এখনও তার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে গর্ব বোধ করেন। মার্ক্স-এঙ্গেলস বলেছিলেন, যার আছে সে ভোগ করুক, কিন্তু যার নেই তার কেন নেই? তাই সমাজই দায়িত্ব নিক তাকে খেতে দেওয়ার।
প্রশ্ন হল, এ রাজ্যের বামপন্থীরা কমিউনিস্ট ইস্তাহারকে কী ভাবে রূপায়ণ করছেন? গত শতকের নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু করে কারখানার মালিকদের উপর অত্যাচার আর শ্রমিকদের মালিকের অংশীদার করার মগজধোলাই করে ইস্তাহারের তিন নম্বর লক্ষ্যকে (প্রলেতারিয়েত কর্তৃক রাজনৈতিক ক্ষমতা অধিকার করা) বাস্তবায়িত করার প্রবল প্রচেষ্টা, আর ২০০৬ সালে সিঙ্গুর কারখানা করার জবরদস্তিতেই কি এ রাজ্যের বামপন্থীদের ভুলের কর্মসূচির শেষ? না কি ২০১১ সালে পালাবদলের পরে ‘আগে রাম পরে বাম’ কর্মসূচি আরও বড় ভুল? প্রবন্ধকার সঠিক ভাবেই লিখেছেন, ব্রিগেডে সমাবেশের আগে ডিওয়াইএফআই-এর ‘ইনসাফ যাত্রা’-র চলার পথেও ভুল অ্যাজেন্ডা ছেড়ে মূল অ্যাজেন্ডায় উত্তরণের ডাক শুনেছেন পশ্চিমবঙ্গের মানুষ।
বিশ শতক থেকেই বামপন্থীদের বৈশিষ্ট্য, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী হতে হবে। বর্গাপ্রথার উচ্ছেদ করে ভূমিসংস্কার করতে হবে। রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে কোনও প্রতিক্রিয়াশীল আইন, বিধি তাঁরা সমর্থন করবেন না। তাঁরা উগ্র-জাতীয়তাবাদের বিরোধী অবস্থানে সুদৃঢ় থাকবেন। ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত ডিওয়াইএফআই নব্বই দশকের পর থেকে রাজ্য বামফ্রন্টের ভূমিকা বিশ্লেষণের দায়িত্ব কতটা পালন করেছে? অত্যাধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে যে কারখানায় শিল্প উৎপাদন হয়, সেখানে শ্রমিকরা সরাসরি সেই সংস্থার শ্রমিক নন। ঠিকাদাররা কারখানায় গাড়ি তৈরির জন্য শ্রমিক জোগান দেয়। শিল্পের ক্ষেত্রে এই ধরনের প্রবণতা নিয়ে বামপন্থীরা সে রকম ভাবে ভেবে উঠতে পারেননি৷ এই পরিস্থিতিতে শ্রমিক সংগঠন কী উপায়ে হবে? কী রকম হবে? সংগঠিত এবং অসংগঠিত শিল্পের শ্রমিকদের মধ্যে একটা স্বার্থের বিরোধিতা তৈরি হচ্ছে। রাজনৈতিক ভাবে কী করে এটার মোকাবিলা করা হবে, তা নিয়ে ভাবা হয়েছে কি?
সিবিআই ও এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট প্রায় দু’বছর ধরে কয়লা ও গরু পাচার, এবং স্কুলশিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির যে তদন্ত করছে, সিপিআইএম সেই মামলাগুলিকে নিজের রাজনৈতিক সঙ্কট থেকে মুক্তি পাওয়ার অস্ত্র বানিয়ে ফেলেছে। তাতে দলটির রাজনৈতিক সঙ্কট মোচন তো হয়ইনি, বরং বেড়েছে। সিপিএম-এর বর্তমান রাজনৈতিক লাইন অনুসারে বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেসকে একই পঙ্ক্তিতে বসিয়ে দুই পক্ষেরই বিরোধিতা করা হচ্ছে। তার মধ্যে বিজেপি-বিরোধিতা কম আর তৃণমূল কংগ্রেসের বিরোধিতা বেশি থাকে। এই কর্মসূচি ভুল কি না, ডিওয়াইএফআই বিচার করে দেখুক।
সিপিএম এ রাজ্যের নব্য শ্রেণির শ্রমিক ও কৃষকদের সম্ভাব্য আন্দোলনগুলোতে নজর দেয়নি। তৃণমূল কংগ্রেস শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণির মধ্যে নিজের প্রভাব ধরে রাখতে সফল হয়েছে। ফলে ভিন রাজ্যে চলে যাওয়া প্রান্তিক শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে কমিউনিস্ট দলগুলির যোগাযোগ থাকছে না। তাঁদের উপর দক্ষিণপন্থী তৃণমূল কংগ্রেস, আর অতি দক্ষিণপন্থী বিজেপির প্রভাব বেড়েছে।
তবুও স্বীকার করি, আজ হীরেন মুখোপাধ্যায়, ভূপেশ গুপ্ত, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, গুরুদাস দাশগুপ্ত বা বাসুদেব আচারিয়ার মতো বক্তা না থাকায়, বামপন্থীদের সংখ্যা শূন্য হয়ে যাওয়ায় আইনসভার ভিতরে শ্রমিক ও কৃষকের দাবি নিয়ে লড়াই করার কেউ নেই। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন শ্রমজীবী মানুষ। বিজেপি সরকার একের পর এক শ্রমিক-বিরোধী ও কর্পোরেট-বান্ধব নীতি আরোপ করতে পারছে। তৃণমূল কংগ্রেস যখন রাজ্যের বকেয়া টাকার দাবিতে, শ্রমজীবী মানুষের ১০০ দিনের কাজের টাকার দাবিতে রাজ্য জুড়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে, দিল্লিতে ধর্না দিচ্ছে, তখন গরিব মানুষের দাবিকে খর্ব করে সিপিএম তৃণমূলকে আক্রমণ করছে। ফলে তৃণমূল অভিযোগ করতে পারছে, সিপিএম বিজেপির সঙ্গে আঁতাঁত করছে।
এই মুহূর্তে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন করা বামেদের সবচেয়ে জরুরি। কারখানাগুলোয় পূর্ণ সময়ের শ্রমিক নিয়োগের দাবি তোলা দরকার। এতে শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। দিল্লিতে যখন মোদী সরকার সিপিএম-ঘনিষ্ঠ ‘নিউজ়ক্লিক’ পোর্টালের অফিসে হামলা করল, সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থকে ইউএপিএ আইনের অধীনে গ্রেফতার করা হল, সিপিএম-এর সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির দিল্লির সরকারি বাসভবনে পুলিশ হানা দিল, তখনও পশ্চিমবঙ্গ সিপিএম রাস্তায় নামল না। কেন এই বিভ্রান্তি?
সোমনাথ মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-৫৭
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy