— ফাইল চিত্র।
‘গোত্রান্তর’ (১১-৩) সম্পাদকীয়ের বিষয়, রাজনীতির চিরাচরিত কারবারে এক অস্বাভাবিক অনুপ্রবেশ। ফলাফল ভাল না মন্দ, ভবিষ্যৎ বলবে। তবে রাজনৈতিক মহল হতচকিত, কারণ এক ব্যক্তি খেলা বদলে দিয়েছেন তাঁর ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্তে। এই জাতীয় যোগদান দলীয় হিসেবের বাইরে। সাধারণ মানুষ দলকে সমর্থন করে, চ্যালেঞ্জ করে না। অসাধারণ জ্ঞানী, গুণী, কৃতবিদ্য সুধীজনেরা সমর্থক হলে দলের শক্তিবর্ধক; কিন্তু বিরোধী হলে চিন্তা বাড়ে। যদিও সুধীজনের বিরোধিতা সচরাচর নিরাপদ দূরত্ব থেকে সংবাদপত্রের পাতায় প্রবন্ধ রচনা, বা সন্ধ্যায় টিভির বিতর্কে সীমাবদ্ধ থাকে। কোনও বিষয়ে বেশি বিচলিত হলে সমবেত ভাবে গণপ্রতিবাদ পত্রে সই করা, বা মহামিছিলে অংশ নেওয়া যায়। রাজনৈতিক নেতারা এর সঙ্গে পরিচিত।
অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় হিসাবের বাইরে। এখন তাঁর পূর্বাপর কার্যকলাপে অসঙ্গতি খোঁজা হবে। থাকবে বিদ্রুপ। কিন্তু থাকছে দিশাও। রাজনীতিতে পরিবর্তন চাইলে অংশগ্রহণ জরুরি। দিদি, দাদার স্নেহধন্য হয়ে নয়, চটজলদি ফলের প্রত্যাশায় নয়। প্রয়োজনে সমমনস্ক মানুষের সংহতিতে নতুন রাজনৈতিক দলও করতে হতে পারে। শিল্প বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ, বৈজ্ঞানিক, অন্যান্য কুশলী মানুষের সহযোগে। সেই ঝুঁকিসঙ্কুল পথের পথিক হওয়ার সাহস ও যোগ্যতা তাঁর ছিল। দেশ ও সমাজের এই কালবেলায় তাঁর অংশগ্রহণ এক বেনজির দৃষ্টান্ত, যা হতে পারে এক দেশপ্রেমিকের স্বাভাবিক বিবেচনার বোধ।
মানস দেব, কলকাতা-৩৬
প্রথাভঙ্গ
প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সময়ের পূর্বে অবসরগ্রহণ, এবং একটি রাজনৈতিক দলে যোগদান বিষয়ে ‘গোত্রান্তর’ সম্পাদকীয়টি সময়োপযোগী। দীর্ঘ দিন বিচারবিভাগে এবং উচ্চ আদালতে খুব সাধারণ করণিকের চাকরি করার সুবাদে কয়েকটা ব্যাপার লক্ষ করেছি। বেশির ভাগ বিচারকই হায়ার জুডিশিয়াল সার্ভিস বাদ দিলে সাধারণত অভিজ্ঞ আইনজীবীদের মধ্যে থেকে নিযুক্ত হন। অনেকেরই কোনও না কোনও রাজনৈতিক দল বা মতাদর্শের প্রতি নৈতিক সমর্থন থাকতেই পারে। কিন্তু বিচারক পদে আসীন হওয়ার পর থেকে তাঁরা নিজেদের দলীয় রাজনীতি, বা পূর্বের রাজনৈতিক জীবনের সহকর্মী, বা পরিচিত সিনিয়র আইনজীবী, এমনকি সামাজিক মেলামেশা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতেন। সংবাদমাধ্যমের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখতেন না। বিচারপতিদের ইংরেজ শাসনকাল থেকে ‘ধর্মাবতার’ সম্বোধন করা হয়ে থাকে। এর মূলে রয়েছে এই বিশ্বাস যে, বিধাতার মতোই বিচারকেরা নিরপেক্ষ বিচার করেন। তা হলে কাল পর্যন্ত যিনি আদালতে বিচার করেছেন, তিনি পদত্যাগ করেই একটা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কী করে যুক্ত হলেন?
আবার এটাও দেখা গিয়েছে যে, তিনি বিচারপতি থাকাকালীন প্রথা ভেঙেছেন। আইনগত বাধা না থাকলেও, সংবাদমাধ্যমে কথা বলেছেন, বা মামলার বাদী-বিবাদীদের সমালোচনা করেছেন। তাঁকে সাধারণ মানুষ বিচারপতি হিসাবে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছিল, কারণ আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়েছিল যে, তাঁর বিচারে সমাজের বহু শিক্ষক পদপ্রার্থী এবং শিক্ষাকর্মী বঞ্চনা থেকে মুক্তি পেয়েছেন। কিন্তু কর্মজীবন শেষ হওয়ার আগেই বিচারক পদে ইস্তফা দেওয়াতে ওই সব বঞ্চিত, যোগ্য কর্মপ্রার্থী, যাঁরা মামলার বিচারের আশায় এখনও রাস্তায় বসে রয়েছেন, তাঁরা কি আশাহত হননি? বিচারক, বিচারপতিরা যদি মেয়াদের আগেই পদ ছেড়ে রাজনীতিতে যোগ দেন, এবং ভোটযুদ্ধে শামিল হন, তা হলে সামাজিক মূল্যবোধ কোথায় দাঁড়াবে?
সুকুমার সরকার, শেওড়াফুলি, হুগলি
ভাবমূর্তি
যিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সুদৃঢ় প্রাচীর তুলে দিয়েছিলেন, যাঁর লক্ষ্য ছিল সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আপসহীন ভাবে দুর্নীতির মোকাবিলা করা, সেই বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় একটি রাজনৈতিক দলে যোগ দিলেন। তাঁর যে-ভাবমূর্তি জনমানসে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল, সেটা কি অক্ষত রইল? বিশেষ করে এমন এক দলে তিনি যোগ দিলেন, যারা সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন, ধর্মের সুড়সুড়ি দিয়ে ভোটব্যাঙ্ক ভরায়। যে দলে কোনও প্রকৃত শিক্ষাবিদকে খুঁজে পেতে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের প্রয়োজন, সেই দলে এক প্রাক্তন বিচারপতি যোগ দিলে মনে হয়, তাঁর নিরপেক্ষতা কি তা হলে কেবল মুখোশ ছিল?
জয় সেনগুপ্ত, হাওড়া
বিনিময় প্রথা
নির্বাচনী-বন্ডের যাবতীয় তথ্য ৬ মার্চের মধ্যে নির্বাচন কমিশনের হাতে তুলে দেওয়ার ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়াকে যে নির্দেশ দিয়েছিল তার সময়সীমা ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানোর জন্য ব্যাঙ্ক সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের মতে, এই নির্বাচনী-বন্ড হল ‘অসাংবিধানিক’। রায়ে বলা হয়েছিল, এই বন্ড হল কোনও কিছুর বিনিময়ে কাউকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা, আদালতের ভাষায় ‘কুইড প্রো কুয়ো’। এ এক সাংঘাতিক অভিযোগ, কারণ এর ফলে নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রহসনে পরিণত হয়েছে।
এই তথ্য পাওয়া খুব কঠিন ব্যাপার বলে মনে হয় না। তথ্য প্রকাশের মধ্য দিয়ে যারা নির্বাচনী রাস্তায় চলতে গিয়ে হোঁচট খেতে পারে বা মুখ থুবড়ে পড়তে পারে, তারাই ব্যাঙ্কের উপর চাপ সৃষ্টি করছেন বলে অনেকে যে অভিযোগ তুলছেন তাকে নস্যাৎ করা যায় না। বিরোধীরা একে ‘ন্যায়বিচারের সঙ্গে প্রতারণা’র চেষ্টা বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁদের সরাসরি অভিযোগ, মোদী সরকারের নির্দেশেই রাষ্ট্রায়ত্ত স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া নির্বাচনী-বন্ড সংক্রান্ত সমূহ তথ্য ধামাচাপা দিতে চাইছে। তাঁদের মতে, সুপ্রিম কোর্ট ব্যাঙ্কের আর্জি মেনে নিলে কোর্ট নিজেদের সাংবিধানিক বেঞ্চের রায়ে নিজেরাই ছুরি চালাবে।
সংবাদ সূত্র অনুযায়ী, স্টেট ব্যাঙ্ক থেকে ৩০ দফায় মোট ১৬ হাজার ৫১৮ কোটি টাকার নির্বাচনী-বন্ড বিক্রি হয়েছিল। এর মধ্যে ২০১৭-১৮ থেকে ২০২২-২৩ পর্যন্ত ৬ বছরে রাজনৈতিক দলগুলি নির্বাচনী-বন্ডের মাধ্যমে ১২ হাজার কোটি টাকারও বেশি চাঁদা পেয়েছিল। এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি, ৬,৫৬৪ কোটি টাকা চাঁদা পেয়েছিল বিজেপি একাই। কংগ্রেস পেয়েছে ১,১৩৫ কোটি টাকা, তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে ১,০৯৩ কোটি টাকা। অন্যান্য যারা বেশি টাকা পেয়েছে তাদের মধ্যে আছে বিজেডি, ডিএমকে, বিআরএস, ওয়াইএসআর কংগ্রেস, আপ, টিডিপি, শিবসেনা প্রভৃতি।
বুঝতে অসুবিধা হয় না কেন বৃহৎ পুঁজির মালিকরা এই রাজনৈতিক দলগুলির পিছনে এই বিপুল পরিমাণ টাকা ঢেলেছে। আদালত স্পষ্ট ভাষায় বলেছে, কর্পোরেট কোম্পানি টাকা দেয় তাদের ব্যবসায়িক সুবিধার লক্ষ্যে। ভোটে এই টাকা দেদার ওড়ে, একটা উৎসবের পরিবেশ গড়ে ওঠে। মুখ্য নির্বাচন কমিশনারও ভোটকে ‘উৎসব’ হিসেবে দেখার পরামর্শ দিচ্ছেন ভোটারদের। ভোটাররা যাতে না ভাবে যে এই টাকার স্রোতে ভাসার মধ্যে কোনও অপরাধ আছে। আদর্শের সঙ্গে বিরোধ থাকা সত্ত্বেও টাকার বিনিময়ে কোনও দলের মজুরে পরিণত হওয়ার মধ্যে, বা ভোট দেওয়ার মধ্যে কোনও অপরাধ আছে, সে কথা যেন ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, এ রায়ের ফলে কি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, এবং ধনকুবের গোষ্ঠীগুলির মধ্যে বন্ধন ছিন্ন হবে? আজ আমাদের সামাজিক বা রাজনৈতিক সংস্কৃতি যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, তাতে কড়ি ফেলে তেল মাখতে মোটা পুঁজির মালিকরা পিছপা হবে না। ভোটসর্বস্ব রাজনৈতিক দলগুলি টাকা নিতে ইতস্তত করবে না। তাতে বিপাকে পড়বেন সাধারণ ভোটাররা।
গৌরীশঙ্কর দাস, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy