শিশির রায়ের ‘নিজেই হয়ে উঠেছে ইতিহাস’ (রবিবাসরীয়, ২৬-৬) শীর্ষক প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু সংযোজনের অভিপ্রায়ে এই চিঠি। দুটো সৌভাগ্যজনক ঘটনার সমাপতন না ঘটলে আনে ফ্রাঙ্ক বা তার ডায়েরি ইতিহাস না হয়ে কালের গর্ভে হারিয়ে যেত। ১৯৩৩ সালে হিটলারের একের পর এক ইহুদি পীড়নের ফরমান জারি হলে জার্মানিতে বসবাসকারী প্রতিষ্ঠিত ব্যাঙ্কার ওটো ফ্রাঙ্ক জার্মানি থেকে পালিয়ে অ্যামস্টারড্যাম শহরে থিতু হয়ে মশলার ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু ১৯৪০ সালের মে মাসে হিটলারের নাৎসি বাহিনী নেদারল্যান্ডস আক্রমণ ও দখল করেই ইহুদিদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠাতে থাকে। ওটো ফ্রাঙ্কের অফিস ঘরের দোতলার গোপন কক্ষে ১৯৪২ সালের জুলাই মাস থেকে শুরু হয় তাঁদের স্বেচ্ছাবন্দি জীবন। দুই কন্যাসমেত ওটো ফ্রাঙ্কের পরিবারের সঙ্গে আর একটি পরিবারের তিন জন, আর এক ইহুদি দন্ত চিকিৎসক। দুটো অন্ধকার ঘরে প্রায় গাদাগাদি করে একটা রেডিয়োকে সঙ্গী করে তাঁদের দিন কাটতে থাকে।
বহির্জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হতভাগ্য আট জন ইহুদি বেঁচে ছিলেন ওটো ফ্রাঙ্কের দু’জন টাইপিস্ট আর অন্য দু’জন পুরুষ কর্মচারীর সাহায্যে। জীবনের বিরাট ঝুঁকি নিয়ে এঁরা ষোলো মাস ধরে এঁদের খাবার, বই আর ম্যাগাজ়িনের জোগান অব্যাহত রেখেছিলেন। ১৩তম জন্মদিনে বাবা-মা’র কাছ থেকে পাওয়া ডায়েরিতে আনে লিখত তার রোজনামচা, সদ্যকিশোরীর উচ্ছ্বাস, আশা আর হতাশার কথা। ডায়েরির পাতা শেষ হলে দিদি মার্গটের কেমিস্ট্রির খাতা আর সাধারণ কাগজে পাতার পর পাতায় লিখে চলে তার যন্ত্রণাবিদ্ধ অনুভূতির কথা। বাবার একটা ব্রিফকেসে আনে এই সব লেখা জমা রাখত। ১৯৪৪ সালের ৪ অগস্ট এক জার্মান ও চার ওলন্দাজ নাৎসি পুলিশ আচমকা আনেদের গোপন ডেরায় হানা দিয়ে ৮ জন ইহুদিকে গ্রেফতার করে। কী ভাবে তারা এই ডেরার সন্ধান পেল, তা আজও রহস্যাবৃত। সোনা-দানা, গয়না কেড়ে নেওয়ার পর এক পুলিশের চোখ পড়ে সেই ব্রিফকেসটার উপর। সেটা খুলে আনের ডায়েরি আর খাতাগুলো মেঝেতে ফেলে তারা টাকার সন্ধান করতে থাকে। না পেয়ে হতাশ হয়ে ব্রিফকেসটা মেঝেয় ছুড়ে আট বন্দিকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। লেখাগুলো পড়ার মানসিকতা তাদের ছিল না।
এই ঘটনার এক সপ্তাহ পর ওটোর এক টাইপিস্ট মিস মিয়েপ সাহসে ভর করে সেই গুপ্ত বাসায় এসে দেখেন ব্রিফকেস আর মেঝেময় ছড়িয়ে থাকা আনের ডায়েরি আর খাতা। মিস মিয়েপ আনের হাতের লেখা চিনতেন। যত্ন করে তিনি ডায়েরি ও অন্যান্য কাগজ নিজের কাছে রেখে দেন। আমাদের সৌভাগ্য, নাৎসি পুলিশ বা মিস মিয়েপ কেউ ডায়েরিটা পড়েননি। এক জন কেউ পড়লেই এটা নষ্ট হয়ে যেত। পুলিশ কেন নষ্ট করত, তার ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। তবে মিস মিয়েপও নষ্ট করতে বাধ্য হতেন, কেননা ডায়েরির ছত্রে ছত্রে কৃতজ্ঞ আনে লিখেছিল কী ভাবে মিস মিয়েপ ও তাঁর সহকর্মীরা নিজেদের জীবন বিপন্ন করে আনেদের বেঁচে থাকার রসদ জুগিয়েছিলেন। ডায়েরি নষ্ট হলে যুদ্ধের অনেক অজানা কাহিনির মতো চিরতরে হারিয়ে যেত আনে ও তার ডায়েরির ইতিহাস। (তথ্য সূত্র: দ্য গার্ল হু ওয়জ় আনে ফ্রাঙ্ক, লুই দে জং; সিক্রেটস অ্যান্ড স্টোরিজ় অব দ্য ওয়ার, প্রথম খণ্ড, রিডার’স ডাইজেস্ট কালেকশন)।
বুদ্ধদেব চট্টোপাধ্যায়, কুলটি, পশ্চিম বর্ধমান
শান্তির খোঁজে
‘নিজেই হয়ে উঠেছে ইতিহাস’ প্রবন্ধটি যথার্থ মূল্যায়ন করেছে আনে ফ্রাঙ্কের। তার ডায়েরি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক মূল্যবান দলিল। ইতিহাস শুধু বইয়ের পাতায় নয়, থাকে দৈনন্দিন জীবনেও। সাধারণ মানুষ তাঁদের লেখায় ধরে রাখেন রোজকার জীবন। বহু বছর পরেও আমরা জানতে পারি যুদ্ধ তাঁদের জীবনে কী প্রভাব ফেলেছিল। আনে সাংবাদিক হতে চেয়েছিল। প্রচুর বই পড়ত সে। গুপ্তকক্ষে থাকার সময়ও সে বই পড়া থামায়নি। ইতিহাস তার প্রিয় বিষয় ছিল। এ ক্ষেত্রে বাবা ছিলেন আনের অনুপ্রেরণা। বাবা চাইতেন আনে জার্মান লেখকদের বই পড়ুক। তিনি আনে-কে গ্যোয়টে এবং শিলারের রচনা থেকে পড়ে শোনানোর কথা বলেছিলেন। আনের যোগাযোগ ছিল বাইরের বিশ্বের সঙ্গে রেডিয়ো মারফত। তার ডায়েরির পাতায় আমরা পাই চার্চিলের নিউমোনিয়ার খবর, গান্ধীজি অনশন করছেন, এ খবরও সে রাখে। তাঁর অনশন ভাঙল, এও সে লিখে রেখেছিল।
গুপ্তকক্ষে আনেরা অনেক কষ্ট করে থাকত। এমনকি, বাথরুম ব্যবহার করার জন্যও তাদের অনেক ভাবতে হত। আট জন লুকিয়ে থাকা মানুষ বিভিন্ন জায়গা ব্যবহার করতেন স্নান করার জন্য। আনে আর তার বোন পরস্পরকে পাহারা দিত স্নান করার সময়, যাতে কেউ না চলে আসে। কী অনিশ্চিত বেঁচে থাকা। তবুও আশ্চর্য প্রাণশক্তি আনের। হিটলার বাহিনীর অতর্কিত হানার আতঙ্কের মধ্যেও সে লিখে গিয়েছে। ১৯৪৩ সাল, ১৯ জুলাই, সোমবার— আনের লেখায় জানতে পারি বোমাবিধ্বস্ত উত্তর অ্যামস্টারড্যামের কথা। চারিদিকে মৃতের সারি, হাসপাতাল ভরে গিয়েছে মানুষের আর্তনাদে। অনাথ বাচ্চারা মৃত মানুষের স্তূপে খুঁজে চলেছে তাদের বাবা-মায়েদের। এ দৃশ্য কি আমাদের মনে করায় না যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনের কথা? আমরা কি শান্তির পথে আদৌ এগিয়েছি?
আনে মনে করত, একমাত্র মানুষের শুভবুদ্ধিই পারে পৃথিবী থেকে যুদ্ধ নির্মূল করতে। একমাত্র মানুষই পারে চরম প্রতিকূল পরিবেশে জীবনের জয়গান গাইতে। হিটলার রয়ে গিয়েছেন মানুষের ঘৃণায়, কিন্তু আনে বেঁচে আছে মানুষের ভালবাসায়। ১৫ জুলাই, ১৯৪৪, শনিবার। সে লেখে— সাধারণ লোকের দুর্দশা সে অনুভব করছে, কষ্ট পাচ্ছে। তবুও আকাশের দিকে তাকালে তার মনে হয় খুব শীঘ্রই এই নিষ্ঠুরতার শেষ হবে, শান্তি আসবে তাড়াতাড়ি। আনের ডায়েরি লেখার প্রায় ৮০ বছর হল। আজকের পৃথিবীতে এ ডায়েরি শেখায় কেমন ভাবে বেঁচে থাকতে হয়।
সিক্তা দাস বন্দ্যোপাধ্যায়, দুর্গাপুর, পশ্চিম বর্ধমান
লেখায় সুখ
শিশির রায়ের প্রবন্ধটি সুলিখিত এবং বর্তমান প্রজন্মের ভোগবাদী, অতিমারি-ক্লান্ত তথা অসহিষ্ণু কিশোর-কিশোরীদের অবশ্য জ্ঞাতব্য। মনে পড়ে যাচ্ছে অর্ধশতাব্দী আগে পড়া আনে ফ্রাঙ্কের সেই অবিস্মরণীয় কামনার কথা— “আই ওয়ান্ট টু গো অন লিভিং ইভন আফটার মাই ডেথ।” কিশোরীর কী পরিণত উচ্চারণ! আনের বিশুদ্ধ শিল্পীসত্তার আর একটি নমুনা— “আমি লেখার জন্য সব কিছুই ত্যাগ করতে পারি। লিখলে আমার সকল দুঃখ অন্তর্হিত হয়, আমার সাহস যেন পুনর্জন্ম লাভ করে।”
রিনা লাহা চক্রবর্তী, শিলিগুড়ি
শাস্তি হবে কি
মল্লিকবাজারে ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে কিছু দিন আগে এক মানসিক রোগীর আটতলা থেকে পড়ার এক রুদ্ধশ্বাস নাটক দেখলেন দেশবাসী। মানসিক রোগী, যাঁর নিরাপত্তার ঘেরাটোপে থাকার কথা ছিল, কী করে তিনি জানলা দিয়ে কার্নিশে টানা দু’ঘণ্টা কাটিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন একেবারে ফিল্মি কায়দায়? একটা ছত্রিশ বছরের তাজা যুবকের প্রাণ চলে গেল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দায় এড়িয়ে গেলেন। বিভাগীয় মন্ত্রিমশাই সংবাদমাধ্যমে যা প্রতিক্রিয়া দিলেন, তাতে বাংলার মাথা হেঁট হয়ে গেল।
ছবিতে দেখলাম উপস্থিত জনগণ ছবি তুলতে ব্যস্ত। পশ্চিমবঙ্গ কি তার অতীত ঐতিহ্য, মানবিকতা, মনুষ্যত্ব সব বিসর্জন দিয়েছে? জানা গিয়েছে, হাসপাতালের বিরুদ্ধে পরিবার থানায় গিয়েছে। স্বাস্থ্য দফতর রিপোর্ট তলব করেছে। এই সব রিপোর্ট কি দিনের আলো দেখবে? ওই বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কি দিতে পারবে রাজ্য সরকার?
বীরেন্দ্র নাথ মাইতি, বুলবুলচটি, পশ্চিম মেদিনীপুর
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy