অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘তেষ্টা পেলে জল খাবে, ব্যস’ (২৭-৩) শীর্ষক নিবন্ধে উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মহেশ’ গল্পের পটভূমির বেশ মিল পাওয়া যায়। সময় বদলে গেলেও পরিস্থিতি বদলায়নি। তৃষ্ণার্তকে জলদান পুণ্যের কি না জানি না, তবে এটা মানবিক কর্তব্য। কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা মানুষের মনে এতখানি বিষ ও বিদ্বেষের সঞ্চার ঘটাতে সক্ষম হয়েছে যে, আজ মানবিকতা বদলে হয়েছে নিষ্ঠুরতা। তবে অপর পক্ষের ছবিটা সম্পূর্ণ ভিন্ন, যা দেখে আমরা অভ্যস্ত। আমার শহর মেদিনীপুরে অসংখ্য পিরের দরগা রয়েছে এবং সেখানে সব সম্প্রদায়ের মানুষ স্বাগত। ফলে অনেক সময় দেখা যায় দরগায় হিন্দু মহিলাদেরই ভিড় বেশি। শুধু তা-ই নয়, মেদিনীপুর স্টেশনের কাছাকাছি বালাশহিদ বাবার যে দরগা রয়েছে, তার দরজার পাশে একটি কুয়ো রয়েছে। শহরবাসীর বিশ্বাস, এই কুয়োর জল পান করলে পেটের সব রকম সমস্যা থেকে মুক্তি মেলে। হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ কুয়োর জল নিয়ে গিয়ে ভক্তিভরে পান করেন।
কলকাতার এক হিন্দু ভদ্রলোক (ব্যাঙ্ক ম্যানেজার) আমাদের বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। উনি প্রতি সপ্তাহে বাড়ি যাওয়ার সময় ওই কুয়োর জল নিয়ে যেতেন। এক সময় মেদিনীপুর শহরে গ্রীষ্মকালে পানীয় জলের খুব অভাব দেখা দিত। তখন বহু মানুষ এই কুয়োর জল পান করার জন্য নিয়ে যেতেন। অজমের শরিফে খোজাবাবার দরগা-সহ সমস্ত পিরের দরগা সব মানুষের জন্য অবারিত। এটাই আমার ভারত। দুর্ভাগ্যের বিষয়, নোংরা রাজনীতি মিলনের মাঝে বিভেদ রচনা করে চলেছে। প্রত্যাখ্যানের জন্য মানসিক শক্তির প্রয়োজন। আর তারও আগে প্রয়োজন ওই মেয়েগুলির পাশে দাঁড়িয়ে সম্মিলিত প্রতিবাদের।
রোশেনারা খান
বড়-আস্তানা, মেদিনীপুর
সিঁদুরে মেঘ
‘তেষ্টা পেলে জল খাবে, ব্যস’ নিবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বলতে চাই, ছোটবেলায় দেখেছি, তেষ্টার সময় কেউ কারও দুয়ারে এসে দাঁড়ালে জলের সঙ্গে গুড়, বাতাসা দেওয়া হত। আর এ ক্ষেত্রে জলের সঙ্গে গুড়, বাতাসার পরিবর্তে উত্তম-মধ্যম মার? কোথায়? না, মন্দিরে। যে মন্দিরে মুসলমানদের প্রবেশ নিষেধ। তেষ্টার সময়ে মন্দিরের যে পুরোহিত বা কর্মীরা মারধর করেন, তাঁরা মানুষ হিসেবে গণ্য হতে পারেন কি?
ভয় হয়, বিজেপি যদি এ রাজ্যের দখল নেয়, তা হলে এখানেও উত্তরপ্রদেশ, গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ, অসম, ত্রিপুরার মতো ফরমান জারি হবে— হিন্দুর ঘরে মুসলমানদের প্রবেশ নিষেধ। জল খাওয়াও চলবে না। আমার বাড়ির কাছাকাছি বাজার বলতে দমদম মল রোড বাজার। সকালবেলা রাস্তার দু’পাশে আনাজ-মাছ নিয়ে যারা বিক্রি করে, তারা প্রায় সকলেই রাজারহাট, ভাঙড় অঞ্চলের মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ। তাদের কয়েক জনের সঙ্গে আমার যে কোনও কারণেই হোক, একটা আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। ওরা আমাকে কাকা বলে ডাকে। রোজ সকালে বাজারে যাওয়ার সময় তিন-চার বোতল ঠান্ডা জল নিয়ে যাই ওদের জন্য। ওরা তৃপ্তি সহকারে সেই জল খায়। ওরা আমার বাড়ি আসে। আমিও ওদের বাড়ি যাই। আজ ভাবছি, রাজ্যে পালাবদল হলে এই আশি ছুঁইছুঁই বয়সে এসে কারও ধমক খেতে হবে না তো— কেন ওদের জল দিচ্ছেন?
সুশান্ত ঘোষ
কলকাতা-৪০
রাজনীতির মানে
‘তেষ্টা পেলে জল খাবে, ব্যস’ নিবন্ধ প্রসঙ্গে বলি, কয়েক দিন আগে স্কুলে যাওয়ার পথে বর্তমান প্রেক্ষাপট নিয়ে কথা প্রসঙ্গে এক জন শিক্ষক আমায় বললেন, “আপনি কি মুসলমান হতে চাইছেন?” কথাটা বিবেককে নাড়িয়ে দিল। এই মানসিকতা নিয়ে বিদ্যালয়ে আমরা কী শিক্ষা দেব? কিছু দিন আগে এই সংবাদপত্রেই পড়েছি, পরিবার থেকে বিতাড়িত হয়ে এক হিন্দু বৃদ্ধা একটি মুসলিম পাড়ায় আশ্রিত ছিলেন। প্রতিটি পরিবার ভাগ করে ওঁর পথ্যের দায়িত্ব নিয়েছেন, এবং চরম অসুস্থতার পরে হাসপাতাল থেকে শবদেহ কাঁধে করে হিন্দু ধর্মাচার মেনে দাহ পর্যন্ত সবই নিষ্ঠার সঙ্গে করেছেন। এই ভাবেই সমাজ এগিয়ে চলেছে স্বাভাবিক ছন্দে। তা হলে কেন “খুব তেষ্টায় মন্দিরে জল খেতে গিয়েছিলাম” বলায় বালকটিকে এই ভাবে হিংস্রতার শিকার হতে হল? ভূমিষ্ঠ সন্তানের একমাত্র পরিচয়, সে নবজাতক। তার বেড়ে ওঠার জন্য চাই সুস্থ সমাজ। ধর্মের খোলস থেকে বেরিয়ে মানবতার ধর্মে সবাইকে হাত মেলাতে হবে। রাজনীতির মানে হোক সুস্থ, সুন্দর পরিবেশে, যথার্থ শিক্ষা ও উন্নয়নের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
মাধবী মুখোপাধ্যায় পন্ডা
তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর
সমদর্শিতা
স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষিত ‘অমৃত মহোৎসব’ নিয়ে সেমন্তী ঘোষের নিবন্ধ (‘জাতীয়তা: সত্য ও মিথ্যা’, ১৯-৩) সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলতে চাই। ধর্মভিত্তিক দ্বি-জাতিতত্ত্ব তথা রাজনীতির ঘায়ে যদি ভারত পঙ্গু হয়ে আত্মপ্রকাশ করে থাকে, তা হলে তার পঙ্গুত্ব নিবারণে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের মধ্যে সর্বজনীনতা ও সমদর্শিতা প্রত্যাশিত। কিন্তু নীতি হিসেবে ‘প্রিন্সিপলড ডিসট্যান্স’ সমানাধিকারের বিপ্রতীপে অবস্থান করে। লেখকের মতে, ধর্মনিরপেক্ষতা পশ্চিমের বহু দেশে ধর্মের বিরুদ্ধতা হলেও, ভারতের ক্ষেত্রে তার অর্থ সব ধর্মকে সমান ভাবে দেখা। আর সব ধর্মকে সমান জায়গায় আনার জন্য “এগিয়ে-থাকা ধর্মসমাজ ও পিছিয়ে-থাকা ধর্মসমাজকে একটু আলাদা করে দেখতে হয়।” ‘একটু আলাদা করে দেখা’-র অর্থ যদি ধর্মীয় পরিচিতির কারণে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়, তা হলে তা ধর্মীয় বিভাজনেরই নামান্তর, যা সংবিধান-বিরোধী। তা ছাড়া কোন ধর্মসমাজ এগিয়ে আর কোনটি পিছিয়ে, তার কোনও নির্দিষ্ট রূপরেখা নেই, আছে কেবল এক অস্পষ্ট নৈতিকতা। সেই নৈতিকতা বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে বিভিন্ন রকম বোঝাপড়া করতে বলে।
এই বোঝাপড়া যে সঙ্কটকালে বিতর্কের সৃষ্টি করে, সংঘাতের পরিবেশ তৈরি করে, তা স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে নজর রাখলেই জানা যায়। লেখকের বক্তব্যেই স্পষ্ট, এই তথাকথিত এগিয়ে-থাকা ধর্মসমাজ হল সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজ। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতা অগ্রসরতার পরিচায়ক কি না, তা নিয়ে ঘোর সংশয় থেকে যায়। কারণ, দেশের এক বিশাল সংখ্যক জনগণ ‘অনগ্রসর’ বলে চিহ্নিত এবং সংবিধান-স্বীকৃত সংরক্ষণের আওতাভুক্ত। কাজেই আজকের ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতি ওই ‘বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে বিভিন্ন বোঝাপড়া’-র ফল কি না, তা নিয়ে আলোচনা হতেই পারে। অন্তত তার নীতিগুলো সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন বা পরিমার্জন করা প্রয়োজন কি না, সে নিয়ে পর্যালোচনার অবকাশ থেকে যায়। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সংরক্ষণ নীতি আর্থ-সামাজিক অনগ্রসরতা দূর করার লক্ষ্যে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ধর্মীয় অনগ্রসরতা বলে সংবিধানে কিছু নেই, তাই ‘পিছিয়ে থাকা ধর্মসমাজ’ বলতে কী বোঝায়, তা স্পষ্ট নয়।
ধর্মনিরপেক্ষতা ভারতের সংবিধানের খসড়া প্রস্তুতি থেকেই একটি মৌলিক নীতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু সংবিধান-প্রণেতারা ইউরোপীয় ও আমেরিকার সংবিধানকে সামনে রেখে খসড়া তৈরি করার সময়ে ধর্মনিরপেক্ষতার ভারতীয় স্বরূপ নিয়ে বিতর্কের মুখোমুখি হন। কারণ ইউরোপীয় প্রেক্ষিতে তা ছিল অনেকাংশেই প্রোটেস্ট্যান্ট আদর্শের উপর নির্মিত । ভারতের ধর্মভীরু সমাজে তা কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা শেষে ‘সেকুলারিজ়ম’ শব্দটি প্রস্তাবনায় অন্তর্ভুক্ত না করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি অন্তর্ভুক্ত হয় ১৯৭৬ সালে, সংবিধানের ৪২তম সংশোধনীর মাধ্যমে। তার আগের বছর দেশে ইমার্জেন্সি ঘোষণা করেছেন ইন্দিরা গাঁধী, বিরোধী কণ্ঠস্বর স্তব্ধ।
করালীপ্রসাদ মালি
সিউড়ি, বীরভূম
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy