প্রেমাংশু চৌধুরীর ‘আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি?’ (২৮-৩) শীর্ষক প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা বলতে চাই। ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে বিজেপির স্লোগান ছিল ‘ভারত উদয়’ বা ‘শাইনিং ইন্ডিয়া’। প্রায় দু’কোটি আমেরিকান ডলার খরচ করে সমস্ত টেলিভিশন চ্যানেল এবং কাগজে অটলবিহারী বাজপেয়ীর ছবি দিয়ে ‘ভারত উদয়’-এর বিপুল প্রচার করা হয়েছিল। সমস্ত টেলিভিশন চ্যানেলের জনমত সমীক্ষায় দেখানো হয়েছিল যে, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আবার অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে সরকার গঠিত হতে চলেছে। কিন্তু ভারতের জনগণ ওই বিপুল প্রচারে প্রভাবিত না হয়ে, এনডিএ জোটকে দ্বিতীয় বারের জন্য সরকার গঠনের সুযোগ দেননি।
এ বারের নির্বাচনে বিজেপির স্লোগান ‘অবকি বার চারশো পার’। এ বারও সমস্ত প্রচারমাধ্যম অনেক আগে থেকেই দেখাতে শুরু করেছে, তৃতীয় বারের জন্য নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রী হওয়া শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা। বাস্তব কিন্তু অন্য কথা বলে। যদি সত্যিই ৪০০ আসন পাওয়ার মতো পরিস্থিতি বিজেপির পক্ষে থাকত, তা হলে নির্বাচনের ঠিক আগেই বিরোধী দলের মুখ্যমন্ত্রী এবং নেতাদের ধরে ধরে জেলে পোরার দরকার হত কি? রামমন্দির উদ্বোধনের ‘মাস হিস্টিরিয়া’ এখন অনেকটাই স্তিমিত হয়ে পড়েছে। এ দিকে অনেক চেষ্টা করেও ইলেক্টোরাল বন্ডের তথ্যগুলোকে চেপে রাখা গেল না।
ফলে ২০১৪ সালের নির্বাচনে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াইয়ের যে প্রতিশ্রুতি নরেন্দ্র মোদী দিয়েছিলেন, তা আসন্ন নির্বাচনে প্রশ্নের মুখে। প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, সিবিআই-এর ন’টি মামলায় অভিযুক্ত কর্নাটকের খনি মাফিয়া জি জনার্দন রেড্ডিকে বিজেপি আবার দলে নিতে বাধ্য হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গেও বিজেপির অবস্থা খুব একটা ভাল নয়। কারণ, গত লোকসভা নির্বাচনে যে বামেদের ভোটে বিজেপির প্রার্থীরা জয়ী হয়েছিলেন, পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর থেকে সেই ভোট আবার বামেদের দিকে ফেরার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। সুতরাং এ বারের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপিকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে।
শেষাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়, ভদ্রেশ্বর, হুগলি
কী গ্যারান্টি?
প্রেমাংশু চৌধুরী মোদী সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহারের বহু নজির একত্রিত করে লিখেছেন। প্রথমেই প্রশ্ন করেছেন, এই বার চারশো পার কি এত সহজে হয়ে যাবে? উনি সব রাজ্য ধরে ধরে অন্যায়গুলি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, এবং গত বারের থেকে আসন কমবে, তার ইঙ্গিত দিয়েছেন। কেবল বললেন না, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির আসন কতটা বাড়বে বা কমবে গত বারের থেকে। বললেন না, হেভিওয়েট দিলীপ ঘোষকে কেন মেদিনীপুর থেকে বর্ধমান পূর্বে পাঠানো হল। কেন রায়গঞ্জের দেবশ্রী চৌধুরীকে তুলে দক্ষিণ কলকাতায় পাঠিয়ে বলির পাঁঠা করল বিজেপির ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’ আরএসএস।
আসল কথাটা আরএসএস বুঝতে পেরেছে— মানুষের দেওয়াল লিখন। প্রসার ভারতীর নির্লজ্জ চাটুকারিতা দিয়েও সব দুর্নীতি রোধ করতে পারা যাচ্ছে না। গণতন্ত্রের ভূলুণ্ঠিত অবস্থা কেন করলেন মোদী সরকার, এর জবাব মানুষ ভোটবাক্সে দেবেন, যতই ক্ষমতাসীনরা বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করুন না কেন। মোদী প্রথম লোকসভা নির্বাচনের আগে বলেছিলেন ‘অচ্ছে দিন’ আসবে। ভাল দিন যদি আসত, ৭০ শতাংশ মানুষের সম্পদ দশটি ধনকুবেরের হাতে চলে যেত না। প্রতি বছর দু’কোটি বেকারের চাকরির প্রতিশ্রুতিও আর ভাসানো যাচ্ছে না। প্রত্যেকের অ্যাকাউন্টে ১৫ লাখ টাকা ঢোকাবেন কালো টাকা উদ্ধার করে, এমন ঘোষণাও ছিল ‘জুমলা’।
দ্বিতীয় বার সরকারে আসার আগে নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, ‘মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়।’ সত্যিই দেখা গেল, তিনি অনেক কিছু সম্ভব করেছেন। ভারতের যত রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা, যেমন ভারতীয় রেল, বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর জলের দরে তুলে দেওয়া গিয়েছে সরকার-ঘনিষ্ঠ শিল্পপতিদের হাতে। মোদী গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়ে যে গৌতম আদানির পুঁজি ছিল খুব বেশি হলে একশো কোটি টাকা, তিনি এখন ভারতের সবচেয়ে বড় কর্পোরেট হাউসের মালিক। মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় সব দ্রব্যের একচেটিয়া ব্যবসা আদানি গোষ্ঠীর হাতে। জল, স্থল, আকাশ, সবেতেই সরকার-ঘনিষ্ঠ শিল্পপতিরা ঢুকে পড়েছেন।
তৃতীয় বার ক্ষমতায় আসার জন্য মোদী বিজ্ঞাপনে নিজের গলাতেই বলছেন, ‘মোদী কি গ্যারান্টি’। কিসের গ্যারান্টি দিচ্ছেন মোদী? আশি কোটি মানুষের জন্য আগামী পাঁচ বছর বিনামূল্যে রেশনের সুবিধা। আমরা মূর্খ মানুষেরা ধরেই ফেলেছি একশো চল্লিশ কোটির মধ্যে আশি কোটি বিপিএল তালিকায় চলে গিয়েছে। ঘর ঘর জল, ঘর ঘর বিজলি, ঘর ঘর শৌচাগার, ইত্যাদি প্রতিশ্রুতি মিলছে। কিন্তু এখন বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করার জন্য কংগ্রেসের ৩০ বছর আগের ঘটনার জেরে অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ় হয়, বিরোধী নেতাদের ছলচাতুরি করে জেলে পুরতে হয়। সাম্প্রতিক সময়ে কেজরীওয়ালকে জেলে ঢুকিয়ে মোদী আপ ও কংগ্রেসকে এক ছাতার নীচে এনে ফেলেছেন। আন্দাজ হয়, এ বার খুব বেশি হলে অল্পের জন্য মান রক্ষা হবে মোদীজির। সত্যিই তাই হল কি না, জানতে অপেক্ষা করে থাকছি ফল প্রকাশের জন্য।
বীরেন্দ্র নাথ মাইতি, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
অনৈক্য
নির্বাচনের দিন ঘোষণার বহু আগেই বিরোধী দলগুলো এক নির্বাচনী জোটের সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু নির্বাচনের প্রাক্কালে সেই জোটের কুশীলবরা একে অপরের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে চলেছেন। বিরোধীদের এই ছন্নছাড়া ভাব দেখেই পোড়-খাওয়া রাজনীতিবিদ নরেন্দ্র মোদী ভরপুর আত্মবিশ্বাসে হুঙ্কার দিয়ে চলেছেন ‘চারশো পার’। অথচ যদি বিরোধী ঐক্য সফল হত, শাসক দলকে প্রতিশ্রুতি রক্ষায় ব্যর্থতার জবাবদিহি করতে হত। জবাব দিতে হত বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, আর্থিক অসাম্য, কৃষকের দাবি, নির্বাচনী বন্ড নিয়ে। নির্বাচনের আগে তেল বা গ্যাসের দাম কমিয়ে বা রেশনে কিছু চাল-গম দিয়ে ‘দয়ার দান’ বা ‘রেউড়ি বিলি’ নিয়েই কি নাগরিকদের খুশি থাকতে হবে? রাষ্ট্রের কাছে সাধারণ নাগরিকের যা পাওনা, তা নেতাদের দান নয়, অধিকার— এ কথা নাগরিক বিস্মৃত। সর্বত্র সরকার-বিতরিত সামগ্রীর দাতা হিসাবে আত্মবিশ্বাসী নেতার উজ্জ্বল মুখের বিজ্ঞাপন।
সোমেশ সরকার, শেওড়াফুলি, হুগলি
নামের ছটা
প্রেমাংশু চৌধুরীর প্রবন্ধটি যথাযথ। নরেন্দ্র মোদী যতই প্রচার করুন, চারশো পার হওয়া খুবই কঠিন। তার কারণ হিন্দি বলয়ে বিজেপির আসন আর বাড়বে না বরং কমার সম্ভাবনা। দক্ষিণ ভারতে দল খুবই দুর্বল। পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশায় বিজেপি আসন বাড়ানোর খুব চেষ্টা করবে, কিন্তু কী হবে বলা কঠিন। সে ক্ষেত্রে চারশো পার কী ভাবে সম্ভব? প্রধানমন্ত্রীর এ কথা বলার উদ্দেশ্য একটাই— হাওয়া তোলা। ছিন্নবিচ্ছিন্ন বিরোধী জোটকে পিষে দেওয়া। কিন্তু তা সহজ নয়। বিগত দশ বছরের প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা তো আছেই, সঙ্গে ভোটের মুখে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীওয়ালকে জেলে পোরা তাঁর বিরুদ্ধে যেতে পারে। দিল্লির সাত-সাতটা বিজেপির আসন ‘ভ্যানিশ’ হয়ে যেতে পারে। পঞ্জাবের অবস্থাও মোটেই অনুকূল নয়। এই ভোটের মরসুমে কংগ্রেস-সহ বিভিন্ন দলে চলছে হতাশাগ্রস্তদের ভাঙন, বিজেপি যাকে পারছে লুফে নিচ্ছে, আগের অভিযুক্তদেরও কাছে টানছে। এটা যদিও ঠিক যে ‘মোদী’ নামের ভারত জুড়ে যে উজ্জ্বল ছটা, তার ধারেকাছে কেউ নেই। কিন্তু শুধু নাম দিয়েই কি সব হয়?
অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা-৮৪
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy