—প্রতীকী ছবি।
বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আমরা যাচ্ছি কোথায়’ (২৬-৫) শীর্ষক প্রবন্ধ প্রসঙ্গে বলতে চাই, কোনও জাতি উপনিবেশবাদ আর পরাধীনতার যে আচ্ছন্নতায় দীর্ঘ কাল ধরে ধুঁকতে ধুঁকতে কখনও রবীন্দ্রনাথ, কখনও ফুটবল, কখনও নাটক, আর প্রাচীন দেশীয় ঐতিহ্যের আলোয় পথ খুঁজতে চেয়েছে, তার চলার পথ সব সময় মসৃণ না-ও হতে পারে। উত্তম-সুচিত্রা, চুনী গোস্বামী, মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল, কে এল সায়গল করতে করতে দেশভাগ, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, অশিক্ষা, গৃহহীনতা, দারিদ্রের ঘা খেতে খেতে দিনলিপি লিখে চলেছে। একটা সীমাহীন হতাশা আর ক্রোধের বিস্ফোরণ চাপা-পড়া ইতিহাস হতে পারে না। বাঙালির না গড়ে উঠল জাতিগত সংহতিবোধ, না এল মানসিক ঐক্য। মাঝখান থেকে বইতে শুরু করল বিভেদের চোরাস্রোত।
বাঙালি এখন জাতীয় স্তর ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিকতায় উত্তীর্ণ। গণেশ পুজো, ধনতেরসের ধামাকা ছুঁয়ে বড়দিনের গরমাগরম কেক কিনে, ধুতি শাড়ি ছেড়ে কোট-প্যান্টালুন আর সালোয়ার কামিজ, লহেঙ্গা গ্রহণ করল। আলামোহন দাস, সুধীর সেনকে ছাড়িয়ে সৌরভ-সত্যজিৎ, সুস্মিতা সেন-অমর্ত্য সেন, আলি আকবর-রবিশঙ্করকে মাথায় তুলে নিয়েছে। ভৌগোলিক সীমা মুছে মুহাম্মদ ইউনূস, তুলসীদাস বলরাম, ভি বালসারাকে ঘরের ছেলে বানিয়ে বাঙালির আত্মীকরণ আজও চলছে সমানে। জাতি হিসাবে বাঙালি কখনও এগিয়েছে, কখনও আবার পিছিয়েছে। কিন্তু আত্মদর্শনের প্রসার থেমে থাকেনি। বন্ধ হয়ে যায়নি তার আত্মনির্মাণের প্রয়াসও। বাঙালি আত্মপ্রত্যয় হারায়নি আজও। তাই, আত্মঘাতী তো বাঙালির হওয়ার কথাই নয়।
শান্তি প্রামাণিক, উলুবেড়িয়া, হাওড়া
মৃত কারখানা
বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘আমরা যাচ্ছি কোথায়’ শীর্ষক প্রবন্ধটির পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। লেখক প্রশ্ন তুলেছেন “...বৈশাখের এক থেকে পঁচিশের দিকে এগোতে এগোতে মনে হয় কোথায় ছিলাম আমরা, যাচ্ছি কোথায়?” যে বাঙালি এক দিন শিক্ষাক্ষেত্রে, সাংস্কৃতিক চর্চার ক্ষেত্রে, অর্থনৈতিক সাফল্যের বিচারে ভারতে এগিয়ে ছিল, সে কেন আজ নিজভূমেই পরবাসী হওয়ার আশঙ্কায়? বাঙালি ঈর্ষণীয় মেধার অধিকারী। কিন্তু পেটে গামছা বেঁধে কি মেধার বিকাশ ঘটানো সম্ভব? সকলের পক্ষে তো ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, তরুণ মজুমদার, শক্তি-সুনীল-সমরেশ, মণি ভৌমিক কিংবা আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতো লড়াকু মানসিকতার অধিকারী হওয়া সম্ভব নয়। আমরা এখনকার বাঙালিরা এঁদের কাজে অনুপ্রাণিত হলাম না। অথচ, অনুপ্রেরণা পেলাম ঘুষ দিয়ে ছেলেমেয়েকে একটি সরকারি কিংবা আধা-সরকারি চাকরি পাইয়ে দিতে।
খুব একটা বেশি দিন আগের কথা নয়। যখন বজবজ থেকে নৈহাটি কিংবা হাওড়া-আসানসোল-দুর্গাপুরের বিস্তীর্ণ শিল্পাঞ্চলের কারখানাগুলি ছিল লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের কর্মস্থল। বেঙ্গল কেমিক্যালস, হিন্দুস্থান হেভি কেমিক্যালস, ক্যালকাটা সিল্ক মিল, ক্যালকাটা কেমিক্যাল কোম্পানি, মেটালবক্স, ডাকব্যাক, ডানলপ, সেন-র্যালে সাইকেল, বাসন্তী কটন মিল, বঙ্গোদয় কটন মিল, ভারত জুট মিল-সহ অসংখ্য পাটকল, বিভিন্ন ধরনের কল-কারখানায় পশ্চিমবঙ্গের নজরকাড়া সমৃদ্ধি ছিল। বাঙালিদের তো বটেই, বিহার, ওড়িশা, উত্তরপ্রদেশ-সহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে আগত হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হত।
আজ সে সব কারখানার অধিকাংশই বন্ধ অথবা রুগ্ণ। কেন্দ্রীয় সরকারের মাসুল সমীকরণ নীতির কুপ্রভাব পড়েছিল আমাদের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর। গরিব ঘরের বাঙালি ছেলেমেয়েরা এখন ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে জনমজুরের কাজ খুঁজতে যায়। এক দল অযোগ্য ব্যক্তি কোনও মতে টাকা জোগাড় করে ঘুষ দিয়ে চাকরি পেতে তৎপর। যোগ্যরা রোদ-ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে দিনের পর দিন পথে বসে রয়েছেন। সহ্য করছেন প্রশাসনিক লাঞ্ছনা-গঞ্জনা। উচ্চশিক্ষিত বাঙালি যুবক-যুবতীদের একাংশ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ, ও বিশ্বের নানা দেশে ছড়িয়ে পড়েছেন। তাঁরা অধিকাংশই বিদেশের মাটিতে থিতু হওয়ার সুযোগ খোঁজেন। নিতান্ত নিরুপায় না হলে এঁরা কেউ ঘরের টানে পশ্চিমবঙ্গে ফিরে তাঁদের সন্তানদের ভগ্ন শিক্ষাব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার সম্মুখীন হতে দিতে চান না।
এখন বন্ধ কারখানার জমিতেই গড়ে উঠছে, আবাসন অথবা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। শহুরে বাঙালিদের ‘পঁচিশে বৈশাখ’ পালনে ভিড় বাড়লেও, রবীন্দ্রনাথকে জানা-বোঝার মানসিকতা ক্রমাগত হারিয়ে যাচ্ছে। ষাটের দশকে আমাদের কৈশোর যৌবনের সময়টায় পাড়ায়-পাড়ায় যে হৈমন্তিক জলসাগুলো হত সেখানে গভীর রাত পর্যন্ত হেমন্ত-মান্না-শ্যামল-সতীনাথ-ধনঞ্জয়-মানবেন্দ্র-নির্মলেন্দু-পিন্টু এবং সন্ধ্যা-আরতি-উৎপলা প্রমুখ গানের শিল্পীরাই আসর মাতাতেন। ওই সকল আসরে পুজোর নতুন গান শোনার আকর্ষণই ছিল আলাদা। হিন্দি গান শোনার তেমন চাহিদা কখনও অনুভূত হয়নি। পশ্চিমবঙ্গে ‘হিন্দি হটাও’ আন্দোলন দানা বাঁধতে না পারলেও, তার প্রত্যক্ষ প্রভাব আমাদের মধ্যে পড়েছিল। অন্য দিকে, হিন্দি ভাষার আগ্রাসন দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলো যে ভাবে রুখে দিতে পেরেছে, পশ্চিমবঙ্গ তা পারেনি। সকলের সংস্কৃতিকে খোলা মনে গ্রহণের উদারতাই বাঙালির নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি বিপন্নতার অলিখিত কারণ হল কি না, ভেবে দেখা দরকার।
“যে অর্থনৈতিক অপারগতা বাঙালিকে গড়িয়াহাট, নিউ আলিপুর কিংবা মানিকতলা, গিরিশ পার্কের ফ্ল্যাট কিনতে দেয় না, সেই অপারগতার” কারণগুলি দূর করার জন্য প্রয়োজন ছিল পশ্চিমবঙ্গের স্থায়ী সম্পদ ও জনশক্তিকে সুপরিকল্পিত ভাবে কাজে লাগানোর ধারাবাহিক উদ্যোগ। রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও সদিচ্ছা থাকলে, এত দিনে অবশ্যই পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার অবসান ঘটানো সম্ভব হত।
রতন রায়চৌধুরী, পানিহাটি, উত্তর ২৪ পরগনা
সঙ্কট দেশ জুড়ে
বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ঠিকই বলেছেন, সংস্কৃতি, অর্থনীতি সত্যিই আজ বিপন্ন। তবে তা শুধু বঙ্গেই নয়, সারা দেশেই আজ এক অবস্থা। ভারতীয় নবজাগরণ আন্দোলনের প্রভাব, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রভাব, বিশেষত ত্রিশের দশক থেকে স্বাধীনতা-পরবর্তী সত্তরের দশক পর্যন্ত যে সময়টা এ দেশ পার হয়েছে, সেই সময়ে দেশের ছাত্র-যুবকদের মধ্যে একটা অতীতের বড় মানুষদের প্রতি শ্রদ্ধা ছিল। শুধু তা-ই নয়, শিক্ষাজগতে, সঙ্গীতজগতে, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-শিল্প ও রাজনীতি, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে, এমনকি অর্থনীতির ক্ষেত্রেও তার প্রভাব পরিলক্ষিত হত। তখনও, সমাজ-পরিবেশ এতটা বিষাক্ত হয়নি। নীতি নৈতিকতা আদর্শ ও মূল্যবোধের যে এক মারাত্মক সঙ্কট ঘনীভূত হচ্ছে, এই আশঙ্কা কিন্তু কোনও কোনও রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও অর্থনীতিবিদরা করেছিলেন। দেশের অর্থনীতি মূলত ধনবাদী। সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন তার মূল লক্ষ্য। এই অর্থনীতির নিয়মেই দুর্গাপুর, বার্নপুর-সহ সব শিল্পাঞ্চলের এই দুরবস্থা। আবার রাজনীতি মূল নিয়ামক শক্তি যে-হেতু, সে ধনবাদীদের সেবা করতে গিয়ে নিজে যেমন দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ছে, তার প্রভাব সমাজের উপরেও বর্তাচ্ছে। ফলে এক সময় রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, হেমন্ত-মান্না-শ্যামল, সন্ধ্যা ও আরতি মুখোপাধ্যায়ের গান গাওয়া শিল্পীরা আসর মাতাতেন। আর আজ শুধু হৃদ্যন্ত্র বিকল করা ডিজে দাপিয়ে বেড়ায়।
শিক্ষা পণ্য, স্বাস্থ্যও ঠিক তাই। মদের ঢালাও ব্যবস্থা লেখক উল্লেখ করেছেন, কারণ সরকারের কোষাগারে সেটি একমাত্র আশা-ভরসার স্থল। পচাগলা ধনবাদী সংস্কৃতি ও মুমূর্ষু অর্থনীতি আজ আর কোনও কিছুই দিতে পারছে না। এর থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে হবে।
বিদ্যুৎ সীট, জগদল্লা, বাঁকুড়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy