সম্পাদকীয় ‘নির্যাতন পর্ব’ ও অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘দুয়ার আজি খুলে গেছে’ (২৪-১২) শীর্ষক নিবন্ধে ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির স্পষ্ট, নির্দ্বিধ বিশ্লেষণে অনুপ্রাণিত হয়েই এই চিঠি। সবচেয়ে কঠিন সময়েই তো আত্মসচেতনতা সবচেয়ে বেশি দরকার। তার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজন ইতিহাসবোধ। ইতিহাসজ্ঞান কথাটি ব্যবহার করতে চাই না। মোদী ও অমিত শাহ অনবরত ইতিহাসজ্ঞানের প্রমাণ হিসেবে গাঁধী ও নেহরুর কথা তোলেন বিপরীত তৎপরতায়— আমাদের ইতিহাসবোধকে তাঁদের ফ্যাসিবাদী রাজনীতির অনুকূলে আনার সম্মুখবর্তী দায়ে। এর মধ্যে পরিকল্পিত ব্যাভিচার আছে।
সে দিন এক তরুণ বললেন, এখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি ফ্যাসিবাদ নয়, ‘বুকিশ ফ্যাসিবাদ’। কথাটি আগে শুনিনি। পরে খোঁজ নিয়ে জানি, এমন একটা কথা গুগলের ফ্যাসিবাদ সংক্রান্ত তথ্যে নাকি ব্যবহৃত হয়। সেই তরুণ পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী দলের সমর্থক। ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে তাঁর তো আর একটু স্পষ্ট ধারণা থাকা উচিত। সন্দেহ হল, গলদটা বোধ হয় বিসমিল্লায়।
আনন্দবাজারের উল্লিখিত লেখা দু’টি সেই বিসমিল্লার কথা মনে করাল— আমাদের জাতীয় সঙ্গীত, আমাদের জাতীয় পতাকা, আমাদের ভারতীয়তা চরম দুঃসময়ে আমরা আমাদের জন্য তৈরি করে তুলেছি। তার জন্য কঠিন মূল্য আমরা দিয়েছি।
বিশেষজ্ঞতা আবার এক ধরনের ভুল করে। সংসদে যে আইন পাশ হয়েছে, তার নাকি বিরোধিতা করা যায় না।
মহাত্মা গাঁধী ভারতের স্বাধীনতার আন্দোলনকে একটা নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও বাস্তব ভিত্তি দিয়েছিলেন। তাঁর অহিংসা, সত্যাগ্রহ, আইন অমান্য, নিরস্ত্র প্রতিরোধ— ধারণা ও প্রক্রিয়াগুলির মধ্যে এক কঠিন সাধনা আছে। ‘তোমার যেমন আইন তৈরির অধিকার আছে, সেই আইন অমান্য করার অধিকার তেমনই আমারও আছে’— এমন একটা আত্মবিশ্বাস পরাধীন একটি জাতির কোটি কোটি মানুষকে ‘নির্ভয়’ করে তুলেছিল।
নাগরিক পঞ্জি ও নাগরিকতা আইন নিয়ে সারা দেশে যে আন্দোলন ফেটে পড়ছে— দলমতনির্বিশেষে, বিশেষ করে তরুণ-তরুণীরা যে দেশবোধ থেকে এই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, তাতে এটা স্পষ্ট যে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকে তাঁরা এই প্রেরণা পাচ্ছেন। তাঁরা অপমানিত বোধ করছেন যে তাঁদের ভোটে তৈরি এক সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে এক আইন আনছেন, যে আইনে, ভারত এক হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত হবে। সুপ্রিম কোর্টের অযোধ্যা রায় আমাদের মাথা হেঁট করে দিয়েছে। জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্য-পরিচয়-বাতিল সেই হেঁট মাথাকে আরও হেঁট করেছে, নাগরিকতা যাচাই আইন আমাদের পিঠ ঠেকিয়ে দিল দেওয়ালে। প্রতিরোধ ছাড়া আর কোনও পরিত্রাণ নেই। আমাদের দেশেরই সরকার যদি এমন আইন পাশ করে, যে আইনে কোনও মুসলমানের শরণার্থী হিসেবে ভারত প্রবেশের অধিকার থাকবে না, প্রধানমন্ত্রী যদি জনসভায় বক্তৃতা করেন— ভারত কি ধর্মশালা, তাতে আমাদের আত্মবোধে আঘাত লেগেছে, দেশবোধ ক্ষুণ্ণ হয়েছে, দেশবাসীদের মধ্যে যাঁরা ধার্মিক তাঁদের ধর্মবোধও আহত হয়েছে। এমন হতেও পারে, যাঁদের ভোটে বর্তমান দ্বিতীয় মোদী সরকার গঠিত হয়েছে, তাঁরাই এখন এই সরকারকে অবিশ্বাস করছেন।
২৪ ডিসেম্বর অমিত শাহের টিভি সাক্ষাৎকারে অবিশ্বাস আরও এক পাক বেড়ে গেল। অমিত শাহ ২০২১-এর সেন্সাস-কর্মসূচির সঙ্গে জাতীয় নাগরিক তথ্য ভাণ্ডার (এনপিআর) জুড়ে দিয়ে সহসা নিরামিষাশী বেড়াল সেজেছেন। এনপিআর-এর তথ্য নাগরিকের ইচ্ছাধীন ও তা অন্য কোনও উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না। এ তো সাত-পুরনো কথা। হয়তো প্রথম সেন্সাস থেকেই। কারণ প্রথম সেন্সাসেও খুব আপত্তি হয়েছিল কোম্পানি-ব্রিটিশ আমলেই। কিন্তু এনআরসি হচ্ছেই। এবং সিএএ থাকছেই। তার জন্য টাকাও বরাদ্দ হয়ে গিয়েছে।
দেশবাসীর মূল আপত্তি তো এনআরসি ও এনপিআর থেকে ‘মুসলমান’ ধর্মীয়দের বাদ রাখার বিরুদ্ধে ও প্রধানমন্ত্রী-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তৃতাগুলির নিহিত ও প্রকাশ্য মুসলিম বিরোধিতা নিয়ে। তাঁরা যে তেমন মুসলিম-বিরোধী নন, তা প্রমাণ করার সোজা রাস্তা তো এই সংশোধিত নতুন আইনে ‘মুসলিম’ শব্দটি জুড়ে দেওয়া। কি প্রধানমন্ত্রী, কি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, কেউই এই কথাটির উত্তর দিচ্ছেন না। তাতে এই সন্দেহ ও অবিশ্বাস আরও গিঁট পাকিয়ে যাচ্ছে যে, তাঁরা ভারতকে মুসলিমহীন এক হিন্দু রাষ্ট্র বানাতে চান। সংসদের ভিতরে যদি তাঁরা সেই হিন্দু রাষ্ট্রের প্রাথমিক ছক তৈরি করতে পারেন ও পাশ করিয়ে নিতে পারেন, তা হলে সংসদের বাইরে এই বিপুল বিশাল বিচিত্র বহুধর্মীয় দেশও তো জানাতে পারে, এই সংশোধিত আইন আমরা মানব না। কেন মানব না? কারণ, সরকার এক গলায় কথা বলছে না। কেন বলছে না? কারণ, সরকার একটা গোপন সাম্প্রদায়িক কর্মসূচি নিয়ে এগোচ্ছে, যা গোপন তার কোনও বোধগম্য ভাষা কোত্থেকে থাকবে?
২০১৫-র ২১ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী হরিভাই চৌধুরী বলেছিলেন, ‘‘এনপিআর’, ‘এনআরসি’-র প্রথম স্তর ও সংগৃহীত তথ্য প্রত্যেক নাগরিকের প্রত্যেক বসবাসীর ব্যক্তিগত তথ্যের ভিত্তিতে।’’
২০১৮-১৯’এ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বার্ষিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘জাতীয় বসবাসীর তালিকা’, ‘ভারতীয় নাগরিকদের জাতীয় রেজিস্টার’ তৈরির প্রথম ধাপ। ২০১৭-১৮’য় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বার্ষিক রিপোর্টে বলা হয়েছে— ‘এনআরসি তৈরি হয়েছে ২০১১-র সেন্সাস তথ্যের ভিত্তিতে’।২০১৯-এর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নোটিসে বলা হয়েছে, ‘২০০৩-এর রুল ও সাবরুল মোতাবেক কেন্দ্রীয় সরকার জনসংখ্যা রেজিস্টার তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ (বসন্ত কুমার মহান্তি ও অনীতা জোশুয়ার সংগৃহীত তথ্য। দ্য টেলিগ্রাফ, ২৫-১২)।এর চেয়ে পরিষ্কার আর কোনও তথ্য প্রমাণ করতে পারে, ২০০৩-এর নাগরিকতা আইনের বিভিন্ন সংশোধনী থেকেই এনপিআর ও এনআরসি শিকলের মতো বাঁধা!
সেই শিকল এখন ভারতীয় নাগরিকদের পায়ে পরাতে চাইছে বিজেপি সরকার। তাই মোদী ও অমিত শাহকে অবিশ্বাস করাটাই সময়ক্রমে হয়ে উঠেছে সারা দেশের নতুন জাতীয়তাবোধ।
দেবেশ রায়
নিজের কাজ
‘গল্পের লোক’ (৩১-১২) শীর্ষক পত্রের প্রত্যুত্তরে এই চিঠি। ‘নিজের কাজ নিজে করা’ প্রসঙ্গে এক জন শিক্ষিকা হিসেবে বিগত ১০ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, একটি স্কুলে যথেষ্ট সংখ্যক গ্রুপ-ডি কর্মী থাকা সত্ত্বেও, তাঁদের অনেক কাজই শিক্ষকদের করে নিতে হয়। যেমন, প্রজেক্ট পেপার স্ট্যাম্প দেওয়া বা মার্কশিটে স্ট্যাম্প দেওয়া। শিক্ষকদের জন্য নির্দিষ্ট ঘরের জানালা খোলা, অথবা বসার চেয়ার-টেবিল মুছে পরিষ্কার করা, এর মধ্যে যে কাজগুলি গ্রুপ-ডি’র কর্মীদের করার কথা, বা অন্তত তাঁদের তত্ত্বাবধানে হওয়ার কথা, তা অনেক সময়েই তাঁরা দিনের পর দিন করেন না।
শিক্ষকদের জন্য বোতলে জল ভরে দেওয়া হয়তো গ্রুপ-ডি’র কাজ নয়, কিন্তু আজ থেকে কুড়ি বছর আগে যখন আমরা ছাত্রী ছিলাম, গ্রুপ-ডি কর্মীরা কুঁজোতে জল তুলে রাখতেন এবং তার উপর একটি পরিষ্কার গ্লাস রেখে দিতেন। বর্তমানে হয়তো প্রত্যেকের জন্য পৃথক ভাবে জল ভরা সম্ভব নয়, কিন্তু শিক্ষকেরাও তো এমন অনেক কাজ প্রতিনিয়ত করছেন, যা তাঁদের নয়, এমনকি আপাতদৃষ্টিতে মর্যাদাহানিকর, কিন্তু কাজগুলি করতে হবে প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে, চাকরির স্বার্থে। অনেক বিদ্যালয়ে তো অফিস সংক্রান্ত বেশির ভাগ কাজই শিক্ষকদের করতে হয়, অনেক অফিসকর্মী থাকা সত্ত্বেও।
বীণাপাণি সিকদার
নৈহাটি, উত্তর ২৪ পরগনা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy