Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
coronavirus

বুঝতে পারছি এই লড়াই খুব স্বল্পস্থায়ী হবে না

এই লকডাউন পরিস্থিতিতে পাঠকদের থেকে তাঁদের অবস্থার কথা, তাঁদের চারপাশের অবস্থার কথা জানতে চাইছি আমরা। সেই সূত্রেই নানান ধরনের সমস্যা পাঠকরা লিখে জানাচ্ছেন। পাঠাচ্ছেন অন্যান্য খবরাখবরও। সমস্যায় পড়া মানুষদের কথা সরকার, প্রশাসন, এবং অবশ্যই আমাদের সব পাঠকের সামনে তুলে ধরতে আমরা ম‌‌নোনীত লেখাগুলি প্রকাশ করছি।এই লকডাউন পরিস্থিতিতে পাঠকদের থেকে তাঁদের অবস্থার কথা, তাঁদের চারপাশের অবস্থার কথা জানতে চাইছি আমরা। সেই সূত্রেই নানান ধরনের সমস্যা পাঠকরা লিখে জানাচ্ছেন। পাঠাচ্ছেন অন্যান্য খবরাখবরও। সমস্যায় পড়া মানুষদের কথা সরকার, প্রশাসন, এবং অবশ্যই আমাদের সব পাঠকের সামনে তুলে ধরতে আমরা ম‌‌নোনীত লেখাগুলি প্রকাশ করছি।

বাচ্চাদের খেলার পার্ক আজ লকডাউনে জনশূন্য—ছবি:লেখক

বাচ্চাদের খেলার পার্ক আজ লকডাউনে জনশূন্য—ছবি:লেখক

শেষ আপডেট: ০১ মে ২০২০ ১৯:৫০
Share: Save:

আর পাঁচটা শহরের মতো আমেরিকার ওহাইয়োর ক্লিভল্যান্ড শহরও অজানা, অদৃশ্য শত্রু করোনা ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করছে। গল্পটাকে ঠিক এইভাবে বলতে চাই, ১১মার্চ পর্যন্ত শহরটা চলছিল তার নিজস্ব ছন্দে। কিন্তু ১২মার্চ দুপুর দুটোর পর হঠাৎ লোকাল নিউজে জানানো হল যে ওহাইয়োতে কয়েকজন মানুষের শরীরে করোনা ভাইরাস হানা দিয়েছে এবং তাদের ১৪ দিনের জন্য কোয়রান্টাইন এ রাখা হয়েছে। ওহাইয়ো স্টেট গভর্নমেন্ট ইমার্জেন্সি ডিক্লেয়ার করে নির্দেশ দিয়েছে সবাইকে ঘরে থাকবার আর খাবার, ওষুধ ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস স্টক করে রাখার।

তা ছাড়া আরও জানানো হল যে ওহাইয়োর প্রায় সমস্ত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস, রেস্তোরাঁ, রিক্রিয়েশনাল সেন্টার, কমিউনিটি সেন্টার, লাইব্রেরি, সেলুন, পার্ক, শপিং মল, ধর্মস্থান, মুভি থিয়েটার, শরীরচর্চা কেন্দ্রগুলোও বন্ধ থাকবে ১ মে পর্যন্ত। আর একেই নাকি বলে "লকডাউন", কিংবা "স্টে-এট-হোম" অর্ডার। সেদিন থেকে আমার দৈনন্দিন অভিধানে ঢুকে পড়ল কতগুলো অব্যবহৃত শব্দ - কোয়ারেন্টাইন, লকডাউন, হোম আইসোলেশন, সোশ্যাল ডিস্ট্যান্স, মাস্ক, ইত্যাদি।

সরকারি সূত্রে লকডাউনের খবরটা পাওয়া মাত্রই বেরিয়ে পড়লাম কিছু শুকনো খাবার, সবজি, দুধ, স্যানিটাইজার, টিস্যুপেপার, ওষুধ ইত্যাদি যোগাড় করতে। দু-তিনটে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ঘুরে ঘুরে দেখলাম দোকানের অনেক জিনিসই উধাও। ভাবলাম হয়তো এখানকার ইন্ডিয়ান স্টোরে গেলে কিছু না কিছু পেয়েই যাব। কিন্তু সে গুড়ে বালি । ২০ মাইল গাড়ি চালিয়ে ইন্ডিয়ান স্টোরে গিয়ে দেখি সেখানেও জিনিসপত্রের দুরবস্থা। অর্ধেক প্রয়োজনীয় জিনিস খুঁজেই পেলাম না। হতবাক হয়ে দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করে ফেললাম, "কী ব্যাপার বলুন তো?"

দোকানদার জানালেন স্টেট গভর্নমেন্টর 'স্টে-অ্য়াট-হোম' অর্ডার জারি হবার পর থেকে প্রচুর মানুষ "প্যানিক বাইং" শুরু করেছে, আর তাই তো এক এক জন ১০/২০ কেজির চাল, আটার বস্তা, এমনকি তরি তরকারিও প্রচুর কিনে দোকান খালি করে দিচ্ছে। তখন চিন্তায় পড়ে গেলাম। বেশ বুঝলাম যে আমি স্টক করার দৌড়ে রীতিমতো লেট। চোখ বন্ধ করে যা খাবার দাবার পেলাম তাই কিনে নিলাম। আপাতত এই রসদ নিয়ে আমাকে ও আমার পরিবারকে যুদ্ধ করতে হবে কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে।

বিক্রেতা বললেন, "নাম, ফোন নম্বর এবং আইটেম লিস্ট দিয়ে যান, নতুন যোগান এলে ফোন করে জানাব, দোকানে এসে কালেক্ট করে নেবেন; তবে কবে যোগান আসবে তা বলা যাবে না।" আমার পরবর্তী অভিযান শুরু হল স্যানিটাইজার সংগ্রহ করা। বার বার হাত ধোওয়া বা স্যানিটাইজ করাই যখন জীবন বাঁচানোর অন্যতম উপায়, তখন স্যানিটাইজার স্টক করতে একটার পর একটা স্টোরে গেলাম আর শুনতে পেলাম "নো স্যানিটাইজার ইন স্টক; অল আর গন।"

এক ওষুধের দোকানে ফার্মাসিস্ট আমাকে বলল রাবিং অ্যালকোহল এবং অ্যালোভেরা জেল মিশিয়ে স্যানিটাইজার বাড়িতেই তৈরি করতে, কারণ বাজারচলতি স্যানিটাইজারগুলো দোকানে আর পাওয়া যাচ্ছে না এবং অনলাইনে ৩-৪ গুণ দামে বিক্রি হচ্ছে।

বুঝে উঠতে পারছিলাম না, যে জায়গায় দু'দিন আগেও মানুষের কোন মাথাব্যথা ছিল না, আজ একদিনের মধ্যে কী হল যে দোকানের সব খাবার, স্যানিটাইজার উধাও হয়ে গেল। তিন দিনের মধ্যেই প্রাণবন্ত ক্লিভল্যাণ্ড যেন থমকে গেল। অপ্রয়োজনীয় কারণে রাস্তায় বেরোলে পুলিশ জরিমানা নিচ্ছে। প্ৰাতঃভ্ৰমণ বা পোষ্যদের দৌড় করানো এখনও নিষিদ্ধ হয়নি। তবে রাস্তায় হাঁটার সময় ৬ ফুট দূরত্বের ব্যবধান বজায় রেখে দুই ব্যাক্তির কথাবার্তা গ্রহণযোগ্য, নয়তো পুলিশ জরিমানা নিতে পারে।

সামগ্রীগুলোর অভাব স্পষ্ট অনেক ডিপার্টমেন্টাল স্টোরেই, তবে তারা সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ক্রেতাদের জন্য দু ধরণের সময় নির্দিষ্ট করেছে। সিনিয়রদের জন্য সকাল বেলায় ২/৩ ঘণ্টা এবং তার পরবর্তী কয়েক ঘন্টা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বাকিদের জন্য। দোকানের বিলিং কাউন্টারগুলোর মধ্যে দূরত্ব বজায় রাখার জন্য কাউন্টারগুলোকে পাশাপাশি না রেখে অল্টারনেটলি খুলে রেখেছে। গ্রোসারির অনলাইন অর্ডারও ৭/১০ দিন সময় লাগছে ডেলিভারি হতে, তাতেও সব জিনিস হাতে পাচ্ছি না।

আমেরিকায় মানুষ গড়ে দিনের প্রায় ১০-১৫ শতাংশ সময়ে গাড়ি চালায় নানা প্রয়োজনে। করোনা প্রকোপে লোকের রাস্তায় বেরোনো বন্ধ হয়ে গেছে আর গাড়িও চলছে খুব কম সংখ্যায়, ফলে তেলের চাহিদা কমে যাওয়ায় তেলের দাম লক্ষণীয় ভাবে হ্রাস পেয়েছে। ব্যস্ত শহরের রাস্তায় অবিশ্রান্ত চলা গাড়িগুলো দিনের পর দিন বাধ্য ছেলের মতো দাঁড়িয়ে আছে নিজেদের পার্কিং লটে।

আমার এক মার্কিন প্রতিবেশী যিনি রেন্টাল কারের কোম্পানিতে কাজ করেন তার কাছ থেকে জানতে পারলাম লকডাউনের জেরে এই সব কোম্পানি থেকে আজ গাড়ি ভাড়া নেওয়ার সংখ্যা খুব কম। একে কোম্পানির আয় কমেছে, তার উপর কোম্পানির নিজেদের এত গাড়ি পার্কিং করে রাখার জায়গার অভাবে নতুন করে পার্কিং স্পেস ভাড়া নিতে হচ্ছে, তার উপর আগে গাড়ি ভাড়া নেওয়াকালীন বিমার যে টাকাকে ক্রেতাকেই দিতে হতো এখন গাড়ি না চলার জন্য সেটা কোম্পানিকে দিতে হচ্ছে - তাই কোম্পানি সবদিকেই ক্ষতির মুখে পড়েছে। অনেক মানুষ যাঁরা দৈনিক পারিশ্রমিকে কাজ করেন তাঁরা ইতিমধ্যেই কর্মহীন হয়ে পড়েছেন এবং তারা সরকারের কাছে বেকারভাতার জন্য আবেদন করেছেন।

প্রায় দেড় মাস হয়ে গেছে আমার এই গৃহবন্দি দশা। আমি বাড়িটাকেই বানিয়ে নিয়েছি স্কুল, অফিস এবং রিক্রিয়েশনাল সেন্টারের বিকল্প হিসাবে। আশেপাশের সমস্ত পার্কের বেঞ্চগুলো বা বাচ্চাদের খেলার জায়গাগুলো সিল করে দেওয়া হয়েছে। সমস্ত স্কুলের মতোই আমার মেয়েরও অনলাইনে ক্লাস হচ্ছে, চলছে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গে গল্প, নানা ধরনের ইন্ডোর গেমস-এ এক বিরল দৃশ্য। এমনকি, আমরা বাঙালিরাও জুম বা স্কাইপে পালন করে ফেললাম ১৪২৭ এর বর্ষবরণ। ফলস্বরূপ আমাদের সবার "স্ক্রিন টাইম" অনেক বেড়ে গেছে। অনেক ইন্টারনেট প্রোভাইডার একই দামে ব্যান্ডউইডথ বাড়িয়ে আনলিমিটেড ডেটা সার্ভিস দিচ্ছে যার ফলে হয়তো কিছুটা স্বস্তি মিলেছে। শত্রু যখন অচেনা, তখন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়া কঠিন। বুঝতে পারছি এই লড়াই খুব স্বল্পস্থায়ী হবে না। এক অজানা আশঙ্কা প্রতিদিন তাড়া করছে। ভারত থেকে ঘনঘন উৎকণ্ঠা ভরা গলায় ফোন আসছে প্রিয়জনদের। তাই হয়ত নিজেকে মোটিভেট করার চেষ্টা করছি নিজের কিছু শখকে ঘিরে। এই পরিস্থিতি আমাকে শেখাল যে অবসরটা কেবলমাত্র ব্যস্ততার মাঝেই কাম্য এবং উপভোগ্য। আর বুঝলাম ধনী, দরিদ্র, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের ভেদাভেদ ফিকে হয়ে গিয়ে কোভিড-১৯ এর প্রকোপে বিশ্ববাসী ভবিষৎ চিন্তায় উদ্বিগ্ন।

প্রতিদিন সরকারি ওয়েবসাইটে ওহাইয়োর করোনা আক্রান্ত রোগীর পরিসংখ্যান অথবা আমেরিকায় মৃত্যু মিছিল দেখতে দেখতে আমরা যেমন আতঙ্কিত, তেমনি খানিক গা-সওয়াও হয়ে পড়েছি। শুনতে পাচ্ছি অর্থনীতিকে চাঙা করতেই লকডাউন উঠে যাবে ১ মে রাত ১২টার পর। জানি না গৃহবন্দি থাকার পর মুক্তির খবরে কেন ঠিক খুশি হতে পারছি না, কেন আতঙ্ক থেকেই যাচ্ছে, কেন মনে হচ্ছে আমরা যখন আবার প্রয়োজনে অথবা বিনোদনের জন্য সমবেত হব, তখন আরও কোনও বড় বিপদের মুখে পড়ব না তো? যে দেশে আক্রান্তের সংখ্যা এত বেশি, সেখানে লকডাউনের ছুটি আমাদের মানসিক শান্তি ফিরিয়ে দেবে তো? এই অনিশ্চিত, অস্থির ও ভয়াবহ পরিস্থিতিতে একটাই প্রার্থনা - "অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।"

সুদেষ্ণা বিশী, ক্লিভল্যান্ড

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus LockDown USA Cleveland
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy