প্রেমাংশু চৌধুরীর ‘হাতে রইলেন শ্যামাপ্রসাদ’ (১১-৬) নিবন্ধে লেখক বলেছেন, ‘‘আসলে বাঙালি যেমন নায়ক চায়, শ্যামাপ্রসাদ ঠিক তেমনই ছিলেন।’’ সত্যিই তাই? তা হলে তিনি কেন বাঙালির ইতিহাসে এক বিস্মৃত চরিত্রে পরিণত হলেন?
বাস্তবে বাঙালির নায়ক হতে হলে চরিত্রের যে মহত্ত্ব, স্বচ্ছতা, দৃঢ়চিত্ততা, সর্বোপরি মানুষের প্রতি গভীর ভালবাসা থাকা দরকার, সবগুলিরই অভাব ছিল শ্যামাপ্রসাদের মধ্যে। তিনি উচ্চশিক্ষিত, মেধাবী, আইনে পারদর্শী ছিলেন। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমন অজস্র মেধাবী ছাত্র প্রতি বছর বার হন, কেউ নায়ক হন না।
শ্যামাপ্রসাদের স্বল্পকালীন রাজনৈতিক জীবনে স্থিরচিত্ততার কোনও পরিচয় পাওয়া যায়নি। প্রথমে কংগ্রেস, তার পরে নির্দল, তার পরে আবার কংগ্রেস, তার পরে কৃষক প্রজা পার্টি-মুসলিম লিগ, তার পর নির্দল, তার পর হিন্দু মহাসভার পথ বেয়ে ভারতীয় জনসঙ্ঘে পৌঁছন তিনি। তাঁর রাজনৈতিক কার্যকলাপ তাঁকে শিক্ষিত বাঙালির ঘনিষ্ঠ হতে দেয়নি। ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী রাজনীতির পাশাপাশি ধর্মভিত্তিক রাজনীতির একটি স্রোত বাংলার রাজনীতিতে পাশাপাশি বইতে থাকলেও, তুলনায় তা ছিল খুবই শীর্ণ। অথচ শ্যামাপ্রসাদের হিন্দু মহাসভাই হোক কিংবা জনসঙ্ঘ, সেই রাজনীতিরই চর্চা করে গেছে।
বাংলার বিপ্লবী আন্দোলন, চিত্তরঞ্জন দাশ এবং সুভাষচন্দ্র বসুকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন খুবই গতি পেয়েছিল। তার প্রভাবে ব্যাপক সংখ্যায় সাধারণ মানুষও তাতে যোগ দিয়েছিলেন। অথচ দেশের হিন্দুত্ববাদী নেতারা এই আন্দোলনগুলি থেকে অতি সন্তর্পণে নিজেদের দূরে রেখেছিলেন। ১৯২১-’২২-এর অসহযোগ আন্দোলন থেকে শুরু করে ’৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলন, আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনা ও অফিসারদের বিচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ১৯৪৬-এর নৌবিদ্রোহ এবং ওই বছরের ২৯ জুলাই দেশব্যাপী ধর্মঘট— এ সবে এঁদের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা ব্রিটিশকে খুশি করেছিল।
হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির ব্রিটিশ প্রীতির তুলনায় মুসলিম লিগও পিছিয়ে ছিল না। হিন্দু মহাসভা মুসলিম লিগের সঙ্গে বাংলা, সিন্ধু ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে যুক্ত মন্ত্রিসভা গঠন করেছিল, যা এ রাজ্যে মুসলিম লিগের শক্তিবৃদ্ধিতে সাহায্য করেছিল। বিপরীতে হিন্দু মহাসভা তথা জনসঙ্ঘকে তার চড়া মূল্য দিতে হয়েছিল। বাস্তবে একটি সাম্প্রদায়িক সংগঠন হিসেবে জনসঙ্ঘ পুরোপুরি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। ১৯৫২ সালের নির্বাচনে জনসঙ্ঘ এ রাজ্যে ৪ শতাংশের কম ভোট পেয়েছিল। তার পর আর কোনও দিনই এই রাজনীতি এ রাজ্যে মাথা তুলতে পারেনি।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে শ্যামাপ্রসাদ উচ্ছৃঙ্খলতা আখ্যা দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘আমি মনে করি না, গত তিন মাসের মধ্যে যেসব অর্থহীন উচ্ছৃঙ্খলতা ও নাশকতামূলক কাজ করা হয়েছে, তার দ্বারা আমাদের দেশের স্বাধীনতা লাভের সহায়তা হবে’’ (রাষ্ট্র সংগ্রামের এক অধ্যায়: শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়)। কী কী ভাবে এই আন্দোলনকে দমন করা যায় তার একটা তালিকাও তিনি ব্রিটিশ সরকারকে দিয়েছিলেন।
সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে যখন আজাদ হিন্দ ফৌজ লড়ছিল, তখন শ্যামাপ্রসাদ ইংরেজ শাসকদের সহায়তা করার জন্য আগ বাড়িয়ে বলেছিলেন, ‘‘বঙ্গদেশকে রক্ষা করিবার জন্য একটি গৃহবাহিনী গঠনের অধিকার আমাদের দেওয়া হউক’’ (রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখিত ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’ গ্রন্থে উল্লিখিত শ্যামাপ্রসাদের পত্র থেকে উদ্ধৃত)। এ সবই ইতিহাস। বিজেপি নেতারা বাংলার মানুষকে এ সব ভোলাবেন কী করে?
বাস্তবে সারা দেশের মতো এ রাজ্যেও বিজেপির কোনও লোকমান্য নেতা নেই। তাই ইতিহাসের ধুলো ঝেড়ে শ্যামাপ্রসাদকে বের করে আনছেন এবং অনেক ইতিহাস গোপন করে প্রচারের ঝলকানিতে ধাঁধা লাগিয়ে দিয়ে তাঁকে লোকমান্য করে তুলতে চাইছেন।
সমরেন্দ্র প্রতিহার, কলকাতা-৪
অবশ্যই আইকন
‘হাতে রইলেন শ্যামাপ্রসাদ’ প্রবন্ধের শুরুতেই লেখক একটি উদ্ধৃতি দিয়েছেন, যেখানে আছে, ‘‘লক্ষ লক্ষ নরনারীর দীর্ঘ ব্যাকুল প্রতীক্ষান্তে মঙ্গলবার রাত্রি ৮-৫৫ মিনিটে ভারতের তেজোদৃপ্ত নেতৃত্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিগ্রহ ডাঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মরদেহ একখানি বিশেষ বিমানযোগে দমদম বিমানঘাঁটিতে উপনীত হইলে বিপুল জনারণ্যে এক মর্মস্পর্শী দৃশ্যের অবতারণা হয়।’’ অর্থাৎ স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে যে, শ্যামাপ্রসাদ সেই সময়কার রাজনীতিতে অত্যন্ত জনপ্রিয় এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন যাঁকে দেখতে লক্ষ লক্ষ মানুষ সমবেত হতে পারেন। তিনি তেজোদৃপ্ত নেতা ছিলেন, সুতরাং নিঃসন্দেহেই যুবসমাজের কাছেও ছিলেন এক আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। তখন তাঁর মতো এমন বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তি রাজনীতিতে ক’জনই বা ছিলেন! বা এখনও আছেন? তিনি একাধারে শিক্ষিত, মেধাবী, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বকনিষ্ঠ উপাচার্য, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে বাংলা ভাষায় ‘দীক্ষান্ত’ ভাষণের ব্যবস্থা করেছেন, অন্য দিকে পঞ্চাশের মন্বন্তরে ‘ত্রাণ সমিতি’ গঠন করে আর্ত, দুর্গতদের ত্রাণের ব্যবস্থা করেছেন দল নির্বিশেষে। আবার তিনি বাংলা ভাষার দুর্দিনে এ কে ফজলুল হকের সঙ্গে মিলে ‘বেঙ্গলি প্রোটেকশন লিগ’ তৈরি করে বাংলা ভাষার সপক্ষে প্রচার করেছেন এবং মুসলিম লিগের উর্দু ভাষার পক্ষে আগ্রাসী প্রচারকে প্রতিহত করেছেন। ১৯৪০-এর কলকাতা কর্পোরেশন নির্বাচনে মুসলিম লিগকে ঠেকাতে তিনি নেতাজির ফরওয়ার্ড ব্লকের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতায় আসার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু নেতাজি সুভাষ লিগের সঙ্গে ‘বসু-লিগ’ চুক্তি করায়, তা আর সম্ভব হয়নি। আবার তিনি রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পর, দেশভাগের কারণে উদ্বাস্তু সমস্যার সৃষ্টি হলে তিনি উদ্বাস্তু ত্রাণ এবং পুনর্বাসনে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁদের জন্য তিনি বাংলার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটে বেড়ান এবং তাঁদের সাহায্যার্থে বিভিন্ন কাজে আত্মনিয়োগ করেন সংসদে এবং সংসদের বাইরে। আবার ১৯৫১ সালের অক্টোবরে ‘ভারতীয় জনসঙ্ঘ’ গঠন করেই দু’মাসের মধ্যেই তাঁকে ১৯৫২ সালের প্রথম নির্বাচনে নামতে হয় প্রায় কোনও প্রস্তুতি ছাড়াই। কিন্তু তাঁর বিশাল জনপ্রিয়তার ফলে ওই নির্বাচনে তিনি কমিউনিস্ট নেতা সাধন গুপ্তকে পরাজিত করে দক্ষিণ কলকাতা থেকে নির্বাচিত হন এবং দলীয় সতীর্থ দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মেদিনীপুর থেকে জয়ী হয়ে সাংসদ হন। ওই নির্বাচনে মেদিনীপুর জেলা থেকে ৯ জন এমএলএ-ও নির্বাচিত হন। জম্মু ও কাশ্মীরের সম্পূর্ণ ভারতভুক্তির দাবিতে তাঁর আন্দোলনও বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। এমন ‘আইকন’কে ছেড়ে বিজেপিকে অন্য আইকন খুঁজতে হবে কেন ?
বিনয়ভূষণ দাশ, গোপজান, মুর্শিদাবাদ
ক্ষমতালোভী
“যদি পাকিস্তানে থাকতে চাও, তবে ব্যাগপত্তর গুছিয়ে এক্ষুনি ভারত ছাড়ো”— ১৯৪১ সালে ফেব্রুয়ারিতে আয়োজিত হিন্দু মহাসভার এক সমাবেশে মুসলমান সম্প্রদায়ের উদ্দেশে এ কথা বলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। উক্তির আশি বছর পূর্তিতে বাংলা দখলের জন্য বিজেপি-র আইকন তো তিনিই হতে পারেন যিনি সর্বদা ক্ষমতার অলিন্দে থেকেছেন সমগ্র জীবন।
কংগ্রেস কর্মী হিসেবে রাজনীতির সূত্রপাত। ১৯৩০-এ গাঁধীর সঙ্গ ত্যাগ। ১৯৩৭-এ নির্দল প্রার্থী হিসেবে আইনসভার সদস্য। ১৯৪১ সালে ফজলুল হক মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী। স্বাধীনতার পরও নেহরু মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মাইনর উইনার হয়তো ঠিকই বলেছিলেন, শ্যামাপ্রসাদ ছিলেন অত্যন্ত চতুর ও সুযোগসন্ধানী। রাজনৈতিক আদর্শ নয়, ছলে বলে কৌশলে ক্ষমতার অধিকারী হওয়া ছিল তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য।
১৯৪২-এ ভারত ছাড়ো ও আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হয় অার ২৬ জুলাই বাংলার গভর্নর জন হার্বার্টকে চিঠি লেখেন শ্যামাপ্রসাদ, “যুদ্ধ চলাকালে যদি কেউ জনতার আবেগকে উসকে দেওয়ার চেষ্টা করে, অভ্যন্তরীণ শান্তি ও নিরাপত্তার বিঘ্ন ঘটায়, সরকার যেন তার প্রতিরোধ করে।” এখানেই না থেমে আরও বলেন, “আপনাদের এক জন মন্ত্রী হিসেবে আমি পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছি।”
১৯৪৩ সালের অবিভক্ত বাংলার ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষের হাহাকারের মধ্যে হুগলির জিরাটে তাঁর প্রাসাদ নির্মাণ নিয়েও এক সময় লেখালিখি হয়েছে।
পার্থ প্রতিম কুণ্ডু, কলকাতা-৫৬
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy