‘রাষ্ট্রপুঞ্জে ভোট দিল না ভারত’ (২৭-২) সংবাদ অত্যন্ত দুশ্চিন্তার। রাশিয়া-বিরোধী ভোট দিলে ভারতের কী এমন ক্ষতি হত? যদিও ভোট দানে বিরত থাকার মানে যুদ্ধকে সমর্থন করা নয়, তা সত্ত্বেও বলব রাশিয়ার আগ্রাসন সম্পূর্ণ অনৈতিক। তাই ভারতের কণ্ঠস্বর এখনই ঘোষিত হলে ভাল হত। ভারত যে ভাবে ভোট না দিয়ে সরে দাঁড়াল, তাতে যুদ্ধের পক্ষে, না কি বিপক্ষে— সে কথা বোঝা গেল না। অথচ, সগর্বে মাথা উঁচু করে যুদ্ধবিরোধী কথা বলার প্রয়োজন ছিল বইকি! কারও কোনও চাপের কাছে নতিস্বীকার করা নয়, বোঝা যেত।
রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ অমানবিক, অসংযমী, এবং দুর্বলের প্রতি সবলের মারাত্মক আঘাত। এর বিরোধিতা করার মহৎ কাজটি ভারত কেন করল না এই ভয়ঙ্কর অবস্থায়? গান্ধীজির ভারত কিছুতেই রাশিয়ার আগ্রাসী হিংসার মনোভাবকে সমর্থন করে না। মধ্যবর্তী অবস্থান নিয়েও ভারত কিন্তু এই যুদ্ধ বিরোধিতায় প্রধান ভূমিকা নিতে পারত। এতে ভারতের নিরপেক্ষতাটি বজায়
থাকল না।
ইউক্রেনে অসংখ্য ভারতীয় বসবাস করছেন, তার মধ্যে কয়েক হাজার বাঙালিও আছেন। আগেভাগেই তাঁদের বিশেষ বিমানে করে নিয়ে আসা খুবই দরকার ছিল। সে কাজে ভারত অনেক দেরি করে ফেলেছে! এখানেই আক্ষেপ। কূটনৈতিক চাল সবার আগেই দিয়ে দেওয়া উচিত ছিল।
বিবেকানন্দ চৌধুরী, কাটোয়া, পূর্ব বর্ধমান
পুতিনের উচ্চাশা
যুদ্ধের আগুনে পুড়ছে ইউক্রেন। টিভির পর্দায় একের পর এক শহরে ধ্বংস, আগুন ও ধোঁয়ার ছবি। ইউক্রেনের পথে রুশ ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া বাহিনী, আকাশে রুশ বোমারু বিমানের ঝাঁক। জনসাধারণ মেট্রো স্টেশনে, বাঙ্কারে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন মুখে বলছেন, অসামরিক এলাকায় আক্রমণ করা হবে না। বাস্তবে কিছু বাদ যাচ্ছে না— আবাসিক এলাকা ও স্কুলবাড়িতেও বোমা পড়ছে। ইউক্রেনের ডনেৎস্ক অঞ্চলে এক শিক্ষাকর্মীর নিথর দেহ, পোল্যান্ড-ইউক্রেন সীমান্তে ক্রন্দনরত শিশু, কিভে রুশ ক্ষেপণাস্ত্রে রক্তাক্ত মহিলা, অসংখ্য আহতের উদ্ধারের ছবি দেখতে দেখতে প্রশ্ন জাগছিল, রুশ সাম্রাজ্যবাদের উত্তরাধিকার-বহনকারী, ও অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে তেমন সাফল্য না থাকলেও ‘বিশ্ব রাজনীতিতে সর্বোচ্চ স্থান’ জয়ের অভিলাষী ভ্লাদিমির পুতিনের এক অবিমৃশ্যকারী সিদ্ধান্তের ফলে আর কত নিরীহ মানুষের প্রাণহানি ঘটবে?
সম্পাদকীয় নিবন্ধে যথার্থই বলা হয়েছে যে, “...পুতিন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ ঘোষণা করিয়াছেন, তাহাতে একযোগে বিপন্ন হইতে পারে অনেক দেশ— সম্ভবত গোটা পৃথিবীই। এই অভিযান কেবল একটি দেশের বিরুদ্ধে আগ্রাসন নহে, সমগ্র বিশ্বের নিরিখেই অপরাধ।” (‘পুতিনের অভিযান’, ২৫-২)। যদিও জাতীয়তাবাদ ও স্বাধীনতায় দৃঢ়বিশ্বাসী ইউক্রেন ঘোষণা করেছে তারা মাথা নত করবে না, তবু এই অসম যুদ্ধ ইউক্রেন একক ভাবে কত দিন চালাতে পারবে? আরও একটি বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কাও অসঙ্গত নয়, যদি আমেরিকা ও তার সহযোগী নেটোভুক্ত দেশগুলি ইউক্রেনের সমর্থনে সামরিক পদক্ষেপ করে। রাষ্ট্রপুঞ্জ আগ্রাসী আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে কার্যত অসহায়, নিকট অতীতেও তা দেখা গিয়েছে। এ বারও নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিন্দাপ্রস্তাব খারিজ হয়ে গিয়েছে রাশিয়ার নিজের ভেটোতেই।
কমিউনিস্ট রাষ্ট্রও যে সাম্রাজ্যবাদী হতে পারে, ‘জাতীয় স্বার্থে’ পড়শি দেশের ভূখণ্ড, বা সম্পূর্ণ দেশটাকেই গ্রাস করতে কূটকৌশল বা সামরিক অভিযান করতে পারে, তা বিশ্ববাসী ইতিমধ্যেই প্রত্যক্ষ করেছে। ইউক্রেনের এই অসম প্রতিরোধ যেন স্মরণ করিয়ে দেয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ফিনল্যান্ডের লড়াই। বেয়াড়া ফিনল্যান্ডকে শায়েস্তা করতে ৩০ নভেম্বর, ১৯৩৯ জল ও বিমান পথে সোভিয়েট ‘মুক্তিফৌজ’ ঝাঁপিয়ে পড়ে। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ছোট্ট সে দেশের সেনাবাহিনী অন্য কোনও দেশের সাহায্য না পাওয়ায় প্রায় সাড়ে তিন মাস লড়াই চালানোর পর সন্ধিচুক্তি করতে বাধ্য হয়। এ ছাড়াও বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভের আগেই স্তালিনের রাশিয়া সহজেই গায়ের জোরে দখল করে নিয়েছিল লিথুয়ানিয়া, লাটাভিয়া, এস্টোনিয়া। অজুহাত, এগুলি এক সময় প্রাচীন রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। অন্য দিকে মলোটভ-রিবেনট্রপ চুক্তির বলে জার্মানি ও সোভিয়েট রাশিয়া আক্রমণ করে পোল্যান্ডকে, নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। পুতিনের এখনকার হাবভাব দেখেও মনে হচ্ছে তিনি যেন অখণ্ড সোভিয়েট ভূমির স্বপ্ন দেখছেন। ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে বহু পুরনো বৈরিতা থাকলেও বর্তমান বিরোধের মূল কারণ ইউক্রেনের উত্তর অতলান্তিক নিরাপত্তা বা নেটোর সদস্য হওয়ার অভিপ্রায়। ইতিমধ্যেই পূর্বতন সোভিয়েটের অন্তর্ভুক্ত ও বর্তমান রাশিয়ার সীমান্তবর্তী পাঁচটি দেশ নেটো জোটে যুক্ত হয়েছে, কিংবা নিজেদের নেটোগোষ্ঠীর বন্ধুরাষ্ট্র বলে দাবি করেছে, যাকে রাশিয়া তার সীমান্তে নেটোর শক্তিবৃদ্ধি বলে গণ্য করছে। এই পরিস্থিতিতে ইউক্রেনের নেটো জোটে যোগদানকে রাশিয়া তার নিরাপত্তার পক্ষে এক বড় বিপদ জ্ঞান করছে। কিন্তু ইউক্রেন নেটোতে যোগদানে অনড় থাকায় রাশিয়া গত কয়েক মাস ধরেই ইউক্রেন সীমান্তে ও কৃষ্ণসাগরে সমর প্রস্তুতি নিয়েছিল। তার পর এই অভিযান।
তবে উল্লেখ্য, ভারতের বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের নীরবতা। এ রাজ্যের বিপ্লবী ছাত্র সংগঠনগুলিও এখন ‘কলরব’ করা থেকে বিরত।
শান্তনু রায়, কলকাতা-৪৭
ভারতের নীতি
রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ ভারতের জন্য বিশেষ কোনও বার্তা বয়ে আনছে কি? অবশ্যই আনছে। প্রথমত, বিগত দেড়-দু’বছর ধরে এলএসি জুড়ে চিনের গতিবিধি সুবিধার ঠেকছে না। ভারত-সীমান্ত বরাবর গড়ে তোলা হচ্ছে একের পর এক স্থায়ী পরিকাঠামো। চিনের তরফে বার বার ঘটছে সীমান্ত লঙ্ঘনের ঘটনা। চিনের এই সামরিক আগ্রাসনের প্রেক্ষিতে আমেরিকা দু’একটি দায়সারা বিবৃতি দেওয়া ছাড়া কিছুই করেনি। অরুণাচল প্রদেশ ও সিকিমের কিছু অংশের দাবি নিয়ে গোঁ ধরে বসে থাকা চিন যদি সত্যিই ভারত আক্রমণ করে বসে, তা হলে আমেরিকা সর্বশক্তি দিয়ে ভারতের পাশে দাঁড়াবে, এ কথা ভাবার জায়গা বোধ হয় আর নেই। প্রতিরোধ, প্রত্যাঘাত যা করার আমাদেরই করতে হবে। দ্বিতীয়ত, করোনাকালে প্রত্যেকটি দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমেরিকাও ব্যতিক্রম নয়। এই অবস্থায় আমেরিকা নিজের অর্থ, অস্ত্র ও সেনাবল নিয়ে পরের মোষ কতটা তাড়াবে, তা এখন লাখ টাকার প্রশ্ন।
তৃতীয়ত, ইউক্রেন নিয়ে আমেরিকার অবস্থান দক্ষিণ চিন সাগরে চিনা আগ্রাসন ঠেকাতে তৈরি ‘কোয়াড’ ভুক্ত দেশগুলির মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি করবে। প্রশ্ন তৈরি হবে আমেরিকার নেতৃত্ব, সদিচ্ছা ও কৌশল নিয়ে, যা চিনকে আরও বেশি আগ্রাসী করবে। চতুর্থত, চিন যদি এ বার তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, জাপান, ফিলিপিন্সের সঙ্গে সংঘাতে আরও বেশি করে জড়িয়ে পড়ে, আর আমেরিকা যদি কাগুজে বিবৃতি ও বিধিনিষেধের ঘেরাটোপে আটকে থাকে, তবে তা চাপ ফেলবে ভারতের অর্থনীতি ও সুরক্ষার উপরেও। তাই এই মুহূর্তে বিদেশনীতিতে নমনীয়তা ও ভারসাম্য বিশেষ জরুরি। চাই পরিস্থিতির নিবিড় পর্যবেক্ষণ, বহুমাত্রিক পর্যালোচনা ও বাস্তবোপযোগী নীতির নির্মাণ।
পলাশ মান্না, সবং, পশ্চিম মেদিনীপুর
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy