‘শূন্যের ঢেউ’ (১৮-৯) শীর্ষক সম্পাদকীয়তে রাজ্যে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীদের অনাগ্ৰহের বিষয়টি যথার্থ ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। কয়েক বছর ধরেই স্নাতক স্তরে অনার্স ও পাসকোর্স— উভয় ক্ষেত্রেই বহু কলেজে অনেক আসন শূন্য থেকে যাচ্ছে। সংস্কৃত, দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি প্রভৃতি বিষয়ে আবার অধিক আসন শূন্য থাকছে। অতিমারির পর থেকেই এই সঙ্কট তীব্র হয়েছে। এ দিকে বিদ্যালয় স্তরেও নবম শ্রেণি থেকে স্কুলছুট হওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। বেশ কয়েক জন পড়ুয়া ‘সবুজসাথী’র সাইকেল পাওয়ার পর বিদ্যালয়-ছুট হয়েছে। আর মেয়েদের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ‘কন্যাশ্রী’-র আর্থিক সহায়তার জন্য অপেক্ষা করেছে অনেকে।
লক্ষ করা যাচ্ছে, সাধারণ ভাবে অনেক ছাত্রছাত্রীর মধ্যে শিক্ষার প্রতি অনাগ্ৰহ বাড়ছে। এর কারণ শুধু অর্থনৈতিক সঙ্কট নয়। চার পাশে তারা যখন দেখছে, উচ্চশিক্ষা লাভ করেও কর্মসংস্থানের সুযোগ না পেয়ে ঘরে ঘরে বেকার ছেলেমেয়েদের ভিড়, তখন এদের অনেককেই গ্ৰাস করছে হতাশা। দ্বিতীয়ত, পরিবারের আর্থিক সঙ্কটের ফলে বহু ছাত্রছাত্রী মাঝপথে স্কুল-কলেজ ছেড়ে রোজগারের তাগিদে নানা কাজে যুক্ত হচ্ছে। তৃতীয়ত, বর্তমানে পড়াশোনার জন্য সরকারি স্কুল-কলেজে খরচ খুবই কম, কিন্তু প্রাইভেট টিউশন ছাড়া কেউ পড়াশোনা চালাতে পারে না। এর খরচ বহন করার ক্ষমতা অনেক পরিবারের নেই।
উচ্চশিক্ষায় অনাগ্ৰহ বাড়ার ক্ষেত্রেও উপরোক্ত কারণগুলির পাশাপাশি রয়েছে বৃত্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থার অভাব ও সর্ব স্তরে দুর্নীতি সমস্যা। এই সব সামাজিক সঙ্কটের কুপ্রভাবে বিচলিত ও অস্থির হয়ে উঠছে পড়ুয়ারা। কর্মসংস্থানমুখী বৃত্তিমূলক শিক্ষার উপরে জোর দেওয়া এবং উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়েদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধির দিকে সরকার যদি মনোযোগী না হয়, তবে আগামী দিনে এক গভীর সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হবে।
সন্দীপ সিংহ, হরিপাল, হুগলি
আসন খালি
‘শূন্যের ঢেউ’ সম্পাদকীয়টি চিন্তার উদ্রেক ঘটায়। লেখা হয়েছে, ‘বাংলার উচ্চশিক্ষায় যেন ভাটার টান। চলতি বছরে এ রাজ্যের কলেজগুলিতে বিজ্ঞানের মূল বিষয়, দর্শন, এমনকি অর্থনীতিরও এক বিপুল সংখ্যক আসন শূন্য পড়ে আছে।’ এর পরিপ্রেক্ষিতে জানাই, বেসরকারি এঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলিতে পড়ুয়ার সংখ্যায় ভাটা আগেই পড়েছিল। ২০১৮ সালের একটা পরিসংখ্যান বলছে, যাদবপুর, কলকাতা, কল্যাণী, মাকাউট মিলিয়ে ফাঁকা আসনের সংখ্যাটা বিশাল। প্রবন্ধে বর্ণিত বিষয়গুলি ছাড়া এ বছর পশ্চিমবঙ্গে অধিকাংশ কলেজে বাংলা, উদ্ভিদবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, গণিতের মতো বিভাগে আসন ফাঁকা পড়ে আছে।
কোভিড-পরবর্তী সময়ে দেখা গিয়েছে, শিক্ষার উন্নতির জন্য প্রাণপাত করে বাড়ি বাড়ি ঘুরে মাস্টারমশাইরা স্কুলছুট ছেলেমেয়েদের আবার স্কুলে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। যারা পোর্টালে রেজিস্ট্রেশন করিয়েও আর ভর্তি হয়নি, তাদের বাড়িতে চিঠি পাঠিয়ে কিংবা টিম তৈরি করে তাদের কাছে গিয়ে জানা দরকার, কেন উচ্চশিক্ষায় তাদের এই অনীহা। পড়ুয়াদের পরিস্থিতি অনুযায়ী যথাযথ সাহায্য করুক সরকার। যদি মেধা অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, তবে সরকার তাদের প্রযুক্তিগত শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ব্যবস্থা করুক। বাংলার বহু মেধাবী ছেলেমেয়ে এখন বিদেশে সফল ব্যবসায়ী। তাঁদের কাছে এ দেশে পিপিপি মডেলে প্রযুক্তিগত শিক্ষা দেওয়ার জন্য কেন্দ্র গড়ে তোলার প্রস্তাব রাখুক সরকার। তাঁদের কাছে দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা আশা করাটা কোনও অন্যায় চাহিদা নয়। তা ছাড়া ওঁদের ব্যবসার ক্ষেত্রেও এ তো লোভনীয় প্রস্তাব।
প্রসঙ্গত, এমন অনেক কাজ আছে, যেগুলি কারিগরি শিক্ষার আওতায় পড়ে। যেমন, ফ্রিজ, গিজ়ার, টিভি সারানোর মিস্ত্রি, প্লাম্বার বা ইলেকট্রিশিয়ান ইত্যাদি। এমনকি কলকারখানায় কাজ বা ওয়েল্ডিংয়ের মতো কাজও এই শিক্ষার আওতায় রয়েছে। এ ক্ষেত্রে থিয়োরিটিক্যাল জ্ঞানের চেয়ে হাতে-কলমে কাজের দক্ষতার বেশি প্রয়োজন হয়। কিন্তু দরকার পড়লে প্রয়োজনের তুলনায় এঁদের কমই খোঁজ পাওয়া যায়। আমাদের সমাজে যে-হেতু এই সব কাজের সে ভাবে কোনও স্বীকৃতি নেই, তাই সুযোগ থাকলেও অনেকেই এই ধরনের কাজ থেকে দূরে থাকেন। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই অদক্ষদের দিয়ে কাজ চালাতে হয়। এই সব কাজকেও যদি সমাজে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তা হলে আগামী দিনে অবশ্যই এ সব ক্ষেত্রে দক্ষ কর্মীর সংখ্যা বাড়বে। সে ক্ষেত্রে শহরে এবং গ্রামের প্রতি এলাকায় লোকসংখ্যা অনুযায়ী দক্ষ শ্রমিক-সম্বলিত চ্যানেল খোলা যেতে পারে। এরা মালিক এবং গ্রাহকের কাছ থেকে চুক্তিভিত্তিক মজুরি আদায় করবে। এ ভাবে বহু মানুষের অন্ন-সংস্থান হবে।
অন্য দিকে, দেশের ভাল ছেলেমেয়েগুলো উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি দিচ্ছে বিদেশে। এবং পরে সেখানেই থেকে যাচ্ছে। এর কারণ হল, আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষা-অন্তে উপযুক্ত কর্মসংস্থান নেই তাদের কাছে। এটাই যদি সত্যি হয় তবে শুধু নতুন শিক্ষানীতি চালু করে কিছু হবে না। বরং শিক্ষাক্ষেত্রের উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে তুলুক সরকার। কারণ, উপযুক্ত শিক্ষা ছাড়া কোনও দেশ এগোতে পারে না।
সোমনাথ মুখোপাধ্যায়, কলকাতা- ৫৭
অন্যায়ের বিচার
‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ আন্দোলনে কোনও সর্বোচ্চ নেতা নেই। সেটাই এর প্রচণ্ড শক্তির উৎস। ডাক্তারদের আন্দোলন হিসাবে শুরু হলেও, এটা বদলে গিয়েছে এক অভাবনীয় সামাজিক আন্দোলনে। স্লোগানে, পোস্টারে, ব্যানারে, গানে, নাটকে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ‘তিলোত্তমা’-র যন্ত্রণা। প্রতি দিন প্রতি মুহূর্তে গড়ে উঠছে আন্দোলনের নিত্যনতুন স্লোগান, যা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ঠিক করছে জনতা। পশ্চিমবঙ্গে তথা ভারতে অনেক অন্যায়ের বিরুদ্ধে বহু আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে। কিন্তু ‘তিলোত্তমা’-র ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে সামাজিক দ্রোহ শুরু হয়েছে এবং বেড়ে উঠছে, তা অভূতপূর্ব। সমাজমাধ্যমে ছোট্ট একটা ঘোষণাকে কেন্দ্র করে, এক রাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ পথে নেমে সারা রাত জেগেছিলেন। যাঁরা জীবনে কখনও মিছিলে হাঁটেননি, তাঁরাও নেমেছিলেন পথে।
আমরা সকলেই দেখতে অভ্যস্ত কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের আন্দোলন। আগে নেতৃত্ব পরিকল্পনা করেন, পরে সেই অনুযায়ী আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা হয়। ‘আমরা বিচার চাই’ আন্দোলন কিন্তু গড়ে উঠছে, শক্তিশালী হয়ে উঠছে এবং বিস্তার লাভ করছে ঠিক বিপরীত ব্যাকরণ মেনে। পছন্দসই ‘তত্ত্ব’ অনুযায়ী আন্দোলনের পথ ও পদ্ধতি ঠিক করা নয়, প্রতি দিন আন্দোলন থেকে ঠিক হচ্ছে পরবর্তী পদক্ষেপের পরিকল্পনা। ডাক্তার, নার্স, ছাত্রছাত্রী থেকে গৃহবধূ, রিকশাওয়ালা, বিজ্ঞানী, হকার, ইঞ্জিনিয়ার, অবসরপ্রাপ্ত সেনা আধিকারিক, গৃহপরিচারিকা, স্কুলশিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক— কারা নেই সমর্থক ও সহযোগীদের দলে? এই ‘অসংগঠিত আন্দোলন’ বার বার আমাদের শিখিয়ে দিচ্ছে আন্দোলনের নতুন পথ ও পদ্ধতি। বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে, জনতাই আসল শক্তির উৎস। ভাবতে শেখাচ্ছে অনেক নতুন কিছু।
প্রশাসন কল্পনাই করতে পারছে না এই আন্দোলনের শক্তি ও সম্ভাবনা। হুমকি, মিথ্যাচার, ভীতিপ্রদর্শন ইত্যাদি অসামাজিক পদ্ধতিতেই তারা মোকাবিলা করতে চাইছে এই বলিষ্ঠ আন্দোলনকে। কিন্তু প্রতিস্পর্ধী আওয়াজ উঠছে, “কণ্ঠ যতই করবে রোধ, বাড়বে ততই প্রতিরোধ।” কলকাতা মহানগরীর বুকে এই আন্দোলন শুরু হলেও, ক্রমশ তা ছড়িয়ে পড়ছে দূর থেকে দূরান্তে। শুধু ‘জাস্টিস ফর আর জি কর’ না, একই সঙ্গে দাবি উঠছে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। বিচার শুধুমাত্র ‘তিলোত্তমা’-কাণ্ডের না। বিচার সকল সামাজিক অন্যায়ের।
দীপক পিপলাই, কলকাতা-৮
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy