সম্পাদকীয় ‘লাঠি ও গাজর’ (৯-১০) সময়োচিত প্রবন্ধ। কিছু ভাবনা সংযোজন করার উদ্দেশ্যে এই পত্রের অবতারণা। দুর্গাপুজোয় প্রদত্ত সরকারি অনুদানের সঙ্গে পুজোর আদৌ কোনও সম্পর্ক আছে কি না, সে সম্পর্কে জনমানসে খুব একটা স্পষ্ট ধারণা নেই। এমনকি সংবাদমাধ্যমেও তা যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে কখনও বলা হয়নি। অথচ প্রকৃত সত্যটা হল, দুর্গাপুজোয় দেওয়া সরকারি অনুদানের সঙ্গে পুজোর কোনও সম্পর্ক নেই। কলকাতা উচ্চ আদালতের নির্দেশ অনুসারে, সরকারি অনুদান পুজোর কোনও কাজে ব্যবহার করা যাবে না। অর্থাৎ, এই অনুদান পাওয়ার শর্ত হল প্রতিমার মূল্য, দশকর্মা, ফল-ফুল, ঢাকির খরচ, আলোকসজ্জা ইত্যাদি কাজে এই অর্থ ব্যয় করা যাবে না। কেবল সাধারণ মানুষের স্বার্থে কিছু কার্যক্রম নেওয়া যেতে পারে।
তলিয়ে ভাবলে দেখা যায়, দুর্গাপুজোর নাম করে দেওয়া সরকারি অনুদান এক ধরনের প্রতারণা। তা সত্ত্বেও শাসক দল আনুগত্য আদায়ের উপায় হিসাবে ২০১৮ সাল থেকে সরকারি অনুদানের এই গাজর ব্যবহার করে চলেছে। ২০১৮ সালে ২৮ হাজার ক্লাবকে দুর্গাপুজোর জন্য ১০ হাজার টাকা সরকারি অনুদান দিয়ে শুরু হয়েছিল প্রলোভন দেখানো। তার সঙ্গে উপরি হিসাবে ছিল বিদ্যুৎ, দমকল ও অন্যান্য পুরকরে ছাড়ের ব্যবস্থা। এ বার অনুদানের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ৮৫ হাজার টাকা। ক্লাবের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৪৩ হাজার। অনুদান বাবদ সরকারি খরচ ২৮ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ৩৪০ কোটি টাকা। এর সঙ্গে অন্যান্য ছাড় তো আছেই। নাগরিকের করের টাকা এ ভাবে খরচ করা নাগরিকের কাছে যতই যুক্তিহীন অপব্যয় মনে হোক না কেন, শাসক দলের কাছে তা নয়। কারণ বিগত কয়েকটি নির্বাচনে এই প্রকল্পের ‘সাফল্য’ বারংবার প্রমাণিত হয়েছে।
সঙ্গত কারণে সরকারি অনুদানের এই ‘গাজর’, এই আনুগত্য আদায়ের চেষ্টা যে অসম্মানের, এটা বুঝতে পেরে যে সমস্ত পুজো কমিটি মাথা উঁচু করে সরকারি অনুদান প্রত্যাখ্যান করার কথা ঘোষণা করেছে, তাদের উপর নেমে এসেছিল অলিখিত বিধিনিষেধ। হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল, অনুদান প্রত্যাখ্যান করলে মিলবে না বিদ্যুতে ছাড়, দমকল পরিষেবায় ভর্তুকি। এই হল ভীতিপ্রদর্শনের অভ্যাস বা ‘থ্রেট কালচার’। অনুদান নিতে অস্বীকার করে সরকারি খরচ বাঁচিয়ে দিলেও শাসক হয়তো এটাকে বিদ্রোহ হিসাবে দেখেছে। ভীতিপ্রদর্শন এখানেই থেমে থাকেনি। যাঁরা আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে মিছিল-সমাবেশ করেছেন, সেই সব ছাত্রছাত্রী তরুণ-তরুণীকে মামলায় জড়িয়ে দিয়েছে পুলিশ। এই ভয় দেখানোর সংস্কৃতি নতুন নয়। ২০১২ সালে তার শিকার হয়েছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র ও তাঁর প্রতিবেশী সুব্রত সেনগুপ্ত। ব্যঙ্গচিত্র-কাণ্ডে মুখ্যমন্ত্রীর সম্মানহানির অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল তাঁদের ।
অজয় ভট্টাচার্য বনগাঁ, উত্তর ২৪ পরগনা
যারা অনিচ্ছুক
‘লাঠি ও গাজর’ শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা। প্রথমত, রাজ্য সরকারের ৮৫,০০০ টাকা অনুদানে উচ্ছ্বসিত পুজো কমিটিগুলো! ফি-বছরের মতো এ বছরও অধিকাংশ পুজো কমিটি আশপাশের এলাকা থেকে চাঁদা সংগ্রহের পাশাপাশি রাজ্য সরকারের অনুদান নিয়েছে। দ্বিতীয়ত, যারা অনুদান নিতে অনিচ্ছুক ছিল, বলা হয়েছিল তারা বিদ্যুতে ছাড়, বা দমকল পরিষেবায় ভর্তুকি পাবে না। প্রশ্ন ওঠে, অনুদান বা বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের সুযোগ-সুবিধা নেওয়াটা কি বাধ্যতামূলক? অনুদান ও আনুগত্য কি একে অপরের পরিপূরক? নাগরিকের মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ কেন? অনুদানে অনিচ্ছুক পুজো কমিটিগুলোকে হমকি-প্রথার আওতায় না এনে বরং তাদের পুরস্কৃত করাই সঠিক সিদ্ধান্ত হত! গাজরের হালুয়া সুস্বাদু, কিন্তু লাঠির আঘাত বড় বেদনাদায়ক।
অমরেশ পাল ব্যান্ডেল, হুগলি
ভরসা আদালত
‘লাঠি ও গাজর’ শীর্ষক সম্পাদকীয়ের সঙ্গে সহমত। আজ রাজ্যবাসীরও একান্ত অনুভব যে, রাজ্যের শাসক দল আনুগত্য আদায়ের উপায় হিসাবে ‘পুলিশের লাঠি আর সরকারি অনুদানের গাজর’কে ব্যবহার করতে বদ্ধপরিকর। এ ছাড়াও আছে পারিতোষিক বিতরণ, কোনও সরকারি প্রতিষ্ঠান বা কমিটির শীর্ষপদে মনোনয়নের বিনিময়ে আনুগত্য আদায়ের কৌশল। আর জি কর কাণ্ডে শীর্ষ আদালতের বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ ও ভর্ৎসনার পরও রাজ্য প্রশাসনের হুঁশ কবে ফিরবে, তা অনিশ্চিত। কারণ তা প্রশাসনের শীর্ষ স্তরের সুমতি ও সদিচ্ছার উপর নির্ভরশীল। এই ঘটনার অভিঘাত বুঝতে অনিচ্ছুক শাসক দলের কিছু মন্ত্রীসান্ত্রি প্রকাশ্য সভা-সমিতিতে ন্যায়বিচারের দাবিতে পথে নামা প্রতিবাদীদের প্রতি হুঙ্কার দিয়েছেন। আশঙ্কা জাগে, এটাই তবে এ রাজ্যের গণতন্ত্র! একটি নির্মম ও নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পরও শাসক দুঃখিত, লজ্জিত না হয়ে ঘটনার ন্যায়বিচারের দাবিদার প্রতিবাদীদের আক্রমণ করে যাচ্ছেন লজ্জাহীন ভাবে। ও দিকে নিজের প্রশাসনের সার্বিক ব্যর্থতা ও অন্যায় ঢাকতে প্রশাসনিক প্রধান মঞ্চে ‘ফাঁসি চাই’ স্লোগান তুলেছেন, আর দলের অন্যতম শীর্ষ নেতা অপরাধীকে এনকাউন্টারে খতমের নিদান দিয়েছেন। সস্তা চমকে সাধারণ মানুষের হাততালি পাওয়াই সেখানে লক্ষ্য। প্রশাসনিক পঙ্গুতা ও অকর্মণ্যতা থেকে দৃষ্টি ঘোরানোর কৌশলও হতে পারে। ইতিমধ্যে প্রকাশ পাচ্ছে মেডিক্যাল কলেজগুলিতে গজিয়ে ওঠা দুষ্টচক্রের, যা হুমকি-প্রথার মাধ্যমে ডাক্তারি পড়ুয়াদের নিজেদের তাঁবে এনে হাসপাতালে দুর্নীতির মুক্তাঞ্চল তৈরির কাজে বহু দিন ধরে ব্যাপৃত।
এই প্রসঙ্গেই উল্লেখ্য, ‘নবান্ন চলো’ অভিযানের রাতে এক বৈদ্যুতিন চ্যানেলের অফিস থেকে বেরোনোর পরই ছাত্রসমাজের পক্ষে ‘নবান্ন চলো’ ডাকের অন্যতম আহ্বায়ক ছাত্রনেতাকে গ্রেফতার করা হল। হাই কোর্টের আদেশে তাঁর মুক্তির পর জনগণের করের টাকা ব্যয় করে নামীদামি আইনজীবী নিয়োগ করে রাজ্য প্রশাসন সুপ্রিম কোর্টে তাঁর জামিন খারিজ করতে গেলেও রাজ্যের মুখ আবার পোড়ে। অতঃপর শাসক দলের নেতার পেশ করা একটি অডিয়ো ক্লিপে কথোপকথনের ভিত্তিতে চিকিৎসকদের ধর্নায় হামলা চালানোর ‘ষড়যন্ত্র’-এর অভিযোগে গ্রেফতার করা হল এক রাজনৈতিক দলের যুব নেতাকে। যদিও হাই কোর্টের আদেশে ইতিমধ্যে তাঁর জামিনে মুক্তি মিলেছে, পেয়েছেন প্রয়োজনীয় রক্ষাকবচও। এই মামলায় জামিন মঞ্জুরকালে মাননীয় বিচারপতির পর্যবেক্ষণ, পুলিশের আচরণের ফলে এক ব্যক্তিমানুষের সাংবিধানিক অধিকার খর্ব হয়েছে। দুষ্টের পালন, শিষ্টের দমন, এই যেন এখন ‘রাজধর্ম’। নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে অনিচ্ছুক সুরক্ষাবাহিনী রাজনৈতিক প্রভুদের তুষ্ট রাখতে তৎপর। তারা প্রতিবাদীদের লাঠিপেটা করে, আর শাসক দলের মাতব্বরদের হামলায় ফাইলের আড়ালে আশ্রয় নেয়। রাজনৈতিক গুন্ডাদের হাসপাতাল আক্রমণ ও ভাঙচুরের সময়ও নির্বিকার দর্শকের ভূমিকা পালন করে।
অতএব প্রতিবাদ দমন করতে প্রতিহিংসাপরায়ণতা। প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করতেও যে অতি তৎপর অসহিষ্ণু রাজ্য প্রশাসন, তারই সাম্প্রতিকতম নিদর্শন পুজোমণ্ডপের সামনে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগান দেওয়ার ‘অপরাধ’-এ কতিপয় তরুণ-তরুণীকে গ্রেফতার। যদিও পরে আদালতের নির্দেশে তাঁরা জামিন পেয়েছেন।
এই পরিস্থিতিতে মানুষের অন্তিম আশা-ভরসা আদালত। বিচারব্যবস্থা সক্রিয় ও নির্ভীক না হলে এ রাজ্যের পক্ষে বড় দুর্দিন। ভারতের বিচারব্যবস্থা নিঃসন্দেহে স্বাধীন, নিরপেক্ষ, ও যথেষ্ট শক্তিশালী। গণতন্ত্রের বনিয়াদ মজবুত করতে, এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে, স্বাধীন বিচারব্যবস্থার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
শান্তনু রায় কলকাতা-৪৭
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy