‘কলকাতার কড়চা’য় (৭-৮) শান্তিপুরের প্রতিভাময়ী শিল্পী সীমা সেনের সূচিশিল্প সাধনার কথা প্রকাশ পেয়েছে। প্রসঙ্গত, আগে শুধুমাত্র বিবাহের সময়ে কন্যার যোগ্যতা নির্ধারণের জন্যই নয়, বাড়ির মহিলারা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়েই এই শিল্পকর্মটি অনুশীলন করে যেতেন। শীতের দিনে পশমের সোয়েটার বোনা, রঙিন সুতো দিয়ে চটের টুকরোর উপর নকশা বুনে বসার আসন তৈরির পাশাপাশি অনেকে কাপড়ের উপর রঙিন সুতোর নকশা তুলে কাঁথা তৈরি করতেন।
একান্নবর্তী পরিবারে বড় হয়ে ওঠা মানুষজনের স্মৃতিতে এখনও উজ্জ্বল, সেই সব দিনে মা-পিসিমাদের শখ হিসেবে থাকা এই শিল্পকর্মের কথা। গাছের নীচে দু’টি হরিণ আর নীচে লেখা “সোনার হরিণ কোন বনেতে থাকো?” বা কয়েকটি ফুলের ছবির সঙ্গে “সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে”— এমন সব ছবি ও কথা লেখা হত কাপড়ের উপর রঙিন সুতো বুনে। কোনও কোনও বাড়িতে আবার এই ধরনের শিল্পকর্ম ফটোর আকারে কাচের ফ্রেমে বাঁধিয়ে দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখাও হত।
পরিবারের কোনও শিশুর জন্মের পর নবজাতককে দেখতে আসতেন আত্মীয়স্বজন। নিকট সম্পর্কের মহিলারা শিশুর উপহার এবং প্রয়োজনের কারণে সঙ্গে আনতেন নকশা করা ছোট ছোট কাঁথা। সে সবই নিজেদের হাতে বোনা। সেই সব কাঁথায় ছুঁচ আর সুতোয় বোনা ফুল, ফল, বা পশুপাখির ছবি থাকত। আর থাকত ছোট ছোট ছড়া। ছড়াগুলির বেশির ভাগই প্রচলিত। আবার অনেক সময়ে তাঁরা অপটু হাতে রচনা করতেন। পুরনো কাপড়ের উপর তৈরি হত অসাধারণ সব শিল্পকর্ম। কবি জসীমউদ্দিনের ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ কবিতার মেয়ে সাজুর তৈরি সেই নকশি কাঁথার মতো ছবি বোনা থাকত কাঁথার উপরে। কাঁথায় তৈরি ছবিটা দেখলে মনে হত সুতো নয়, রং-তুলিতে আঁকা হয়েছে।
তখনকার সাধারণ পরিবারের মহিলাদের এই সব কাজ শুধুমাত্র আত্মীয়-পরিজনের কাছেই সমাদর পেয়ে সঙ্কীর্ণ গণ্ডির মধ্যে থেকে যেত। সুন্দর এই শিল্পকর্মটি এখন প্রায় হারিয়েই গিয়েছে। এরই মাঝে শ্রীমতী সেনের মতো কিছু মানুষ এগুলোকে ধরে রেখেছেন। এখনও এই দুর্লভ শিল্পের চর্চা করে যাচ্ছেন। এই শ্রম আর নিষ্ঠা অতিমাত্রায় প্রশংসনীয়।
অমলকুমার মজুমদার, শিবপুর, হাওড়া
বাঙালির খেলা
সদ্য টোকিয়ো অলিম্পিক্সের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। নীরজ চোপড়া, বজরং পুনিয়া, মীরাবাই চানু, লাভলিনা বরগোহাঁই প্রমুখের নাম গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। সর্বত্র চলছে তাঁদের নিয়ে আলোচনা। কোথাও আনন্দের বাঁধ ভেঙে পড়েছে। এগুলো দোষের নয়। কারণ, তাঁরা পদক এনে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। কোনও প্রশংসাই তাঁদের জন্য যথেষ্ট নয়। তাই আমাদের দেশের ক্রীড়া ইতিহাসে এগুলি স্মরণীয় মুহূর্ত।
অন্য দিকে, তাঁদের কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায়, কষ্ট সহিষ্ণুতা, সঙ্কল্পে অটল থাকার মানসিকতা সত্যিই কি বাঙালি যুবসমাজে কোনও রেখাপাত করবে না? কয়েক বছর আগে মফস্সলে শীতকালীন ক্রীড়া প্রতিযোগিতার রমরমা ছিল। এমনকি স্কুল-কলেজের স্পোর্টস নিয়ে ব্যাপক উত্তেজনা থাকত। জেলা ও রাজ্যস্তরের রেকর্ড নিয়েও কম চর্চা হত না। এই মফস্সল থেকেই আমরা পেয়েছি জ্যোতির্ময়ী শিকদারকে। সম্প্রতি জেলাস্তরে স্পোর্টস সেই ভাবে আকৃষ্ট করে না। ফলে দু’-এক জন বাঙালি অলিম্পিক গেমসে অংশগ্রহণের সুযোগ পান।
অলিম্পিক গেমস শেষ। শপথ নেওয়ার দিন শুরু হোক। আমাদের রাজ্য জুড়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ব্যাপক ভাবে স্পোর্টস অ্যান্ড গেমস-এর প্রসার ঘটুক। বহু সংখ্যক বাঙালি অলিম্পিক গেমসে অংশগ্রহণ করুক। পদক নিয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বলতর করুক। স্বাধীনতার ৭৫ বছরে আমাদের এই ভাবনা কি অমূলক?
নীলমণি চক্রবর্তী, কৃষ্ণনগর, নদিয়া
পুরনো সব ভাল?
স্বাতী ভট্টাচার্যের নেওয়া সাক্ষাৎকারে (‘পথ দেখাবে গণ-আলোচনা’, ১৪-৮) অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই বলেছেন— “আমাদের ‘সোনালি অতীত’ আলোচনা করতে গিয়ে ভুলে যাই, পঁচাত্তর বছর আগে ভারতীয়দের কী দুর্দশা ছিল। দুর্ভিক্ষ অর্ধাহার-অনাহার, দরিদ্র ও দুর্বল মানুষের উপর নানা রকম অন্যায়-অবিচার, বিপুল বৈষম্য...”। যাঁরা যুক্তির পরোয়া না করে বলেন, আগের সব কিছু ভাল ছিল, তাঁরা অসত্য বলেন। নিজের ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে দারিদ্রের চেহারা যে কী ছিল, আজকের প্রজন্ম তা কল্পনাও করতে পারবে না। গ্রামাঞ্চলের কথা বাদ দিলাম, শহর ও শহরতলিতে ক’টা পাকা ছাদওয়ালা বাড়ি ছিল? সিমেন্ট কেনার সামর্থ্য নেই। মাথায় টালি, খোলা বা টিনের চাল। গ্রামে তো মাটির বাড়ি, মাটির দেওয়াল, টালি বা খড়ের চাল। শহর বাদে শহরতলি ও গ্রামের পথ— সবই কাঁচা। বর্ষাকালে দুর্ভোগের শেষ ছিল না। এটা ১৯৫০-এর ভারতের ছবি।
অধিকাংশ বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই। রাতে কেরোসিনের লণ্ঠন ও কুপি সম্বল। ওই আলোতেই সব কাজ, লেখাপড়া। তবে বিয়ে বা অনুষ্ঠান উপলক্ষে হ্যাজাক ভাড়া পাওয়া যেত। রান্নার কাজ হত গোবর দিয়ে ল্যাপা মাটির উনুনে। গোবর অ্যান্টিসেপ্টিক। জ্বালানি কয়লা ঘুঁটে কাঠ বা গুল। খরচ বাঁচাতে অধিকাংশ বাড়িতে কয়লার গুঁড়োর সঙ্গে মাটি মিশিয়ে বাড়িতেই গুল তৈরি হত।
সাবান বলতে লাল রঙের লাইফবয়। ওটাই সবচেয়ে সস্তা ছিল। সুগন্ধি সাবান ব্যবহার সে সময় বিলাসিতা, যা সাধারণের সামর্থ্যের বাইরে। মেয়েরা মাথার চুল পরিষ্কার করতেন শ্যাম্পু নয়, কাপড় কাচার গোল বা বাটি সাবান দিয়ে। কাপড় কাচার ডিটারজেন্ট এসেছে অনেক পরে। এখনকার মতো বাড়িতে সবেধন নীলমণি একটি নয়, একাধিক বাচ্চাকাচ্চা থাকত। লেখাপড়ার জন্য বাঁধানো খাতার সঙ্গে ভাল পেন নয়, স্লেট-পেনসিল। প্রত্যেকের জন্য স্লেট কেনার সামর্থ্য ছিল না। একটা স্লেটেই ভাগ করে সবার লেখাপড়া। বড় স্লেট-পেনসিল কিনে টুকরো টুকরো করে সবাইকে দেওয়া হত।
ছোটরা অধিকাংশ সময়ই খালি গা, পরনে ইজেরের প্যান্ট। গ্রামাঞ্চলে তা-ও জুটত না। অধিকাংশ বাচ্চা উলঙ্গ থাকত। অসুখ-বিসুখে ওষুধ বা ডাক্তার দেখানোর ক্ষমতা বেশি মানুষের ছিল না। ডাক্তারের ফিজ় দু’টাকা, মিক্সচার দু’টাকা বা আড়াই টাকা। তাও ক’জনেরই বা জুটত! পথ্য বলতে বিশ্রী স্বাদের সাবু বা বার্লি, যত দিন না জ্বর ছাড়ে।
পরিশেষে লিখি, বিরোধী দলরা (যে যখন) শাসক দলের (যে যখন) বিরুদ্ধে সংসদে বা বাইরে যতই গলা ফাটাক, নিন্দা করুক, ‘গেল গেল’ রব তুলুক না কেন, ১৯৫০-এর ভারতের সঙ্গে ২০২১-এর ইন্ডিয়ার বিস্তর ফারাক। দেশে প্রভূত উন্নতি হয়েছে। দারিদ্র মোচনে, শিক্ষায়, সাক্ষরতায়, কৃষিতে, বিজ্ঞান চর্চায় ও সামরিক শক্তিতে দেশ অনেক এগিয়েছে। ১৯৫০-এ ক’টা লোকের বাড়িতে কাজের লোক ছিল? বর্তমানে শহর ও শহরতলিতে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে কাজের লোক আছে, যা বহু মানুষের কর্মসংস্থান করছে। এত সব উন্নতি ঘটেছে বহু মানুষের মিলিত চেষ্টায়।
কুমার শেখর সেনগুপ্ত, কোন্নগর, হুগলি
ধনীরাই সব
‘উটপাখি’ (১৯-৮) শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রসঙ্গে বলি, কেন্দ্রীয় সরকারের বয়েই গিয়েছে দেশে গরিব, দারিদ্রসীমার নীচে কত জন আছেন, তা দেখতে। এঁরা তো আর সরকারকে কর দেন না, হিসাব কী করে থাকবে? পরিযায়ী শ্রমিক, করোনায় অক্সিজেন না-পেয়ে, ঝড়-জলে মৃত্যু... এঁরা বাঁচল, না মরল, কী এসে গেল! জ্ঞানপাপীদের কে বোঝাবে? রামমন্দির, সেন্ট্রাল ভিস্টা, মূর্তি স্থাপন, বুলেট ট্রেন... এ সব আগে, না গরিব-সেবা আগে? সত্য গোপন বা আসল তথ্য সামনে না-আনা, এ প্রবঞ্চনা ছিল, আছে, থাকবেও।
শিবপদ চক্রবর্তী, কাঁচরাপাড়া, উত্তর ২৪ পরগনা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy