Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪
Religious Differentiation

সম্পাদক সমীপেষু: জাতের বিচার

এই শ্রাবণ মাসে বা চৈত্র মাসে পশ্চিমবঙ্গে জল ঢালতে যাওয়ার প্রথা (যাকে উত্তরপ্রদেশে কাঁওয়ার যাত্রা বলা হয়) রয়েছে।

শেষ আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৯:৫৯
Share: Save:

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘আগে বলো কী তোমার নাম’ (৩০-৭) পড়ে শিহরিত হলাম। সাম্প্রদায়িক বিষ আর কী ভাবে ছড়াবে আমাদের দেশে? কী অদ্ভুত ভাবে ভাগাভাগি করা হচ্ছে মানুষের সঙ্গে মানুষকে। জাতপাতের সুরা পান করিয়ে মাতাল করা হচ্ছে আমাদের। মাতাল আমরা হানাহানি, হিংসা, দাঙ্গার বলি হচ্ছি রোজ। এই ঘোলা জলে মাছ ধরার চেষ্টা চালানো হচ্ছে সর্বক্ষণ। মনে করুন আপনি রেস্তরাঁয় খেতে গিয়ে জিজ্ঞেস করছেন এখানকার পাচক-এর নাম কী? নাম জানলে তবেই আপনি এই রেস্তরাঁয় খাবেন। কিংবা মালিকের নাম, ঠিকানা, সব কিছু জেনে আপনি খাবেন। আমরা কি কোনও দিন ভেবে দেখেছি, আমরা যে ফুল দিয়ে মন্দিরের দেবতার পূজা করি, কিংবা যে পিতল-কাঁসার পূজাসামগ্রী ব্যবহার করি, তার বিক্রেতা কে? কিংবা, যাঁরা এই সব তৈরি করেছেন, তাঁরা কোন জাতের?

এই শ্রাবণ মাসে বা চৈত্র মাসে পশ্চিমবঙ্গে জল ঢালতে যাওয়ার প্রথা (যাকে উত্তরপ্রদেশে কাঁওয়ার যাত্রা বলা হয়) রয়েছে। এই সময় তারকেশ্বর, দেওঘর, হরিদ্বারের মতো জায়গায় লক্ষ লক্ষ তীর্থযাত্রী শিবের মাথায় জল ঢালতে যান। এই যাত্রা প্রায় মাসখানেক সময় ধরে চলে। এই সময় পথের ধারে ছোট-বড় খাবারের দোকান, ফুল মালার দোকান, জল ঢালতে যাওয়ার পোশাকের দোকান, বাঁক সাজানোর দোকান প্রভৃতিতে তীর্থযাত্রীর ঢল নামে। এই সমস্ত কিছুকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গড়ে ওঠে। সেখানেও এই ধরনের হীন কাজ, নীচ মনের পরিচয় দেওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। যদিও বিভাজন আর বিদ্বেষ যাদের ধমনী, শিরায় মিশে রয়েছে, তাদের কাছে এমন কাজই তো প্রত্যাশিত। এই হবু রাজা আর গবু মন্ত্রীর হাত থেকে রেহাই পেতে আমাদের বার বার আদালতের শরণাপন্ন হতে হবে। কিন্তু আদালতের রায় মানুষের হৃদয়ের অন্তস্তলে পৌঁছবে তো, না কি সাম্প্রদায়িক এই গরল শেষ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বে দেশ থেকে দেশান্তরে?

তমাল মুখোপাধ্যায়, ডানকুনি, হুগলি

ভারতের দেবতা

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। নবীন ইতিহাসবিদেরা বলেছেন, ভারতে আধুনিকতার জন্ম পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে। শ্রীচৈতন্যের সময়ে প্রাক্‌-ঔপনিবেশিক আধুনিকতার যে উদ্বোধন ঘটেছিল, তা এই একুশ শতকে এসেও মানুষে মানুষে ভালবাসার রাখি বাঁধতে পারল না, এটাই বিস্ময়কর। বিদ্বেষ-বিভাজনের বিষে বর্তমান ভারতীয় সমাজ এখনও দূষিত। প্রবন্ধকার সে দিকেই দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে চেয়েছেন। শৈব সাধনায় তীর্থযাত্রীদের সাহায্য করার সদিচ্ছায় মুজ়ফ্‌ফরনগর-সহ উত্তরপ্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ডের কিছু এলাকায় স্থানীয় পুলিশ নির্দেশ দিয়েছিল, ভক্তদের যাত্রাপথে যে সব ভোজনালয় পড়ে, সেগুলির প্রত্যেকটির সামনে তাদের মালিক ও কর্মীদের নামের তালিকা টাঙিয়ে রাখতে হবে। খাদ্যতালিকার বদলে ভোজনালয়ে মালিক ও কর্মীদের নামের তালিকা টাঙানোর নির্দেশ বহুমতের এই দেশে নাগরিক মনে যথার্থই বিস্ময়ের উদ্রেক করে। উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিষ সমাজের অন্তরমহলে ঢুকলে এমনটাই হয়।

দেশের সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচন দেখিয়েছে এনডিএ জোট ভোটপ্রাপ্তির নিরিখে সমগ্র দেশে ভোট পেয়েছে ৪৩.৬ শতাংশ, এবং ইন্ডিয়া জোট পেয়েছে ৩৬.৭ শতাংশ। অর্থাৎ সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা প্রশমনের জন্য দেশ জুড়ে বিরোধীদের যথেষ্ট সমর্থন রয়েছে। তবুও ধর্মের নামে অসহিষ্ণুতা এ দেশ ছেড়ে যাওয়ার নয়। দেশীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে ভারতে ‘ধর্ম’ সামাজিক জীবনের যাপনচিত্রটিকে সূচিত করে। আধ্যাত্মিকতা ব্যতিরেকে এ দেশের যাপনচিত্র বর্ণহীন। কিন্তু ছলে-বলে-কৌশলে সেই ধর্মীয় ঐতিহ্যের মোড়কে সমাজকে নিয়ে এক দল রাজনীতিকের যখন দড়ি টানাটানি চলে, তখনই শুরু হয় গোলমাল। কেন্দ্রের শাসক এই বিদ্বেষ-বিভাজনের রাজনীতির ধারক বাহক হলেও, বিরোধীদের নরম হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে একেবারে ঝেড়ে ফেলে দেওয়া যায় না। সম্প্রতি শৈব সমাজকে তুষ্ট রাখতে সংসদ কক্ষে প্রধান বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধীকে পর্যন্ত মহাদেবের ছবি তুলে ধরতে হয়েছিল। আসল কথা হল, ভারতে রাজনীতি জুড়েই এখন সংখ্যাগুরুবাদের ধর্মীয় আবহ ঘুরে ফিরে বেড়ায়। তাই মনে হয়, শ্রাবণ মাসের সময়টিকে দেশ জুড়ে ‘জল’ নামক জীবনের অতি আবশ্যক বস্তুটি নিয়ে চেতনা জাগানোর উৎসব পালন করতে চাওয়ার যে শুভ বাসনা প্রকাশ করেছেন প্রবন্ধকার, তা ভারতে আজকের রাজনৈতিক আবহে অসম্ভব।

কথাগুলি খানিক নিরাশাবাদী শোনালেও বাস্তব পরিস্থিতিতে বিদ্বেষ-বিভাজনের রাজনীতির উপরেই যে ভোটবাক্সে সংখ্যার ওঠানামা অনেকখানি নির্ভরশীল, তা বলা বাহুল্য। সংখ্যালঘুকে বহুত্ববাদের ভারতে প্রতিনিয়ত কোণঠাসা করতে চাওয়া বর্তমান সময়ের ভারতীয় রাজনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সেখানে খাদ্যে, রুচিতে, পরিচয়ে ‘ভারতবাসী’ পরিচয়কে সরিয়ে রেখে একটি বিশেষ সম্প্রদায়কে পৃথক করাই সেই অসহিষ্ণু রাজনীতির অন্যতম কৌশল। তাই কাঁওয়ার যাত্রাকে কেন্দ্র করে হোটেল মালিক এবং কর্মীদের পরিচয় জানতে চাওয়ায় বিস্ময়ের অবকাশ নেই।

রবীন্দ্রনাথের গোরা উপন্যাসে পরেশবাবুকে গোরা বলেছিল, “...আপনি আমাকে আজ সেই দেবতারই মন্ত্র দিন, যিনি হিন্দু মুসলমান খৃষ্টান ব্রাহ্ম সকলেরই— যাঁর মন্দিরের দ্বার কোনো জাতির কাছে, কোনো ব্যক্তির কাছে কোনওদিন অবরুদ্ধ হয় না— যিনি কেবলই হিন্দুর দেবতা নন, যিনি ভারতবর্ষের দেবতা।” আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা ধর্মীয় রাজনীতির অসহিষ্ণু ভারত এমন কথাগুলি আর কত দিনে আত্মস্থ করতে পারবে?

সঞ্জয় রায়, হাওড়া

রাহুলের নেতৃত্ব

রাহুল গান্ধীর নেতৃত্ব নিয়ে তৃণাঞ্জন চক্রবর্তী যে প্রশংসার বাণী নিক্ষেপ করলেন তাঁর ‘হিন্দুত্বের পাল্টা অস্ত্র সংবিধান’ (১০-৮) শীর্ষক প্রবন্ধে, তার সঙ্গে বাস্তবের মিল খুব সামান্য। এ বারের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস কিছুটা ভাল ফল করেছে, তবে তাতে যে রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বের বিশেষ অবদান রয়েছে, তা কিন্তু নয়। বরং বলা যেতে পারে, দীর্ঘ ক্ষমতায় থাকার ফলে বিজেপির মধ্যে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস, দম্ভ ও অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে, যা জনগণের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছিল। সেটাই কংগ্রেসকে ভাল ফল করতে সাহায্য করেছে।

রাহুলের ন্যায় যাত্রায় তাঁর দলের কর্মীদের উৎসাহ বাড়তে পারে, সাধারণ মানুষের উপর কোনও প্রভাব পড়েনি। সংবিধান হাতে নিয়ে সংসদে বিজেপিকে ভয় দেখানো, বা ‘আমি আসল হিন্দু, বিজেপি নকল হিন্দু’ বলাটা কোনও উচ্চমানের নেতৃত্বের প্রকাশ নয়। রাহুল যদি ধর্মনিরপেক্ষতার প্রবক্তা হন, তা হলে সংসদ ভবনে কী করে শিবের ছবি দেখিয়ে বিজেপিকে আক্রমণ করেন, নিজেকে ‘আসল হিন্দু’ বলে দাবি করেন?

রাহুল গান্ধীর ভাষণগুলির মূল উদ্দেশ্য অম্বানী, আদানিকে টেনে মোদীর কুৎসা করা, নয়তো হিন্দুত্বকে গালাগালি করা। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁর কোনও রোডম্যাপ নেই। সংবিধান কেউ হাতে নিলেই প্রমাণ হয় না তিনি খুব উচ্চমানের নেতা, বা তাঁর নেতৃত্বের ধার আছে। কংগ্রেসের নেতা হিসাবে রাহুল বহু বার বিদেশে গিয়েছেন, এবং বিজেপিকে হেয় করার জন্য সেখানে গিয়ে দেশের গণতন্ত্রের নিন্দা করেছেন। এর থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না তাঁর নেতৃত্বের প্রজ্ঞা কতটা। রাহুলের চেয়ে অনেক ভাল নেতা কংগ্রেসে আছেন। তাঁরা যে কেউ নেতৃত্বে এলে বিজেপির আরও ভাল ভাবে মোকাবিলা করতে পারে কংগ্রেস দল। কিন্তু দলটা যে গান্ধীদের পারিবারিক দল। ফলে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মতো নেতাকেও মুখ্য নেতৃত্বে আসতে দেওয়া হয়নি। বিজেপির ক্ষমতার অহমিকা যে পরিণামই ডেকে আনুক না কেন, সবই রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বের যোগ্যতার সিলমোহর দিয়ে যাচ্ছে এবং যাবে।

মিহির কানুনগো, কলকাতা-৮১

অন্য বিষয়গুলি:

minorities
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy